নারীর বাহ্যিক রূপই কি সব
সমাজে নারী যতই শিক্ষা-দীক্ষায় শিক্ষিত-দীক্ষিত হয়ে উঠুক, পুরুষতন্ত্র ততই তার জন্য নতুন নতুন ফাঁদ তৈরি করে। এরমধ্যে একটি হলো নারীর রূপ বা বাহ্যিক সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্যের ফাঁদে ফেলতে নারীর জন্য পুরুষতন্ত্র আয়োজন করেছে সুন্দরী প্রতিযোগিতার মতো বাণিজ্যিকও কর্মযজ্ঞও। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সচেতন নারী প্রতিনিধিরা বলছেন, নারীর বাইরের রূপই আসল নয়। নারীর বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞাই হলো নারীর সৌন্দর্যের আসল পরিচায়ক।
আইনজীবী আফরোজা ফেরদৌসী বলেন, ‘নারী মানেই তার রূপের ওপরেই গুরুত্ব পায়। না হলে তাকে মূল্যায়ন করা হয় না। একজন নারী তার বাবা-মায়ের কাছে যখন থাকে, সে তার পরিবারের সদস্যদের সমস্যা সমাধান করে, নিজের খারাপ ভালো না ভেবে সবাইকে সামলে নেয়। বিয়ের পর একটা অজানা অচেনা সমাজ, সংসার, নতুন একটা পরিবার, তাদের ভালো রাখার চেষ্টা করে। তাদের পছন্দটাকে নিজের করে নেওয়ার চেষ্টা করে যায় অবিরত। সব সময় কেবল সবাইকে খুশি করার চিন্তা। এই সবকিছুই কি সৌন্দর্যের জন্য?’
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘এই গুণগুলো একটা নারীর ভেতরেই বিদ্যমান। একটা মেয়ে যেভাবে তার ঘর সামলাতে জানে ,তেমনি বাইরেরটাও সামলায় । এর কোনো কিছুই তো রূপের জন্য নয়। এগুলো তার মেধা আর বুদ্ধির পরিচয় দেয়। কিন্তু সমাজ সংসার সবখানে শুধু কে বেশি সুন্দরী, সেটা বিচার করে তাকে মূল্যায়ন করে। যখন রূপ থাকে না, তখন আর কথা কাজ কোনোটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই বিষয়গুলো নেহায়েত সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়। আর কিছুই না।’
আফরোজা ফেরদৌসী বলেন, ‘নারী মায়ের জাতি। যার রূপ আছে সেও মা, যার নাই সেও মা। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলেই নারীর বাহ্যিক রূপ আর গুরুত্ব পাবে না। তখন রূপের পেছনে গুণটা সামনে আসবে। সবার কাছে সম্মানিত হবে নারীর সমাজ-জীবন, সংসার।’
অভিনেত্রী ও অ্যাক্টিভিস্ট মেহেরান সানজানা বলেন, ‘নারীর সবকিছুতেই পুরুষের বিদ্বেষ। এই বিদ্বেষ তৈরি করে দেয় সমাজ, পরিবার। ছোট থেকে একটা ছেলে বাচ্চার মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় নারীবিদ্বেষ। এর পেছনে রাষ্ট্রও আছে। যেমন, একটা ছেলে যখন শুধু বয়েজ স্কুল, বয়েজ কলেজে পড়াশোনা করবে, তখন সে একটা মেয়ের কোনোদিকই ভালোভাবে নিতে পারবে না। কারণ সে ছোট থেকে মেয়েদের থেকে আলাদা থেকেছে। পরিবারে মা, খালা, বোন, নানি, দাদি ছাড়া কাউকে সে দেখেনি। কাউকে বোঝেওনি। এটা হলো এক শ্রেণির পুরুষের মনোভাব।’
এই অভিনেত্রী আরও বলেন, ‘আরেক শ্রেণি হলো, ধর্মান্ধ। তারা নারীকে হরেকরকম বোরখায় মুড়িয়ে রাখতে চায়। নারীর সব কিছু তাদের কাছে পাপ। অথচ, জন্ম নিয়েছে এক নারীর নাড়ি ছিঁড়ে। আসলে বাঙালি পুরুষজাতি সেক্সুয়াল ফ্রাসট্রেশনে ভোগে যার কারণে নারীর সাজ, পোশাক দেখলেই সিডিউস হয়ে যায়।’
সাহিত্য বিশ্লেষক ও অ্যাক্টিভিস্ট লাবণী মণ্ডল বলেন, ‘শুধু নারী নয়, যে কোনো মানুষকেই তার বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে বিচার করা যায় না। বাহ্যিকতায় যেমন ভেতরের মানুষটা ঢাকা পড়ে যায়, তেমনি তা ক্ষণস্থায়ীও। মানুষ বাঁচে তার চিন্তার মাঝে। চিন্তা অসুন্দর হলে সেই মানুষটি বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে খুব বেশি সময় ভেতরের সত্তাকে আড়াল করতে পারে না। তার কুৎসিত চিন্তা সামনে আসবেই, আজ নয়তো কাল।’
লাবণী মণ্ডল আরও বলেন, ‘আবার দৈহিক সৌন্দর্যও নির্ধারণ করে দেয় করপোরেট প্রচারমাধ্যম। মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, সাদা ভালো, কালো মন্দ। সৌন্দর্যের সংজ্ঞায় তুলে ধরা হয় ৩৬-২৪-৩৬ শরীরের মাপ। যেখানে ফ্যাশনের নামে চলে প্রসাধনী আর পোশাকের রমরমা ব্যবসা।’ তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নারীকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসা বা তার কাজের মজুরি দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখলেও তা নারীকে প্রকৃত অর্থে মানুষের মর্যাদা দেয়নি। বরং পুঁজিবাদ নারীকে দুইভাবে পণ্যায়িত করেছে। এক. তাকে কথিত সৌন্দর্যের সংজ্ঞায় পণ্যে পরিণত করে; দুই. স্বাধীনতার নামে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা, তথা যৌনতাকে ব্যবসায়ে পরিণত করে।’
এই সাহিত্য বিশ্লেষক-অ্যাক্টিভিস্ট বলেন, ‘এখন অবশ্য পুরুষদেরও একই ঢঙে পণ্যায়িত করার রেওয়াজ চালু হয়েছে। প্রসঙ্গত,যৌনতা যেকোনো মানুষের সাধারণ একটি জৈবিক চাহিদা। তাকে অন্যান্য চাহিদার মতোই পণ্যে পরিণত করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা।’ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের এ ভূখণ্ডে প্রবাদ-প্রবচনের একটা বড় অংশেও পুরুষতান্ত্রিকতার প্রকাশ সুস্পষ্ট। ‘প্রথমে দর্শনধারী, পরে গুণ বিচারী’ কথাটি তারই বহিঃপ্রকাশ। যে পশ্চাৎপদ রক্ষণশীলতায় কার্যত নারীদের যৌনবস্তু হিসেবেই মূল্যায়ন করা হয়েছে। এখানে আজও ‘খনা’দের জিভ কেটে নেওয়ার মানসিকতা সমহিমায় বিরাজমান। যার প্রকাশ ঘটে কখনো টিপ পরা নিয়ে বিতর্ক হাজির করে; কখনো বা নারী-বিদ্বেষী মূল্যায়নে। কার্যত এসবই আমাদের সমাজের বর্তমান বাস্তবতা। যেখানে নারীকে কখনো ঘরে আটকে, পা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ঢেকে শালীনতা দেখানো হয়; আবার কখনো নারীর শরীর দেখিয়ে, তাকে পণ্যায়িত করা হয় স্বাধীনতার নামে। কার্যত এ দুটোই নারীর বাহ্যিকতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। যেখানে শরীরই পায় প্রাধান্য, ওই নারীর সত্তা হয়ে পড়ে নিতান্ত নগণ্য।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাবেক শিক্ষার্থী, ইমরুজা আকতার বলেন, ‘মানুষ মাত্রই সৌন্দর্যের পূজারী। কবির কবিতা,গায়কের গান,লেখকের উপন্যাস বা গল্প সব কিছুতে প্রাধান্য পায় নারীর সৌন্দর্য। তবে একজন নারী কেবল এলোকেশেই নারী নয়। নারী মানে শুধু শারীরিক সৌন্দর্য নয়। নারী মানে অনন্যাও।’ তিনি বলেন, ‘একুশ শতকে দাঁড়িয়ে আমরা এখনো যদি নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্যকে সব বলে মনে করি, তবে নিজেদের এক শতকের দাবি করাটা বোকামির সামিল।’
ইমরুজা আকতার বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে নারীর পদচারণা নেই। বাংলাদেশ হোক বা পুরো পৃথিবী, নারীর অবদান সর্বক্ষেত্রে, সব জায়গায় রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ কিন্তু তার সৌন্দর্য দিয়ে নয় বরং তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ৭ দশক ব্রিটেন শাসন করেছেন। কমনওয়েলথের বেশ কিছু দেশের প্রধানও ছিলেন তিনি। এটা কিন্তু তার রূপ-গুণে হয়নি,হয়েছে কর্মগুণে।’
নারীরাও দেশ পরিচালনা করছেন উল্লেখ করে ইমরুজা আকতার বলেন, ‘নারী আকাশ ছুঁতে পারে,জয় করতে পারে সর্বোচ্চ পর্বতমালা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। সে দেশের বর্তমান প্রসিডেন্ট একজন সাঁওতাল নারী। যিনি গায়ের রঙে নয়, বুদ্ধিমত্তা দিয়েই তার এই অবস্থান অর্জন করেছেন। নারীর বিচরণ কোথায় নেই বলুন তো?’ তিনি আরও বলেন, ‘সৌন্দর্যের যে সংজ্ঞা আমরা নিজেদের জীবনে দাঁড় করিয়েছি, তা পরিবর্তনের সময় চলে এসেছে। সৌন্দর্য মানে শুধু শারীরিক বা বাহ্যিক নয়। সৌন্দর্য মানে হলো একজন নারীর বুদ্ধিমত্তা বা স্মার্টনেস। এই স্নার্টনেস বা বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নারী তার শারীরিক সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে পারে। এজন্য নারী লম্বা না খাটো,কালো না ফর্সা এটা বিবেচনার প্রয়োজন নেই। নারী সব অবস্থাতেই অনন্যা। নারীর সৌন্দর্য সর্বক্ষেত্রে। কর্মক্ষেত্র,পরিবার, স্বামী, সন্তান সব কিছুতে নারী সাবলীল এবং সুন্দর। আর এ সব কিছু অর্জনের জন্য নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্যের আলাদা করে কোনো প্রয়োজন নেই।’