Skip to content

২৪শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ৮ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কম্ফোর্ট উইমেন সম্পর্কে আমরা কতোটুকু জানি?

কম্ফোর্ট উইমেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি কালো অধ্যায়, যার ই ইতিহাস নিয়ে আজও অনেক বিতর্ক এবং
অজানা দিক রয়ে গেছে। এই নারীদের জীবনের করুণ কাহিনী, তাদের ওপর ঘটে যাওয়া অমানবিক নির্যাতন এবং যুদ্ধের সময় যে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা তারা ভোগ করেছেন, তা বিশ্ববাসীর সামনে ধীরে ধীরে উঠে এসেছে। তবে এখনো আমরা পুরোপুরি জানি না, তাঁরা ঠিক কতটা কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন করেছিলেন এবং যুদ্ধের সময় তাদের জীবনের কী ভয়ংকর পরিণতি ঘটেছিল। এই প্রবন্ধে সেই অজানা দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে, যা শুধু অতীতের ইতিহাস নয়, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের উদাহরণ হিসেবেও আজ স্মরণীয়।

কম্ফোর্ট উইমেন কারা ছিলেন?

কস্কোর্ট উইমেন বনতে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক যৌন দাসত্বে বাধ্য করা নারীদের বোঝানো হয়। ইতিহাস বলে, ১৯৩০-এর দশক থেকে শুরু করে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত জাপানি সামরিক বাহিনী এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২০০,০০০ নারীকে ধরে নিয়ে গিয়ে ‘কফোর্ট স্টেশন’ বা সামরিক যৌনপল্লীতে বন্দি করে রাখে। এই নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিলেন কোরিয়া, চীন, ফিলিপাইন, এবং ইন্দোনেশিয়ার নারীরা। তবে তৎকালীন জাপানের সাম্রাজ্যভুক্ত বিভিন্ন এলাকা থেকেও নারীরা শিকার হন, যাদের কেউ কেউ ছিল মাত্র ১৪-১৫ বছর বয়সী।
এই নারীদের জাপানি সামরিক বাহিনী এমনভাবে প্রলুব্ধ করে বা জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যেত, যাতে তাদের কোনো উপায় থাকত না। কখনো তাদের ভালো কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে যাওয়া হত, কখনোব্য সরাসরি আটক করে। এসব নারীকে জোর করে মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে রাখা হত, যেখানে প্রতিদিন তাদের উপর যৌন নির্যাতন চালানো হত।

যৌন দাসত্বের অন্তরালে মানবিক বিপর্যয়

যুদ্ধকালীন সময়ে সৈন্যদের মনোবল ধরে রাখা এবং সামরিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার অজুহাতে জাপানি সামরিক বাহিনী এই ‘কক্ষোর্ড স্টেশন’গুলো স্থাপন করেছিল। এই স্টেশনগুলো মূলত ছিল যৌনপল্লী, যেখানে নারীদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্যদের জন্য ‘কফোর্ট’ বা আরাম সরবরাহ করতে হত। তাদের কোনোরকম সম্মতি নেওয়া হয়নি এবং এই ব্যবস্থাটি ছিল মানবাধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন।
নারীদের উপর যে নির্যাতন চালানো হত, তা ছিল এক অমানবিক বাস্তবতা। প্রতিদিন শত শত সৈন্যের হাতে নির্যাতিত হওয়া এবং যন্ত্রণায় আক্রান্ত এই নারীরা প্রায়ই শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধান্ত হয়ে পড়তেন। তাদের অনেকেই যৌনরোগে আক্রান্ত হন, যার কারণে অনেকে অল্প বয়সেই মারা যান।

এই ইতিহাস নিয়ে আমাদের বর্তমান ধারণা

যদিও জাপান দীর্ঘদিন ধরে এই ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করে এসেছে, ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে বেশ কয়েকজন জীবিত কস্ফোর্ট উইমেন নিজেদের কাহিনী প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেন। তাঁদের জীবনের এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা প্রকাশ্যে আসার পর আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এরপর থেকেই ‘কম্বোর্ট উইমেন ইস্যুটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে শুরু করে। তবে দুঃখজনকভাবে, আজও জাপান সরকার পুরোপুরি দায় স্বীকার করেনি। ১৯৯৩ সালে ‘কোনো বিবৃতি’র মাধ্যমে কিছুটা দুঃখ প্রকাশ করা হলেও তা যথেষ্ট ছিল না।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে, এই নারীরা ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই চালিয়ে গেছেন, কিন্তু তাদের অধিকাংশই নীরবে, অপমান এবং লজ্জার বোঝা বইতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁদের সমাজ থেকেও অনেক সময় বঞ্চিত হতে হয়েছে, কারণ তাঁদেরকে সমাজের অনেকেই অপবিত্র মনে করত। ফলে বহু নারী তাদের পুরো জীবনটি এক অসহনীয় বোবা নিয়ে কাটিয়েছেন।

সমকালীন আন্দোলন ও স্মৃতিস্তম্ভ

এই নারীদের স্মরণে এবং তাদের ন্যায়বিচারের দাবিতে এখনো বিভিন্ন দেশে আন্দোলন চলছে। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, এবং ফিলিপাইনে এই ইস্যু নিয়ে সক্রিয় প্রচারণা চলছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং মানবাধিকার সংস্থা জাপান সরকারের কাছে এই নারীদের প্রতি ন্যায়বিচার দাবি করে আসছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল শহরে জাপানের দূতাবাসের সামনে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে, যা কফোর্ট উইমেনদের স্মরণে তৈরি করা হয়েছে। এটি বিশ্বজুড়ে কক্ষোর্ট উইমেনদের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক। এছাড়াও, কোরিয়ায় একাধিক জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে, যেখানে কক্ষোর্ট উইমেনদের কষ্ট এবং তাদের প্রতি করা অবিচার তুলে ধরা হয়েছে।

শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি

যদিও যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিশ্বজুড়ে অনেক গবেষণা এবং আলোচনা হয়েছে, তবে কফোর্ট উইমেনদের ইতিহাস এখনো অনেকের কাছেই অজানা। এ বিষয়ে শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে এমন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রতিহত করা যায়। বিভিন্ন দেশে এই বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি, সামাজিক এবং রাজনৈতিক পর্যায়েও এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
কফোর্ট উইমেনদের কাহিনী শুধু একটি জাতীয় বা সামরিক ঘটনা নয়, এটি একটি মানবিক বিপর্যয়। তাঁদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতন এবং অন্যায় আজও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, যুদ্ধ কেবল বিজয় বা পরাজয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না; এর সাথে জড়িয়ে থাকে হাজারো নিরপরাধ মানুষের কষ্ট এবং অসহনীয় দুর্দশা। আমাদের উচিত এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা দেওয়া, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। মানবাধিকার রক্ষা এবং যেকোনো ধরণের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের সোজার হতে হবে, এবং এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, ইতিহাসের এই কালো অধ্যায় যেন আর কখনো না ঘটে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ