হেলেন কেলারের জীবনের গল্প
বিখ্যাত কবি জন মিল্টন চোখে দেখতে না পেরেও রচনা করেছেন প্যারাডাইস লস্ট। মেয়ের সাহায্যে তিনি রচনাটিকে লেখার রুপ দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিনি তো কথা বলতে পারতেন। যিনি কথা বলতে পারেন তার পৃথিবী অন্ধকার হলেও কিছুটা আশার আলো আছে। কিন্তু জীবন যারা ভাষাহীন, শব্দহীন ও পৃথিবী যার কাছে দৃশ্যমান নয় তার জীবন কেমন?
নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে মানবীয় অনুভূতি কিংবা স্পর্শগ্রাহ্য রুপের পরিচয় তার কখনই নেই। আর চারপাশের মানুষের কাছে এই অস্তিত্বহীনতা চরম অভিশাপ। কিভাবে এই রুদ্ধ দুয়ারেই মানুষ প্রবেশ করবে? চরম একা সেই মানুষ। কিন্তু এই অসহায়ত্বকে জয় করে সমগ্র পৃথিবীতে নিজেকে ভাস্বর করতে পেরেছিলেন এক নারী। নাম হেলেন কেলার। কানে শুনতে পেতেন না, চোখে দেখতে পেতেন না, কথা বলতে পারতেন না। অথচ নিজেকে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠা করেছেন সাহিত্যিক ও মানবতাবাদি হিসেবে। সাহিত্য রচনার পাশাপাশি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অসহায় প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিকলাঙ্গ, পঙ্গু মানুষদের জুগিয়েছেন অনুপ্রেরণা। অথচ জীবনের শুরুতে একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবেই বেড়ে উঠতে পারতেন। কিন্তু জীবনের মোড় যেকোনো সময় ঘুরে যেতে পারে।
১৮৮০ সালের ২৭ জুন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাব্যামা তাসকাম্বিয়া গ্রামে হেলেনের জন্ম। বাবা আর্থার কেলার সামরিক বিভাগের অফিসার। মা কেইট এডামসই ছিল তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। শৈশবে ভারি দুরন্ত হেলেনের জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি এক বছর সাত মাস বয়সে ঘটে যাওয়া এক দূর্ঘটনায়।
গোসল করাচ্ছিলেন মা। এমন সময় মায়ের কোল থেকে অসাবধানতাবশে পরে যান হেলেন। সাময়িক আঘাতে জ্ঞান হারান হেলেন। কিছুক্ষণ পর সেই জ্ঞান ফিরে এলে মায়ের বুকে স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু সেই স্বস্তিও বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারে নি। লক্ষ্য করলেন তার আদরের সন্তান কানে শুনতে পাচ্ছে না। আবার কিছু দেখতেও পাচ্ছে না। এই সময়ে স্বামীকে ডেকে দুজন ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানালেন মস্তিস্ক ও পাকস্থলীর আঘাতের কারণে এই সমস্যা হয়েছে। এভাবেই চিরতরে অন্ধকার ও শব্দহীনতার অভিশাপ আকড়ে ধরে হেলেনকে।
এই বিপর্যয়ে ব্যথীত দম্পতি সন্তানের দিকে মনোযোগী হন। ছন্নছাড়া হয়ে ওঠা বাবা আর্থারের সঙ্গে ওয়াশিংটনের আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের দেখা হয়। নামটি দেখেই চিনে ফেলেছেন বোধহয়? মূলত পরামর্শের জন্যেই আর্থার বেলের কাছে যান। বেলের রায়ও ঠিক চিকিৎসকের মতোই। এই সময় বেল লক্ষ্য করলেন হেলেনের বুদ্ধিমত্তা তীক্ষ্ণ। আর্থারকে বললেন অন্ধ ও বধির হলেও হেলেন একটি সুন্দর জীবন-যাপন করতে পারে। তাকে যথাযথ প্রশিক্ষণ যেন দেওয়া হয়। তিনিই বললেন হেলেনকে যেন বোস্টনের পার্কিনস ইনস্টিটিউশনে ভর্তি করানো হয়। এই প্রতিষ্ঠানে অন্ধদের শিক্ষা দেওয়া হয়। ডাক্তার হো এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। হেলেনকে ডাক্তার হো সাদরে গ্রহন করেছিলেন। তার অধীনেই হেলেনের পাঠে হাতেখড়ি। কিন্তু হেলেনের জীবনে যেন বারবার অদৃশ্য খড়গ নেমে আসছে। অকস্মাৎ ডাক্তার হো মারা গেলে হেলেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আবার চিন্তায় পড়েন বাবা-মা।
এমন সময় পার্কিনস ইনস্টিটিউটের নতুন ডিরেক্টর হন মাইকেল এ্যাগানোস। হেলেনের কথা তিনি জানতে পেরেছিলেন। সব শুনে অ্যানি সুলিভ্যান ম্যানসফিল্ড নামে এক শিক্ষয়িত্রীকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। অ্যানির সঙ্গে তার জুঁটিটি মিলেছিল। অ্যানি নিজেও চোখে কম দেখতেন। পার্কিনস ইনস্টিউটিউশনের সাহায্যে তার চোখে দুবার অপারেশন শেষে স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে পেয়েছিলেন। সেই যন্ত্রণা বুঝতেন বলেই হেলেনের প্রতি তার মমতা ছিলো।
অ্যানির সহায়তায় হেলেন স্পর্শের মাধ্যমে পৃথিবীকে চিনতে শুরু করেন। আলোর ছোঁয়া ও অন্ধকারের স্নিগ্ধতার অনুভূতির তফাৎ ঠিকই বোঝাতে পেরেছিলেন। এইতো কল ছেড়ে দিয়ে হাতের ওপর বয়ে যাওয়া তরলকে ‘পানি’ বলে চেনালেন। হেলেন যুগপৎ অবাক। একে একে স্পর্শের মাধ্যমেই সবকিছু চিনতে শিখলো হেলেন। অবশেষে লুই ব্রেইল আবিষ্কৃত ব্রেইলের মাধ্যমে লেখাপড়া শিখতে শুরু করেন হেলেন। কয়েক বছরেই হেলেন কয়েকটি ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন যা তখনকার সময়ে অনেকের মনেই বিস্ময় জাগাতে সক্ষম হয়েছিল।
পরবর্তীতে ব্রেইল টাইপরাইটারে লেখার দক্ষতাও হেলেন অর্জন করেছিলেন। শেখার জন্যে তার আগ্রহ ছিল অনেক। এগার বছর বয়সে তিনি এক বিশেষ পদ্ধতিতে কথা বলার চর্চা শুরু করেন। ধিরে ধিরে চিকিৎসার মাধ্যমে তার বাকশক্তি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
বিশ বছর বয়সে হেলেন নিজেকে এক অসামান্য প্রতিভা হিসেবে মেলে ধরেন। সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাসে নিজের দখল গড়ে নেন। র্যাডক্লিফ কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়ার সময়েই লিখেন ‘অপ্টিমিজম।’ নিজের আত্নজীবনীমূলক এই বইয়ে তিনি নিজের যন্ত্রণার কথা বলেছেন। চার বছর পর তিনি সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে বিএ পাস করেন। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর লিখেন ‘দ্য স্টোরি অব মাই লাইফ’ নামে আরেকটি বই। এই বইয়েই জীবনের বিপর্যয়, লড়াই, অ্যানির সখ্যতা সবকিছুই তুলে ধরেন। এই বইটি তাকে রাতারাতি খ্যাতি এনে দেয়।
জীবনের নানা চড়াই উতরাই পার করে তার কর্মজীবন শুরু করেন সাংবাদিকতায়। সাহসিকতা প্রদর্শনে ভীত ছিলেন না অ্যানি। ঐ সময় র্যাডিকেল পার্টির কর্মকর্তা মি. ম্যাকির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন হেলেন। অ্যানির জীবনে এক চিলতে রোদ আসছে। কিন্তু রাজনৈতিক প্ররোচনা সবসময় নারীকে কোণঠাসা করেছে। অ্যানি ও হেলেনের লেখার নামে বিভিন্ন সমালোচনা ও কুৎসা ছড়াতে শুরু করে। হেলেন এমন অবস্থা দেখে ভাবলেন সাংবাদিকতা করবেন না। বরং এবার গেস্ট স্পিকার হয়ে যা আয় করবেন তাতে জীবনধারণ করবেন। রাজনৈতিক সমস্যার জেরবারে অ্যানির সংসারও ভেঙে গেল। আবারও অ্যানি আর হেলেন একে অপরের ছায়াসঙ্গীনি। বিভিন্ন মঞ্চে তারা বক্তৃতার আয়োজন করতেন। বক্তৃতার সুক্ষ্মতা ও চিন্তার গভীরতা মানুষকে মুগ্ধ করতো বলেই তার জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে। দিনকে দিন তার ভক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
হেলেন প্রচন্ড রাজনীতি সচেতন ছিলেন। নারীদের হক আদায়ে তিনি সোচ্চার ছিলেন সবসময়। এমন সময়ে আবার এক সমস্যা দেখা দেয়। অ্যানির দৃষ্টিশক্তি হারাতে শুরু করে। কিছুদিন পর তিনি আবার অন্ধ হয়ে যান। হেলেনের ওপর এবার বাড়তি চাপ। সাহায্যের জন্যে তিনি গেলেন গ্রাহাম বেলের কাছে। বেল এই মেয়েকে ভীষণ স্নেহ করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে বিশ্বভ্রমণের বাতিক ছিল তার। অ্যানি আর হেলেনকে সফরসঙ্গী করে ইউরোপ গেলেন। এবার বিশ্বকে আবার নতুন করে জানার সুযোগ এলো। নিজ প্রতিভা দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুরাগীর সংখ্যা বাড়িয়েছেন হেলেন। এমনকি একসময় অভিনয়ের প্রস্তাবও পান তিনি। বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অভিশপ্ত বিড়ম্বনা ও বিষাদকে কেন্দ্র করে নির্মিত ‘ডেলিভারেন্স’ সিনেমায় অভিনয় করেন হেলেন।
কানে ভালো না শুনলেও সঙ্গীত উপভোগ করতে পারতেন হেলেন। এই আশ্চর্য ক্ষমতা অবাক করতো অনেককেই। গায়ক-গায়িকার কন্ঠে হাত রেখেই বলতে পারতেন তার পরিচয়। দৃষ্টিহীন হলেও নৌকা বাইতে পারতেন, সাতার কাটতে জানতেন। ১৯২২ সালে ডাক্তার বেল মৃত্যুবরণ করতে হেলেন বেলের প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। ১৯৩৫ সালে অ্যানি সুলিভানের মৃত্যু সহজভাবে নেন নি হেলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে যুদ্ধাহত প্রতিবন্ধীদের জন্যে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গরে তুলেছিলেন। তার প্রতিভার স্বীকৃতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গও দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও হেলেনের সুসম্পর্ক ছিল। হেলেনের সুখ্যাতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। জীবনে প্রায় ১১ টি বই লিখেছেন তিনি। ১৯৫৯ সালেই জাতিসংঘ কর্তৃক বিশেষ সম্বর্ধনা পান তিনি। এমনকি প্রতি বছর ২৭-জুন হেলেন কেলার দিবস পালিত হয়। হেলেন কেলার আধুনিক সময়ে এক অনুপ্রেরণার নাম। যার সাহসিকতা, মেধা ও অর্জন সারা বিশ্বের সবার জন্যেই আদর্শ।
অনন্যা/এআই