বিশ্বকাপ উন্মাদনায় হারিয়ে গেলো রুবিনার হত্যাকাণ্ড
আমরা জানি, জাতি হিসেবে বাঙালি খুবই হুজুগে। একইসঙ্গে আবেগপ্রবণও। তবে সবসময় আবেগ যেমন ভালো নয়, তেমনই হুজুগের বশে বেশি লাফালাফির ফলও ভালো হয় না। মহামনীষী চাণক্য বলেছিলেন, ‘প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত যা, তার সবকিছুই বিষ। আমাদের সমাজব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে উঠেছে, যেখানে পরিমিতিবোধ অধিকাংশের মধ্যেই সৃষ্টি হয়নি। এর ফলস্বরূপ সামনে যখন থাকে তখন তার কথোকতার শেষ থাকে না। আবার যখন ঘটনা, ব্যক্তি, স্থান দূরে সরে যেতে থাকে, তখন মনের মধ্যে থেকেই বিষয়টা দূর করে দেয় এই জাতি। প্রকৃত দোষী ব্যক্তি শাস্তি পেলো কি না, সে বিষয় নিয়ে জাতির মাথাব্যথা থাকে না। কিন্তু টাটকা, গরম আবহাওয়ায় বা তাজা থাকতে অর্থাৎ যখন যেকোনো ঘটনা ঘটে, তখন একেকজনের পোস্ট, ভিডিও, নানারকম মন্তব্য, আলোচনা-সমালোচনায় ভরে ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যমগুলো। বিষয়গুলো সত্যিই অতিরঞ্জিত হয়ে পড়ে! ঠিক ক’দিন না যেতেই পরিবেশ শান্ত হয়ে যায়।
প্রবাদে আছে, ‘চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল’। আমরা জাতি হিসেবে এই বিষয়টি এতটাই রপ্ত করেছি যে, আমাদের সমাজ- মানস গড়েই উঠেছে এভাবে। ফলে ন্যায়বিচার হোক, অন্যায় বা দুর্নীতির ঘটনা হোক দুদিন পর সব জল থিতিয়ে ঘোলাটে ভাব চলে যায়। মানুষ ভুলতে বসে৷ শুধু ভুক্তভোগীর জীবন পঙ্গু হয়ে যায়। গত ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানুষ সাক্ষী হয়েছে আরও একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার। একজন নারী যার নাম রুবিনা গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। তবে অন্যান্য আর সব দুর্ঘটনার চেয়ে এই ঘটনাটি এতটাই বিভৎসতার সাক্ষ্য বহন করেছে যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখে গায়ের রোম খাড়া হয়ে যায়। মৃত্যুকে এতটা যন্ত্রণাদায়ক করে তোলার জন্য যে বা যারা দায়ী, তাদের কী বিচার হলো?
প্রথমেই বলেছি, আমরা আবেগপ্রবণ জাতি। আমাদের আবেগ যতদিন থাকে, লাফালাফিও চলে সেই কয়দিন। তারপর সবই স্তিমিত হয়ে পড়ে। কোথায় গেলো রুবিনা কাণ্ডের অভিযুক্ত ব্যক্তি? জাতি কি আর কোনোই খবর রেখেছে? বিশ্বকাপের উন্মাদনায় আমাদের মস্তিষ্ক থেকে উধাও এত বড় বিভৎস, ভয়াবহ, ন্যাক্কারজনক ঘটনা! ২ ডিসেম্বরের একটি ঘটনা যেন যুগ পেরিয়ে গেছে। আর কি কখনো কেউ মনে রাখবে, একজন সদ্যবিধবা নারী, যিনি প্রচণ্ড সংগ্রাম করে একমাত্র ছেলেকে মানুষ করতে চেয়েছিলেন। এই ছেলেটিও বাবাকে হারিয়ে মাকে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিল। আজ তার অবস্থান কোথায়? কেউ কি এই হতভাগ্য ছেলেটিকে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়েছে? কোথায় গেলো আমাদের বিবেক? আর কোথায় গেলো অভিযুক্ত ব্যক্তি? নাকি আর সব ঘটনার মতোই অপরাধী নিজের টাকার থলির জোরে পার পাবেন!
আসলে এটা দুর্ঘটনা হিসেবে কতটা মেনে নেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে সত্যিই সন্দেহ রয়েছে। বরং এই ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বলাই শ্রেয়। এটা স্পষ্ট যে, দিনে দিনে মানুষ পাশবিক হয়ে উঠছে! মানুষের মাঝে ন্যূনতম মূল্যবোধটুকুও নষ্ট হয়ে গেছে। মানুষ এখন স্রেফ একটি যান্ত্রচালিত দানবে পরিণত হয়েছে। জীবনের স্বাভাবিকতা যেন বিলুপ্তির পথে। আমাদের সমাজ আজও মানুষকে মেপে চলেছে তার ডিগ্রি দিয়ে। পুঁথিগত বিদ্যার ঝুলি কত ভারী, তা দিয়ে। আরও একটি বিষয় একইসঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত, টাকা। অর্থাৎ যার কাছে যত অর্থ আছে, সমাজে তিনি তত নামিদামি, প্রভাবশালী ব্যক্তি। কিন্তু কিছু বিকারগ্রস্ত টাকাওয়ালা প্রভাবশালী ব্যক্তির দম্ভের শিকার হয় সাধারণ মানুষ। ২ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রাইভেট কারের নিচে পড়ে রুবিনা আক্তারের মৃত্যু ঠিক এমনটাই প্রমাণ করে।
অপরাধী যদি অপরাধ করে পার পেয়ে যায়, তবে সমাজের মাঝে এটাই নজির হয়ে থাকবে। পরবর্তীকালে অপরাধ করার ক্ষেত্রে মানুষের কোনো ভয়-ভীতিই থাকবে না। তাই দেশের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, অন্যায়ের শাস্তি নিশ্চিত করতে রুবিনাহত্যা যেন আমরা না ভুলে যায়।
যদিও আমাদের দেশে বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনা কোনো ব্যাপারই নয়। এটাই যেন স্বাভাবিক মৃত্যুর খাতায় নাম লিখিয়েছে! বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর কোনো মানুষই জানে না আসলেও সুস্থ শরীর নিয়ে তিনি আবার ঘরে ফিরতে পারবেন কিনা! এক আজব সমাজ, রাষ্ট্রের বাসিন্দা আমরা। যার আপনজন চলে যাচ্ছে সেই কেবল বেদনা বহন করে চলছেন। আর সবাই একদিন-দুদিন আলোচনা করলেও তৃতীয়দিন ভুলে যাচ্ছে। দিনে দিনে দেশ এক মৃত্যুকূপে পরিণত হচ্ছে। রুবিনাদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর দায় কার?
দেবর নুরুল আমিনের সঙ্গে মোটরসাইকেলে রুবিনা আক্তার রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বাসা থেকে হাজারীবাগে বাবার বাড়ি যাচ্ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বিপরীতে টিএসসি অভিমুখী সড়কে একটি প্রাইভেট কার পেছন থেকে তাদের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। এতে নুরুল আমিন মোটরসাইকেলসহ এক পাশে ছিটকে পড়েন। রুবিনা গাড়ির নিচে চাপা পড়েন।
এ সময় গাড়ির বাম্পারে তার শাড়ি আটকে যায়। চালক গাড়ির নিচে আটকে যাওয়া রুবিনাকে নিয়ে বেপরোয়া গতিতে টিএসসি হয়ে নীলক্ষেতের দিকে যান। নীলক্ষেতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তোরণের কাছে গাড়িটি আটকে রুবিনাকে জীবিত উদ্ধার করেন পথচারীরা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি মারা যান। পথচারীরা যখন রুবিনাকে উদ্ধার করে, ততক্ষণে গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে ছিন্নভিন্ন হয় তার শরীর। নারীর এমন মৃত্যু শুধু একজন মানুষের মৃত্যু নয় এটা মানবতার মৃত্যু, জাতির বিবেকের মৃত্যু। মানুষ কতটা দাম্ভিক হলে এমন পিশাচসম কাজে লিপ্ত হতে পারে?
একজন নারী গাড়ির চাকায় পিষ্ট হচ্ছে আশেপাশের লোকজন তাকে ধাওয়া করছে আর তিনি তত জোরে গাড়ি চালিয়ে চলেছেন। তার নির্বিকার মনুষ্যত্ব যদি জাগতো হয়তো রুবিনা বেঁচে যেতেও পারতেন।আমাদের সমাজের বিবেকশূন্য এসব মানুষ সমাজকে কলুষিত করছে। এই ধরনের ঠাণ্ডা মাথার খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যেন মানুষের বিবেক যদি মরেও যায় ন্যূনতম আইনকে অন্তত তারা ভয় করে। কিন্তু যে আইনের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা, বিশ্বাসের একমাত্র জায়গা তারা ঠিক কতটা সত্যিই এই আস্থা অর্জনে সক্ষম? বুয়েট ছাত্র ফারদিন হত্যাকাণ্ড এখন আত্মহত্যার খাতায় নাম লিখিয়েছে! এরপূর্বে আরও অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের নাম উল্লেখ করা যাবে যেগুলোতে বিচারের নামে চলছে প্রহসন! সবকিছুর উর্ধ্বে যেহেতু আইন, রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা তাই রাষ্ট্রের কাছে সাধারণ মানুষের একটিই দাবি সঠিক বিচার হোক অপরাধীদের। সাধারণ মানুষ অন্তত বিচার পেয়ে হারানো বেদনা ভুলে থাকুক।
শুধু একজন রুবিনায় নয় প্রতিদিন পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হচ্ছে অসংখ্য মানুষের। এখনই এর নিয়ন্ত্রণ আনা জরুরি। বহুদিন ধরে সড়কে নিরাপত্তা জোরদার করার কথা বলা হলেও তা নিশ্চিত করা যায়নি। এখনো সময় আছে দেশ রসাতলে যাওয়ার আগে অন্তত মানুষকে বাঁচতে সহয়তা করুন। মানুষের হৃদয়ের হাহাকার কখনোই দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় আর কোনো তাজা প্রাণ এভাবে অকালে না ঝরুক। মানুষের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত হোক। কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে রাস্তায় চলাচলকৃত সব পরিবহন এবং চালকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। রাস্তায় রুবিনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পাশবিকতা মুক্ত হোক আমাদের প্রিয় স্বদেশ। বিশ্বকাপ উন্মাদনায় যে রুবিনাকে আমরা ভুলতে বসেছি সেই রুবিনার এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে আমাদেরই সোচ্চার হতে হবে।
অপরাধী যদি অপরাধ করে পার পেয়ে যায়, তবে সমাজের মাঝে এটাই নজির হয়ে থাকবে। পরবর্তীকালে অপরাধ করার ক্ষেত্রে মানুষের কোনো ভয়-ভীতিই থাকবে না। তাই দেশের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, অন্যায়ের শাস্তি নিশ্চিত করতে রুবিনাহত্যা যেন আমরা না ভুলে যায়।