প্রবীণ নারী সংসারের বোঝা নয়
সংসারে একে অন্যের পরস্পরের সহোযোগী। প্রত্যেক সদস্যই সংসারকে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করতে সাহায্য করেন। তবে, সংসার নামক প্রতিষ্ঠানের বটবৃক্ষ প্রবীণ সদস্যরা। গাছ যেমন ছায়া দান করে, একটি পরিবারে প্রবীণ সদস্যরাও তার অনুজদের পরামর্শ, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান দান, ভালোবাসায় সমৃদ্ধ করে রাখে। সংসারকে অটুট রাখতে সহয়তা করে। কিন্তু বর্তমান সমাজের রদবদল ঘটেছে। পরিবারে প্রবীণ সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা কমেছে। তাদের প্রতি মায়া-মমতা, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এখন আর তেমন চোখেই পড়ে না। যুগের যান্ত্রিকতা মানুষকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যার ফলে সম্পর্কগুলোতে কেমন একটা শিথিলতা এসেছে। যার ফলে সামাজিক নানা অবক্ষয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে জাতিকে।
সমাজে নারীরা আজও নির্ভরশীলভাবেই জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত। পরিবার, সমাজও তা চায়। নারীরাও অনেকটা বাধ্য হয়েই সেভাবেই অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ফলে সমাজের বাঁধাধরা নিয়ম মেনেই একসময় মেয়েরা বাবা-ভাই, স্বামী, ছেলের ওপর নির্ভর করে পথ চলতে শুরু করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একে একে আপনজনকে হারিয়ে তারা শেষ বয়সে এসে ছেলে-মেয়ের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
নারীদের যতই অগ্রগতি হোক না কেন সমাজের এই নিয়ম ভেঙে বের হওয়া বঙালি নারীর সংখ্যা হাতেগোনা। ফলে নারীর জীবন পরিচালনার পথে পাড়ি দিতে হয় একেককটি অধ্যায়। সেখানে থাকে অসংখ্য মানুষের আনাগোনা। কিন্তু কোথাও তারা নিজের স্বাধীন জীবন পালন করতে পারে না। শৈশব-যৌবনে বাবা-মায়ের শাসনে মেয়ে বড় হয় । তাদের মনোবাসনা থাকে মেয়ের জন্য রাজপুত্র আনবেন যে কি না, সব ইচ্ছে পূরণ করবেন। ঠিক আলাদীনের চেরাগের মতো। ফলে সে যাত্রায় পরিবারের সদস্যরা নারীকে খুব পোষমানা পাখির মতো প্রতিপালন করেন।
পরবর্তী এই নারীদের বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। বলা চলে শতভাগ শাসন-শোষণের কিঞ্চিৎ কম-বেশিও থাকে না। সংসার জীবনে সন্তান প্রতিপালন, সংসারের বোঝা কাঁধে নিয়ে এই অধ্যায়টিও নারীরা অবলীলায় পার করে দেন। তারপর আসে প্রবীণ বয়সে। যে বয়সে না থাকে শরীরে শক্তি সামর্থ্য আর না থাকে আর্থিক স্বচ্ছলতা। বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ নারীরই এরূপ পরিস্থিতি।
পাশে থেকে সহোযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের জীবনকে সহজ করে দিতে নেই সরকারি-বেসরকারি কোনো উদ্যোগ।
দীর্ঘ জীবনে নিজের জন্য মাথা গোঁজার ছাদটুকুও অনেকেই নিশ্চিত করতে পারেন না। যার ফলে প্রবীণ বয়সে হতে হয় ছেলে বা মেয়ের পরিবারের সদস্য৷ কিন্তু সেখানেও এই প্রবীণ নারীর প্রতি মানবিক আচরণ করা হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। কোনোরকমে সন্তানের কাছে একটু আশ্রয় পেলেও তার প্রতি দায়-দায়িত্ব, কর্তব্যের ব্যাপারে উদাসীন। পরিবারের সদস্যদের প্রতিও কোনোই অভিযোগ-অনুযোগের উপায় থাকে না এই বয়সে। ফলে দিনের পর দিন পার করতে হয় অসহয়নীয় জীবন। কিন্তু এই প্রবীণ বয়সী মা, দাদি, নানির হাত ধরেই তারা হাঁটতে শিখেছে। জীবনকে নিজের মতো পরিচালনা করতে শিখেছে।
ভালোবাসার অভাব, পারস্পারিক শ্রদ্ধার অভাবে দিন দিন আমাদের সমাজে প্রবীণ নারীরা অবহেলার শিকার হচ্ছেন। শারীরিকভাবে অসুস্থতা , অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, একাকীত্ব, হতাশা তাদের গ্রাস করে ফেলছে।
প্রবীণ নারীদের পুনর্বাসনের জন্য কোনোই উদ্যোগ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে আজও সঠিকভাবে নিশ্চিত করা যায়নি। বয়স্ক ভাতা দিলেও সবার জন্য তা প্রযোজ্য নয়। আবার যাদের জন্য প্রযোজ্য সেই নারীরাও শতভাগ পান না। ফলে সবার অলক্ষ্যে প্রবীণ নারীদের দুঃসহ জীবন কাটে।
পাশে থেকে সহোযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের জীবনকে সহজ করে দিতে নেই সরকারি-বেসরকারি কোনো উদ্যোগ। তাই একমাত্র ও বিশেষভাবে যারা পাশে থাকতে পারে পরিবার। প্রবীণ নারীদের বোঝা না মনে করে পরিবারের অভিজ্ঞ একজন সদস্য, ভালোবাসা, শ্রদ্ধার জায়গা থেকে সর্বোপরি কৃতজ্ঞতা পরায়ণ হয়ে তাদের প্রতিপালন করতে হবে।