Skip to content

১৯শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | মঙ্গলবার | ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কর্মক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে

শিক্ষা ও কিছু মৌলিক অধিকারে নারীর সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত হণেও এখনও কর্মসংস্থানে নারীরা পিছিয়ে। একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা এবং তার অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নারীদের অংশ গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। অনেক সময় তা অর্ধেকেরও বেশি। ফলে এই বিরাট একটি অংশের জন্য তাদের পারিপার্শ্বিকতার ভিত্তিতে সংবেদনশীল কর্মসংস্থান গড়ে তোলা জরুরি। এই জনসংখ্যা যদি পিছিয়ে পড়ে তাহলে কোনো দেশেরই প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব হবে না। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে দেশের নারী সমাজকে গুরুত্ব দিতে হবে।

জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) একটি অন্যতম লক্ষ্যমাত্রা হলো জেন্ডার সমতা অর্জন এবং নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়নকে গুরুত্ব দিয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার উদ্দেশ্যই হলো বিশ্বকে স্কুবা ও দারিদ্র্যমুক্ত করার পাশাপাশি সব ধরনের অসমতা ও বৈষম্য থেকে মুক্ত করা। নিজের অধিকার নিয়ে মানুষ ঘাতে সুন্দরভাবে, নিরাপদে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে, সেজন্য ২০১৬ সাল থেকে ২০৩০ সাল মেয়াদে এসডিজি অর্জনের সময়কাল ধত হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশ এই সময়কালে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে কাজ করে যাবে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে লিঙ্গ সমতার প্রতিচ্ছবি যা একটি দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন। নারীর ক্ষমতায়নের সাথে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা, অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ ইত্যাদি ধনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বর্তমানে এসব ক্ষেত্রে নারীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা গেলেও তা সন্তোষজনক নয়। বিশেষভাবে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের তুলনায় অতি নগণ্য। এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে। বর্তমানে প্রবন্ধে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বিশেষ করে শিক্ষিত নারীরা কেন কর্মক্ষেত্রে যেতে অনীহা প্রকাশ করে তার কারণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুত, প্রবন্ধের প্রধান লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নে শুধু শিক্ষিত নারী নয় বরং শিক্ষিত কর্মজীবী নারীর প্রয়োজন- সেই বিষয়টি তুলে ধরা।

লিঙ্গ বৈষম্য দীর্ঘকাল ধরে সমাজে বিদ্যমান। ফলে আমাদের সমাজে এর অনেক দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। নারীরা অবহেলিত হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নারীদের অংশগ্রহণ না থাকার কারণে সমাজে নারীরা বরাবরই অবহেলিত ছিল। যেমন- ভোটাধিকার। বিভিন্ন দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভোটাধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি থেকেও দীর্ঘ সময় নারীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত দেশে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নারীরা ভোটের অধিকার পায়। ভোটাধিকার পাওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক নেতৃত্বে নারীরা অনেক পিছিয়ে। বিভিন্ন দেশের সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব তুলনামূলক কম। রাজনৈতিক ক্ষেত্রের মতো নারীর ক্ষমতায়নে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ও হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ খুবই প্রয়োজন। সমাজে যথাস্থান অর্জন করতে হলে অবশ্যই সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে নারীদের পদচারণা থাকতে হবে। আর এক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারেন শিক্ষিত কর্মজীবী নারীরা।
বাংলাদেশে নারীশিক্ষার হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বপ্রথম দেশ হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা অর্জন করেছে। শুধু শিক্ষিত হলেই যে নারী লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হবে না তেমনটি নয়। আমাদের সমাজে এখনও পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকেই মর্যাদা দেওয়ার মানসিকতা প্রচলিত রয়েছে। তাই সমাজে অবদান রাখতে হলে নারীদের অবশ্যই ভার শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন তখনই হবে যখন নারীরা অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে কর্মক্ষেত্রের সর্বত্র অবাধ বিচরণ করবে এবং এর মাধ্যমে সার্বিক অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। কর্মক্ষেত্রে মেধার যথা-প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষিত নারী দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে। তাই দেশের টেকসই উন্নয়নে যে হারে শিক্ষিত নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হারে কর্মজীবী নারীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে হবে। আমাদের দেশে কর্মক্ষেত্রে শিক্ষিত নারীর অংশগ্রহণ কম হওয়ার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে।

নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নের জন্য দুটো শর্ত অবশ্য পূরণীয়। একটি হচ্ছে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন আর অনাটি হচ্ছে নারীর সামাজিক ক্ষমতায়ন। নারীর অর্থনেতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে জরুরি বিষয়গুলো হচ্ছে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কারিগরি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উত্তরাধিকার, সম্পদ, উপার্জনের সুযোগ ইত্যাদি। আমাদের দেশের নারীরা এখনও এসব ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। ফলে নারীদের কর্মক্ষেত্রে গমনে রয়েছে অনীহা। বিভিন্ন কারণে তাদের এই অনীহার সৃষ্টি হয়।

কর্মক্ষেত্রে নারীদের পিছিয়ে থাকার একটি অন্যতম মূল কারণ হলো প্রকৌশল ও প্রযুক্তিগত শিক্ষায় নারীর কম উপস্থিতি। এর পেছনে বেশ কিছু কারণও রয়েছে। যেমন আমাদের সমাজে এখনও এমন অনেক পরিবার রয়েছে, যেসব পরিবারের অভিভাবকরা ছেলেদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে যে ব্যয় করেন, মেয়েদের ক্ষেত্রে সে পরিমাণ ব্যয় করতে নারাজ। বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিভিত্তিক পড়াশোনায় ব্যয় তুলনামূলক বেশি, ভাই অভিভাবকরা চান মেয়েরা বিজ্ঞানে না পড়ে মানবিক বিষয়গুলোতে পড়বে।

নারীরা নির্দিষ্ট কিছু কর্মক্ষেত্রকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে বলে তাদের কাজের জায়গাগুলো আরও সংকীর্ণ হয়ে যায়। কাজের ক্ষেত্রে তারা কাজের ধরন, কাজের পরিবেশ ও কাজের স্থান বা দূরত্বকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। যেমন বেসরকারি চাকরির চেয়ে সরকারি চাকরিতে নারীদের আগ্রহ বেশি। আবার কিছু কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো নারীদের পছন্দের শীর্ষে যেমন- শিক্ষকতা। নারীরা ঢালেঞ্জিং পেশায় যেতে চায় না। পছন্দের পেশায় সুযোগ না হলে অনেক সময় তারা বেকার থেকে যায়।

শিক্ষিত নারীদের তাদের চিন্তাকে প্রসারিত করে সব ধরনের পেশার জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে। সরকারি চাকরিতে নারীদের আগ্রহের বিষয়টি বিসিএস পরীক্ষার ফল থেকে অনেকটা পরিলক্ষিত হয়।

মাতৃত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নারীদের উপর নায় থাকায় নারীরা পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে পর্যন্ত সময় দিতে পারে না। ফলে অনেক কর্মজীবী নারীকে সন্তান জন্মের পর কর্মজীবন আগ করতে হয়। এমনকি উচ্চ পর্যয়ের পেশায় নিয়োজিত নারীরাও অনেক সময় চাকতি ছেড়ে দেয় সন্তান জন্মদানের পর। কর্মস্থল অনেক সময় নারীদের এই উভয় দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করে না। ফলে নারীদের বাধ্য হয়ে কর্মক্ষেত্র ও মাতৃত্ব এ দুটোর যে কোনো একটিকে বেছে নেওয়ার মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। পরিবারের সদস্যরাও অনেক ক্ষেত্রে সাহায্যের হাত বাড়ায় না।

কর্মক্ষেত্রের কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যার ফলে কর্মজীবী নারীরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। এক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। এমনকি নারীদের বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হতেও দেখা যায়। কর্মক্ষেত্রের এসব সমস্যার কারণে নারীরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও অনেক সময় কর্মজীবনে প্রবেশ করতে ইচ্ছুক থাকে না। কিছু পেশা রয়েছে, যেখানে নারীদের শারীরিক ও মানসিক উৎপীড়নের শিকার হতে হয়। এই নেতিবাচক প্রভাবের কারণে নারীদের কর্ম-সন্তুষ্টি হ্রাস পায়, সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে, এমনকি চাকরি হারানোর মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। নারীদের কর্মমুখী করতে তাই কর্মক্ষেত্রগুলোর দায়িত্ব রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে সমস্যা থাকলে এর বিপরীত ঘটবে। আমাদের দেশে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যেমন, যানবাহনের অভাব, শৌচাগারের অভাব, শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রের অভাব, সর্বোপরি নিরাপত্তার অভাব। কিছু বেসরকারি চাকরি রয়েছে যেখানে নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটির সময়সীমা কম। এ ছাড়াও অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়। এসব কারণে নারীরা কর্মক্ষেত্রের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সঠিক প্রক্রিয়া, পরিবেশ ও কর্মক্ষেত্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা যায়।

নানা প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের নারীরা বর্তমানে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গ্রালেঞ্জ গ্রহণ করছে। নিজের ও পরিবরের অর্থনৈতিক নৈতিক নির্ভরতার জন্য বিভিন্ন পেশায় নারীরা নিজেদের নিয়োজিত করছে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের আগ্রহী করতে হলে। কিছু সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। যেহেতু একজন নারীকে মাতৃত্ব ও চাকরি দুদিক সামলাতে হয়, তাই তাকে এই সুযোগগুলো দিতে হবে।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ