প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা মোকাবিলায় উদ্যোগ নিন
নারী মাত্রই মা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে। বিবাহিত জীবনে নারীর প্রথম চাহিদা থাকে একটি সুস্থ ও সুঠাম দেহের সন্তানের। প্রথম পর্যায়ে সন্তান ছেলে বা মেয়ে হোক, সে বিষয়ে কারোরই তেমন মাথাব্যথা থাকে না। পরবর্তীকালে একাধিক কন্যা সন্তান জন্ম নিলে অধিকাংশের মনে বিতৃষ্ণা জন্ম নেয়। আমাদের সমাজটাই এভাবে গড়ে উঠেছে যেখানে কন্যা সন্তানের আগমনকে খুব একটা শুভভাবে মেনে নিতে পারে না অধিকাংশ মানুষ। তবু আজ সমাজে মেয়েরা নিজেদের যোগ্যতা, দক্ষতা দিয়ে স্থান করে নিচ্ছে।
নারীদের জীবন চির যন্ত্রণার, অবহেলার, অস্বস্তির। মা হওয়া যেমন নারীর কাছে স্বপ্নের, ভালোলাগার; ঠিক তেমনি মা হওয়ার পর নারীর শরীর-মনজুড়ে বিষণ্নতা কাজ করে। নারীরা বেশ খিটখিটে স্বভাবেরও হয়ে পড়ে৷ এটা হরমোনজনিত সমস্যা। কারণ সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য একজন মাকে দীর্ঘ আট থেকে নয় মাস যুদ্ধ করতে হয়। শারীরিক যত কষ্টই হোক না কেন, মা তার গর্ভের সন্তানের প্রতি বিশেষ যত্নপরায়ণ। কখন কিভাবে খাওয়া-দাওয়া করলে সন্তান ভালোভাবে বেড়ে উঠবে, মায়ের শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং গর্ভকালীন নানাবিধ জটিলতা এড়িয়ে চলতে মায়েদের বিধিনিষেধের শেষ নেই। কিন্তু যেদিন সন্তান ভূমিষ্ট হয়, তারপর পর থেকে মায়ের শরীরে পরিবর্তন আসে। হরমোনজনিত কারণে মা তার দেহে মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করে গর্ভে সন্তান আসার পরপরই। তাই অন্তঃসত্ত্বা মা নিজের বাড়তি যত্ন নেন। এমনকি পরিবারের সদস্যরাও এসময় ওই অন্তঃসত্ত্বা মায়ের প্রতি বাড়তি নজর দেন।
কিন্তু সন্তানের জন্ম হওয়ার পরও যে মায়ের শারীরিক নানা পরিবর্তন ঘটতে পারে এই বিষয়ে অধিকাংশই ওয়াকিবহাল নয়। নতুন সন্তান সবার মনোযোগ এত আকৃষ্ট করে যে, মায়েরও যে বাড়তি যত্ন প্রয়োজন এ বিষয় নিয়ে অধিকাংশ তেমন মাথা ঘামান না৷ সন্তান জন্ম নেওয়ার পর আরেক দফা মাকে কষ্ট করতে হয়। রাত-দিন সন্তানের বাড়তি যত্নে মা নিজের যত্ন ভুলে যান। এরফলে দেখা যায়, মা শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন৷ বিষণ্নতায় ভোগেন।
নানামুখী কারণে মায়ের মন-মেজাজ ভালো থাকে না। মায়ের এই প্রতিক্রিয়া পড়ে তার শরীরেও। এই মন খারাপ হওয়ার মূল কারণ প্রসব-উত্তর অবসাদ। যাকে ইংরেজিতে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (পিপিডি) বলা হয়ে থাকে। সদ্য প্রসূতি মায়েদের অনেকেই প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতায় (পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন) আক্রান্ত হন। যা মা ও শিশু দু’জনের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই এ সময়টাকে মোকাবিলা করতে পরিবারের সবার সহোযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।
চিকিৎসকদের মতে, সন্তান জন্মদানের পর দেহে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে এই জাতীয় ডিপ্রেশন হতে পারে। এছাড়া, গর্ভকালীন দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি বা অবসাদ, বুকের দুধ খাওয়ানোর চ্যালেঞ্জ এবং প্রসব-উত্তর অন্যান্য জটিলতার কারণেও এ সময় প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে।
মূলত প্রসব পরবর্তী নিম্নল্লোখিত কারণে মায়েদের নানারকম সমস্যা দেখা দেয়। সেগুলো হলো: অস্থির লাগা বা মেজাজ খারাপ হয়ে থাকা, কোনো কারণ ছাড়াই মন খারাপ বা কান্না আসা, অতিরিক্ত ঘুম হওয়া অথবা প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগলেও ঘুম না আসা, খুব কম খাওয়া কিংবা অতিরিক্ত খাওয়া, নানান ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব হওয়া, সবকিছু অতিরিক্ত মনে হওয়া এবং হতাশ লাগা, নিজেকে অসহায় লাগা, মনোনিবেশ করতে বা সহজ সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, যে জিনিসগুলো এক সময় উপভোগ করতেন তাতে কোনো আগ্রহ না থাকা, কাজে শক্তি বা অনুপ্রেরণা না পাওয়া, শিশুকে বা নিজেকে আঘাত করার কথা চিন্তা করা, সন্তানের প্রতি আগ্রহ কাজ না করা, তার থেকে দূরে থাকা। অর্থাৎ এমন মনে হওয়া যে সন্তান নিজের নয়, অন্য কারোর, স্মৃতির সমস্যা প্রভৃতি।
এগুলো পরিত্রাণ পেতে হলে সদ্য মা হওয়া নারীদের বাড়তি যত্ন প্রয়োজন। মা’কে বাড়তি যত্ন নেওয়ার মাধ্যমেই শিশুরও যত্ন নেওয়া হয়। কারণ মায়ের সঙ্গে শিশু সম্পৃক্ত। এসময় বিশ্বস্ত কারো কাছে অনুভূতিগুলো ভাগাভাগি করে নেওয়ার মাধ্যমে মা তার স্ট্রেচগুলো কমিয়ে আনতে পারেন। একা না থেকে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে থাকলে সন্তানকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তায় পড়বেন না মা। ফলে মাতৃত্বকালীন মায়ের পাশে বিশ্বস্ত কাউকে রাখা।
সুযোগ ও সুবিধা মতো বিশ্রাম করা। পুষ্টিকর খাবার খাওয়া। পর্যাপ্ত ঘুম সবই একজন মায়ের জন্য জরুরি। যাতে মন ভালো থাকে। আর মন ভালো থাকার অর্থই হলো শরীরও সুস্থ থাকা। তাই প্রসবত্তোর মায়ের বিষণ্ণতা দূর করতে সবার পরিপূর্ণ সহযোগিতা বিশেষ প্রয়োজন। এরফলেই মা ও শিশু দুজনেই সুস্থ থাকতে সক্ষম হবেন।