নারীদের স্থূলতা বেড়েছে : সচেতনতা জরুরি
অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও খাদ্যাভাসের কারণে দিন দিন মানুষের শরীরে বাসা বাঁধছে নানারকম অসুখ। অপুষ্টি ও অসংক্রামক রোগের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা মিলছে, পুরুষের তুলনায় বরং নারীরা বিভিন্ন ধরনের জটিলতায় বেশি ভুগছে। ভেজাল খাদ্য দ্রব্য, পুষ্টিহীন খাবার, ভাজা পোড়া তেলের খাবার প্রভৃতি গ্রহণের মাধ্যমে শরীরে মারাত্মক রোগ দেখা দিচ্ছে অহরহ।
নারীরা মুখরোচক খাবার বেশি পছন্দ করেন। স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা বিবেচনা না করে হরহামেশাই খাচ্ছেন অস্বাস্থ্যকর খাবার। এর ফলে দেখা দিচ্ছে, ডায়বেটিস, পেটের রোগ, কিডনি জটিলতা, স্থূলতার মতো অসংখ্য সমস্যার। গত দেড় দশকে পুরুষের চেয়ে নারীদের স্থূলতা বা ওজন সংক্রান্ত সমস্যা বেড়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে স্থূলতা বেড়েছে তিনগুণ। যার প্রভাবে ক্রমাগত বাড়ছে উচ্চরক্তচাপ এবং ডায়বেটিস রোগীর সংখ্যা। অপরিকল্পিত নগরায়ন, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচরণের পরিবর্তনে এসব সমস্যা মোকাবিলায় জরুরি স্বাস্থ্য সচেতনতা।
সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশে নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যে ওজন কমে যাওয়ার প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে। ২০০৪ সালে নারীদের ওজন কমে যাওয়ার হার ছিল ৩৩ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১২ শতাংশে। একইভাবে পুরুষদের ক্ষেত্রে তা ২৬ থেকে নেমে ১৮ শতাংশে পৌঁছেছে। অন্যদিকে ২০০৪ সালে নারীদের অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতার হার ১৭ শতাংশ থাকলেও ২০১৮ তে এসে তা ৪৯শতাংশ হয়েছে। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে ২১ থেকে বেড়ে ৩৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর ওজন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেড় দশকের ব্যবধানে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমানুপাতিক হারে উচ্চরক্তচাপ ও ডায়বেটিস রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।
শহর ও গ্রামের চিত্র একই। আগে শহরে জীবনে বেশি ঝুঁকি ছিল। গ্রামের আবহ, প্রকৃতির সান্নিধ্য, খাবারের বিশুদ্ধতা, নির্ভেজাল আবহাওয়াতে মানুষ স্বস্তিতে এবং সুস্থভাবে বসবাস করতে পারত। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। শহরে বা গ্রামে খাবার জীবনাচরণে ব্যাপক পরিবর্তন। ফলে এদিক থেকে সব নারী-পুরুষের শরীরে জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জার্নাল প্রকাশনা সংস্থা পাবলিক লাইব্রেরি অব সায়েন্সের পিএলওএস ওয়ান চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ‘আন্ডারওয়েট, ওভারওয়েট অর ওবেসিটি, ডায়াবেটিস অ্যান্ড হাইপারটেনশন ইন বাংলাদেশ ২০০৪ টু ২০১৮’ শিরোনামের ওই গবেষণার ফল প্রকাশ করে। গবেষণায় বাংলাদেশে জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০০৪, ২০০৭, ২০১১, ২০১৪ ও ২০১৮-এর তথ্য নেওয়া হয়েছে। এতে ১৫ থেকে ৪৯ বছরের সাড়ে ৭০ হাজার নারী ও ১৮ থেকে ৯৫ বছরের প্রায় ১১ হাজার পুরুষের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং তিনটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের সাত গবেষক এতে কাজ করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) মতে, শরীরে অস্বাভাবিক বা অত্যধিক চর্বি জমে যাওয়া অর্থাৎ স্থূলতা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বডি মাস ইনডেক্স (একজন ব্যক্তির ওজন কেজিতে বা পাউন্ড ও উচ্চতা মিটার বা ফুট দ্বারা ভাগ করা হয়, যা শরীরের চর্বি নির্দেশ করে) ২৫-এর বেশি হলে তাকে অতিরিক্ত ওজন বিবেচনা করা হয়। আর ৩০-এর বেশি হলে তাকে বলা হয় স্থূলতা। যা শরীরের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যায়, শুধু স্থূলতার কারণে বিশ্বে ৪০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। নারীদের স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে। নতুবা শারীরিকভাবে নানাবিধ জটিলতা বাড়তে পারে। ওজন অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে গেলে শরীরে উচ্চরক্তচাপসহ নানা ধরনের রোগ যেমন—হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, মস্তিষ্কে স্ট্রোক, অস্থির প্রদাহ, পিত্তথলিতে পাথর, বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, ঘুমে ব্যাঘাত, নানা ধরনের ত্বকের রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। চর্বি রক্তনালিতে স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে, যা থেকে নানা ধরনের সংকটের সৃষ্টি হয়।
বর্তমান যুগে শারীরিক পরিশ্রম হয় এমন কাজের পরিমাণ কমেছে। এখনকার নারীরা কোনরকম কষ্ট ছাড়াই সংসার পরিচালনা করতে চান। সব্জি কাটার থেকে শুরু করে সব যন্ত্রচালিত হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে একদিকে আধুনিকতার ছোঁয়া বাড়ছে অন্যদিকে শরীরে বাড়ছে রোগ। ভালোভাবে দেহের সচলতা না থাকায় ধীরে ধীরে শরীরে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
নাগরিক জীবনে কায়িক এবং মানসিক শ্রম দিনে দিনে এত কমছে যে, খাদ্যভাসের সঙ্গে শরীরে পরিবর্তন আনছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে ব্যায়াম এবং পুষ্টিকর খাবারের দিকে নজর দিতে হবে। কায়িক পরিশ্রম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভাজা পোড়া খাবার পরিহার করতে হবে। পর্যাপ্ত পানি পান, ঘুম, ব্যায়াম প্রভৃতি নিয়ন্ত্রিত জীবনাচারনের মাধ্যমে এসব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে নারীদের সচেতনতা বিশেষভাবে জরুরি। নিজেকে এবং পরিবারকে সুস্থ রাখতে তাই জীবনযাপনে নিয়ন্ত্রণ আনা জরুরি।