Skip to content

৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ২০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তেভাগার রানীমা ইলা মিত্র

সাল ও তারিখটা ইতিহাসে বেশ স্পষ্ট। ১৯৫০ সালের, ৭ জানুয়ারি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আসছেন রানীমা। আসার পথে তিনি সাঁওতাল রমণীর ছদ্মবেশ নিয়েছেন। পথ দেখাচ্ছেন দলনেতা মাতলা সর্দার। সারা পথজুড়েই বিপদের আশঙ্কা। সিনেমার গল্পেও এমন ত্রাসের পরিবেশ দেখা যায়না।

 

সীমানা পার করার আগে রোহনপুর রেল স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষা। পাশেই পুলিশের চর হঠাৎ লক্ষ্য করে এক সাঁওতাল নারী শাড়িতে গুজে রাখা একটা ঘড়ি বের করে সময় দেখে নিলো। ব্যাস, ভারতে আর যাওয়া হয়নি রানীমার। তাকে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে আসা হয় নাচোল স্টেশনে। সাধারণ সাঁওতাল রমণী তো আর ঘড়ি ব্যবহার করবেনা। কি অদ্ভুত কথা! এবার পুলিশ স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্যে হেন নেই নির্যাতন করেনি – বুটের আঘাত, নগ্ন করে প্রহার, দিনের পর দিন ক্ষুধার্ত রেখে জিজ্ঞাসাবাদ এবং এক পর্যায়ে ধর্ষণও বাদ যায়নি।

 

সাঁওতাল শাড়ি আর স্থানীয় কথ্য ভাষার আড়ালেও নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারেনি রানীমা শুধু একটি ভুলের জন্য। কিন্তু পাশবিক নির্যাতন স্বত্বেও মুখ খোলেননি ইলা সেন। বলছি তেভাগা আন্দোলনের রানীমা ইলা মিত্রের কথা। কে এই রানীমা? আর কেন তাকে এমন নির্যাতন করা হয়? সেসব জানতে হলে একবার আমাদের জেনে নিতে হবে কিভাবে ইলা সেন হয়ে ওঠেন ইলা মিত্র।  

 

ব্রিটিশ সরকারের একাউন্টেন্ট জেনারেল নগেন্দ্র সেনের পিতৃসূত্রে বাড়ি যশোর। যদিও তাকে চাকরীসূত্রে কলকাতায় থাকতে হতো। ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর তার ঘরে এক কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। বাবা তার ঘরের এই রানীর নাম রাখেন ইলা, ইলা সেন। ইলা সেন লেখাপড়া করেন বেথুন স্কুল ও বেথুন কলেজে।

 

খুব ছোট থেকেই ইলা ছিলেন ছটফটে। সাঁতার, বাস্কেটবল ও অন্যান্য অনেক খেলাতেই তার পারদর্শীতা চমকে দিচ্ছিলো সকলকে। এরইমাঝে প্রথম বাঙালী মেয়ে হিসেবে ১৯৪০ সালের জাপান অলিম্পিকে ডাক পান। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্যে সে আসর আর বসেনি। সে নাহয় না হলো। ইলা সেনের ভবিষ্যৎ যেন দেশের রাজনীতিতেই। প্রথমেই তিনি হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে কলকাতা মহিলা সমিতির সদস্য হিসেবে আন্দোলন শুরু করেন।

 

১৯৪৫ সালে ইলা সেন রামেন্দ্র মিত্রকে বিয়ে করেন। সেখান থেকেই তার নাম ইলা মিত্র। রামেন্দ্র জমিদার বংশের সন্তান। কিন্তু মনেপ্রাণে ও কাজে একজন কম্যুনিস্ট। কিন্তু ইলা মিত্রের জন্যে যাত্রা সহজ ছিলো না। একে তো জমিদার বংশের বউ। তাই অন্দরমহলেই তাকে কাটাতে হয়েছে অনেকগুলো দিন। হঠাৎ রামেন্দ্র মিত্রের বন্ধু আলতাফ মিয়া তার জীবনে যেন এক পরিবর্তন নিয়ে এলো। বালিকা বিদ্যালয় গড়ে তোলার এই উদ্যোগ থেকেই জমিদার বাড়ির বধূ নাচোলের রানীমা হয়ে ওঠেন।

 

এরমাঝে হলো দেশভাগ। কিন্তু রামেন্দ্র মিত্রের পরিবার তখনো রয়ে গেলেন এখানে। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ এবং অনেক নেতাকর্মী ত্যাগ করলেন দেশ। সে হোক, ইলা মিত্র তখনো কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে করছেন তেভাগা আন্দোলন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এবার শুরু করে জুলুম। গ্রামের পর গ্রামে খাণ্ডবদাহন। ইলা মিত্র ও রামেন্দ্র মিত্র চণ্ডীগড় গ্রামে আত্মগোপন করেন। ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি পুলিশ গ্রামে হানা দিয়ে দুই কৃষককে গ্রেফতার করে। কিন্তু গ্রামের মানুষ তো উত্তেজিত। পুলিশ ভয় দেখিয়ে গুলি ছুড়ে। উত্তেজিত মানুষ ছয়জন পুলিশকেই হত্যা করে। এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলো সরকার। তারা পুলিশ ও মিলিটারি দিয়ে অভিযান শুরু করায়। অবশেষে ধরা পরে যান ইলা মিত্র। সেখানেই তাকে করা হয় পাশবিক নির্যাতন।

 

নিজের জবানবন্দিতে তিনি বলেন, "প্রচণ্ড তর্জন গর্জনে শব্দ শুনে চমকে উঠলাম, চেয়ে দেখি, হরেককে দলের মধ্য থেকে মারতে মারতে বার করে নিয়ে আসছে। ওদের মুখে সেই একই প্রশ্ন, বল, ইলা মিত্র সে-ই পুলিশদের হত্যা করবার আদেশ দিয়েছিল। না বললে মেরে ফেলব, একদম মেরে ফেলব। আমি চেয়ে আছি হরেকের মুখের দিকে। অদ্ভুত ভাববিকারহীন একখানি মুখ। অর্থহীন দৃষ্টিতে শূন্যপানে তাকিয়ে আছে। ওদের এতসব কথা যেন ওর কানেই যাচ্ছে না। ক্ষেপে উঠল ওরা। কয়েকজন মিলে ওকে মাটিতে পেড়ে ফেলল। তারপর বুট দিয়ে বুকে পেটে সজোরে লাথি মেরে চলল। আমাদের ছেড়ে চলে গেছে হরেক। আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। একটু আগেই আমি কেঁদেছিলাম। কিন্তু এখন আমার সমস্ত কান্না শুকিয়ে গেছে। তার পরিবর্তে ভিতর থেকে প্রচণ্ড একটা জেদ মাথা তুলে জেগে উঠেছে। আমার মন বলছে, মারুক, মারুক, ওরা আমাকেও এমনি করে মারুক। আর মনে হচ্ছে, এই যে আমাদের কয়েকশো সাথী এদের কাউকে দিয়ে ওরা কথা বলাতে পারবে না, কিছুতেই না। ওদের হার হয়েছে। ওদের হার মানতে হবে।"  

 

বন্দুকের বাঁট দিয়ে মাথায় আঘাত করা, দু’পায়ের মধ্যিখানে লাঠি রেখে চাপ দেওয়া, যৌনাঙ্গে গরম ডিম ঢুকিয়ে দেওয়া বাদ ছিল না কোনো পাশবিক অত্যাচারের পদ্ধতি। এমনকি গোড়ালিতে লোহার পেরেকও পুঁতে দিয়েছিল পুলিশ। শুধুমাত্র অদম্য জোরেই তিনি অস্বীকার করে গেছেন সকল অভিযোগ।

 

ইলা মিত্র নিজেকে সারাজীবন একজন বাংলাদেশীই কল্পনা করেছেন। দেশের মানুষের জন্যে তিনি অন্দরমহল ভেঙে বের হয়েছেন। অন্দরমহল থেকেই তিনি মানুষকে সেবা করেছেন। এমনকি অনেক কৃষককে জমি বিলিয়ে দিয়েছেন। নাহলে কি আর নাচোলের রানীমা হয়ে ওঠেন? এমনকি এই আন্দোলনকে তিনি ব্যর্থ হতে দিতে চান নি।

 

অবশেষে এই অত্যাচার থামে। মাওলানা ভাসা্নী সহ অনেকেই তার মুক্তির আন্দোলন করে চলেছেন। এবার অত্যাচার থামিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। রাজশাহী জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে কোনো সংকোচ না করেই এই ফ্যাসিবাসি অত্যাচারের বর্ণনা দেন। তবুও আন্দোলন উসকে দেয়ার অন্যায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় তাকে। এবার অনেক চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার তাকে প্যারোলে মুক্তি দেন। বাংলাদেশ ছেড়েই তাকে কলকাতায় যেতে হয়। সেখানে অবশ্য তাকে নাগরিকত্ব দেয়া নিয়ে ঝামেলা হয়। যদিও পরবর্তীতে রামেন্দ্র মিত্রের স্ত্রী হিসেবে তিনি নাগরিকত্ব পান।

 

রানীমা রাজনীতি থেকে একেবারে সরে যেতে পারেন নি। চারবার পশ্চিমবঙ্গের লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এমনকি ১৯৭১ সালে রামেন্দ্র মিত্র ও ইলা মিত্র কাজ করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্যে। নিজের সংগ্রাম ও নির্যাতনের মূলে যে অপশক্তি তাদের রোধে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। আজীবন নিজেকে বাংলাদেশিই ভেবেছেন। দেশের কল্যাণের জন্যে যে নারী নিজের নবজাতক সন্তানকে ফেলে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাকে কি হারানো যায়? তেভাগার রানীমা ২০০২ সালে কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু সেই নিঃশ্বাসের সুবাতাসে নারীকে বলে যান একটি কথা, নিজেকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাও। এই দেশ তোমায় ডাকবে, গ্রহণ করবেই। তাই তো তিনি রানীমা।

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ