Skip to content

১৩ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৮শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গৃহকর্মী থেকে গ্ল্যামার কুইন!

"কে বাবা কে মা দিয়ে কি হবে! আমার কাননবালা পরিচয়ই যথেষ্ট" এই উক্তিটি ভারতীয় সিনেমার গ্ল্যামার কুইন খ্যাত অভিনেত্রী কানন দেবীর। যাকে বলা হয় ভারতীয় সিনেমার প্রথম নায়িকা এবং বাংলা সিনেমার প্রথম সুপারস্টার। যিনি শূন্য থেকে নিজ যোগ্যতায় উঠে এসেছিলেন উচ্চতার শিখরে। বারংবার হোঁচট খেয়েও ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকার লড়াইয়ে শেষ হাসি হেসেছিলেন তিনিই। 

 

গৃহকর্মী থেকে গ্ল্যামার কুইন!

ছোটবেলায় লোকের বাসায় বাসায় কাজ করতেন কানন দেবী। সেখান থেকে নিজেকে ভারতীয় সিনেমা জগতে এতো পাকাপোক্ত ভাবে গেঁথে দেয়া নেহাত মুখের কথা নয়। অলিতে গলিতে লোকের ঘরে ঘরে কাজ করা সেই কাননবালা থেকে পর্দার সামনে লাল নীল জগতের কানন দেবী হয়ে ওঠার জন্য পার করতে হয়েছে একটি কঠিন অধ্যায়। তাঁর জীবনের গল্পই যেনো হার মানাবে গোটা একটি সিনেমার কাহিনীকে। 

 

গৃহকর্মী থেকে গ্ল্যামার কুইন!

 

১৯১৬ সালের ২২ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন তিনি। যদিও এই জন্ম পরিচয় নিয়েও রয়েছে নানান কথা। কারো কারো মতে কানন দেবীর জন্ম ১৯১৬ তে নয় বরং ১৯১২ তে৷ তবে আমরা নাহয় কাগজ-কলমের হিসেব ধরেই এগোই। কাগজে কলমে কানন দেবীর জন্ম ১৯১৬ সালের ২২ এপ্রিল। 

 

তাঁর বিভিন্ন আত্মজীবনীমূলক লেখা থেকে জানা যায়, তিনি ছিলেন একজন রক্ষিতার সন্তান। তাঁর মা রাজবালা দেবী ও তাঁর বাবা রতন চন্দ্র দাসের মধ্যে কোনো বৈধ বৈবাহিক সম্পর্ক ছিলোনা বলে জানা যায়। তাঁর বাবা রতন চন্দ্র দাস ছিলেন সওদাগর অফিসের কেরানি। তাঁর বাবার একটি ছোট দোকানও ছিলো। কাননদেবীর বাবা-মাকে নিয়ে নানান গুঞ্জন থাকলেও কানন দেবী এ বিষয় নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে চাননি। এ প্রসঙ্গে তিনি এমনও বলেছেন, "কে বাবা, কে মা, এই ভেবে বুকের ব্যথা বাড়িয়ে কাজ কি? আমি কানন, এই পরিচয়টুকুই তো যথেষ্ট।"  

 

গৃহকর্মী থেকে গ্ল্যামার কুইন!

 

নয় বছর বয়সে কাননের বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর কাননের মা তাঁর দুই কন্যাকে নিয়ে এক দূর সম্পর্কের আত্নীয়ের বাড়িতে রাঁধুনি ও ঝিয়ের কাজ  শুরু করেন। শোনা যায়, কাননদেবী প্রথমদিকে একটি স্কুলে ভর্তি হলেও আর্থিক অনটনের কারণে পড়াশোনার ইতি টানতে হয় তাঁকে। তাঁর বাবা তাঁকে গান শেখাতে চেয়েছিলেন। কানন দেবীরও সাধ ছিল গায়িকা হওয়ার। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর নিষ্ঠুর নিয়তি কানন দেবী আর তাঁর মাকে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে ফেলে দেয়। এরপর তিনি শুরু করেন লোকের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ। 

 

তবে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশের পরপরই নানান সময় তিনি হয়রানির শিকার হতেন। অভিভাবকহীন নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়ে হওয়ায় নানাভাবে তাঁকে অর্থের লোভ দেখিয়ে নগ্ন দৃশ্যে অভিনেয়ের জন্যে বাধ্য করা হতো। ১৯৩৫ সালে সতীশ দাশগুপ্তের বাসব দত্তা চলচ্চিত্রে তাঁর অনিচ্ছায় নগ্নতার প্রদর্শন ছিলো। এছাড়াও তাঁর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে পরিচালকেরা আর্থিকভাবেও তাঁকে ঠকাতেন।

 

গৃহকর্মী থেকে গ্ল্যামার কুইন!

 

১৯২৬ সালে জয়তিশ বন্দোপাধ্যায়ের জয়দেবে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে কানন দেবীর অভিনয়ের শুরু হলেও তাঁর সত্যিকারের অভিনয় জীবন শুরু হয় ১৯৩০ সালে। ১৯৩৫ সালে মুক্তি পাওয়া 'মানময়ী গার্লস স্কুল' এর মাধ্যমে তিনি নিজেকে চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর ১৯৩৭ সালে 'মুক্তি' চলচ্চিত্র তাঁকে সর্বপ্রথম অভিনেত্রী হিসেবে সফলতা এনে দেয়। 

 

গৃহকর্মী থেকে গ্ল্যামার কুইন!

 

তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য কিছু সিনেমা হলো, ঋষির প্রেম, প্রহলাদ, কংসবধ, বিষবৃক্ষ, পরাজয়, মুক্তি,  মেজদিদি ইত্যাদি। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি ভালো গানও করতেন। তাঁর গাওয়া জনপ্রিয় কিছু গান হলো-  আমি বনফুল গো, সে নিলো বিদায়, ফেলে যাবে চলে, জারা নেয়নো সে নেয়না, আব চান্দ না শরমায়ে ইত্যাদি। 

 

গৃহকর্মী থেকে গ্ল্যামার কুইন!

 

ওস্তাদ আলারাখা, পঙ্কজ মল্লিক, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, আখতারী বাই, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, দিলীপ রায়, নজরুল ইসলামের মতো এক এক জন মহান শিল্পীর কাছে গান শিখেছেন কানন দেবী। আরও পরিণত হয়েছে তাঁর কণ্ঠ। এমনকি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে গান শোনানোর অনুরোধ করেন। যদিও কোনো কারণে সে অনুরোধ রাখতে পারেননি কানন দেবী। 

 

গৃহকর্মী থেকে গ্ল্যামার কুইন!

 

একাধারে অভিনয়, নাচ, গান সমানতালে সব চালিয়ে গিয়েছেন কাননদেবী। সিনেমা জগতে প্রবেশের পরপর তাঁকে নানানভাবে ব্যবহার করা হলেও একসময় বেশ শক্তভাবে নিজের জায়গা তৈরি করেন এই নারী। একইসাথে নায়িকা, গায়িকা, প্রযোজক আরো কত কি৷ এসব কারণে তাঁকে বলা হতো ইন্ডাস্ট্রির জননী। 

 

এতোসব কিছুর জন্য তাঁর স্বীকৃতিও নেহাত কম নেই। ১৯৬৮ সালে চলচ্চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালে তিনি ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার পান। ১৯৯০ সালে তিনি সিনে সেন্ট্রাল কর্তৃক হীরালাল সেন পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯১ সালে কানন দেবী ‘ইন্দিরা গান্ধী স্মৃতি পুরস্কার’ পান। এগুলো ছাড়াও তাঁর ঝুলিতে আরো অনেক পুরষ্কার রয়েছে।  

 

গৃহকর্মী থেকে গ্ল্যামার কুইন!

 

জীবনের প্রথমদিকে নানান চরাই উৎরাই পার করে আসায় তিনি বুঝতে পারতেন অসহায় মানুষের কষ্ট। শেষ বয়সে তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন বহু অসহায় মানুষের। এগিয়ে এসেছিলেন বিভিন্ন সেবামূলক কাজে। দুস্থ বয়স্ক শিল্পীদের জন্য সর্বদাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রেখেছিলেন। ১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বেলভিউ ক্লিনিকে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ