খ্যাতিমান নারীর মৃত্যুর খবরেও স্বামীর পরিচয় মুখ্য কেন
আমাদের সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন আজও হয়নি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর নিজের কোনোই পরিচয় নেই। অর্থাৎ নারীর নিজস্ব পরিচয় থাকলেও তা নগণ্য করেই দেখা হয় আজ অবধি। যদিও সেই নারী অতি যোগ্যতাসম্পন্ন-শ্রদ্ধেয় এবং একইসঙ্গে বিখ্যাত হন; তবু এ সমাজ নারীর পরিচয় তুচ্ছ করে দেখে। নারীর পরিচয় এতটাই নগণ্য হয়ে ওঠে, এ সমাজের কাছে ফলে নারীর নিজের পরিচয় বা আত্মপরিচয়কেও তুলে ধরতে চান না কেউ।
এমনকি যারা একটি সমাজের পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম বা পরিবর্তনের পথে হাঁটতে মানুষকে সাহায্য করে সেই মিডিয়া বা গণমাধ্যমও নারীর পরিচয়কে তুচ্ছ করে। এর আগেও বিভিন্ন খ্যাতিসম্পন্ন নারীর মৃত্যুতে কার মা, কার স্ত্রী, কার বোন এসব বিবিধ পরিচয়ে শিরোনাম করা হয়েছে নারীর মৃত্যকে ঘিরে! কিন্তু নারীকে তার নিজস্ব পরিচয়, নিজের শ্রম-সাধনা-মেধা দিয়ে গড়ে তোলা পরিচয়কে তুচ্ছ করা হয়েছে! নারীর নিজস্ব পরিচয় ঢাকা পড়েছে স্বামী-সন্তান-ভাইয়ের পরিচয়ের কচকচানিতে!
প্রসঙ্গটির অবতারণা করা হলো এ কারণে যে, গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান অধ্যাপক পান্না কায়সার (৭৩)। পান্না কায়সার বাংলাদেশের একজন ঔপন্যাসিক, গবেষক ও জাতীয় সংসদের সাবেক সংসদ সদস্য। খেলা ঘরের সদস্য ও পান্না কায়সারকে দেখভালের দায়িত্বে থাকা আবুল ফারহা পলাশ আজকের পত্রিকাকে জানান, পান্না কায়সার রাতে গুলশানে মেয়ের বাসায় ছিলেন। সকালে শরীর খারাপ লাগলে তাঁকে গুলশান ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে সকাল ৮টার দিকে মারা যান পান্না কায়সার।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শহীদুল্লাহ কায়সারকে তাঁর বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। এরপর তিনি আর ফেরেননি। এরপর থেকে পান্না কায়সার একাই মানুষ করেছেন তাঁর দুই সন্তান শমী কায়সার ও অমিতাভ কায়সারকে।
১৯৯৬-২০০১ সালের জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন পান্না কায়সার। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা, গল্প-উপন্যাস মিলিয়ে বেশ কয়েকটি সাড়া জাগানো গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় অবদান রাখায় ২০২১ সালের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন পান্না কায়সার। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে পান্না কায়সারের পদচারণা সত্যিই অবিস্মরণীয়। তবু তার মৃত্যুতে একশ্রেণির উজবুক শ্রেণি তাকে শহীদজায়া, শমী কায়সারের মা, শহীদুল্লাহ্ কায়সারের স্ত্রী বলেই তাঁর নিজস্ব পরিচয়কে ঢেকে দিয়েছেন! যেন এর বাইরে এই মহীয়সী নারীর সব পরিচয়ই ম্লান! বিবর্ণ-ধূসর! কিন্তু কেন? পুরুষতান্ত্রিক শাসন-শোষণে নারী আর কতকাল নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে সক্ষম হবেন না!
পান্না কায়সার সংসার জীবনে আবদ্ধ না থেকে দায়িত্ব নেন লাখো-কোটি শিশু-কিশোরকে সোনার মানুষে পরিণত করার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত দেশের বৃহত্তম শিশু-কিশোর সংগঠন ‘খেলাঘর’র সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন ১৯৭৩ সালে। ১৯৯২ সাল থেকে সংগঠনের সভাপতিমণ্ডলীর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ফলে তাঁর একাধিক পরিচয় আছে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার জন্য! সন্তান-স্বামীর পরিচয়ে তাঁর নিজের সারাজীবনের সাধনালব্ধ অর্জনকে তুচ্ছ করে তোলার মানে হয় না!
পুরুষতান্ত্রিকতার অবসান হোক। নারী তাঁর আপন পরিচয়ে পরিচিত হোন। সবার মধ্যে বোধদয় ঘটুক। বিশেষত গণমাধ্যম কর্মীদের মানবিক মনোভাবই একটি সমাজের গতিধারা পরিবর্তনে বিশেষভাবে সক্রিয়। ফলে তাদের মধ্যে থেকে পুরুষতান্ত্রিক হিপোক্রেসি দূর হোক। মানবতার জয়গানে মানুষকে মানুষ হিসেবে সলবীকার করার দীক্ষা গ্রহণ করুক। মহীয়সী রমণী পান্না কায়সার আমাদের মাঝে আজীবন অমলিন থাক তাঁর কর্মগুণে।