কাবুলে দশ বছর পুরুষ বেশে ছিলেন নাদিয়া
নারীরা নারীদের বেশে থাকে আর পুরুষরা পুরুষদের বেশে থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক, তাইনা? কিন্তু নিজের জীবন বাঁচাতে আর পরিবার চালাতে তাকে নিতে হয়েছিলো পুরুষের বেশ। কারণ দেশে নারীদের বাড়ির বাইরে যাবার নিয়ম নেই। এর ব্যতিক্রম হলে হারাতে হবে প্রাণ। এজন্য পুরুষের পোশাকে ও পুরুষের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হয় তাকে। একদিন দুদিন বা দু এক বছর না, পুরুষ বেশে তাকে পার করতে হয় দীর্ঘ দশ বছর।
আপনারা হয়ত অনেকেই ইতোমধ্যে বুঝতে পেরেছেন কোন দেশের কথা বলছি। হ্যাঁ আফগানিস্তানের কথাই বলছি। আফগানিস্তানে এর আগে তালেবানদের উত্থানের সময় তাকে নিতে হয়েছিলো পুরুষ বেশ। তার পুরো নাম নাদিয়া গুলাম দাস্তগির। দীর্ঘ ১০ বছর ছিলেন পুরুষের বেশে। ২০১০ সালে নিজ দেশ থেকে পালাতে সক্ষম হলে তিনি তার আসল রূপে ফিরে আসেন পৃথিবীর সামনে।
নাদিয়ার জন্ম ১৯৮৫ সালে কাবুলে। তার জন্মের সময় আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ চলছিলো। সে সময় বোরকা ও হিজাব ব্যতীত নারীরা ঘর থেকে বাহির হওয়ার অধিকার পেতেন না। ছোট থেকেই নাদিয়া বুঝে গিয়েছিলেন তার দেশে বাঁচার অধিকার নেই নারীদের। চোখের সামনে যখন তখন মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটত। খুন, অঙ্গচ্ছেদ, ধর্ষণসহ সকল নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতে হতো নারীদের। আর মেয়েদের স্কুলে যাওয়া কা পড়ালেখা করার কথা তো ভাবাই যেত না। এমনকি পুরুষসঙ্গী ছাড়া বাড়ির বাইরেও যেতে পারতোনা তারা। ঘরের এককোণে পড়ে থাকতে হতো তাদের।
এরপর ১৯৯৩ সালে তালেবানের বোমা হামলা চালালে বোমা এসে পড়ে নাদিয়াদের বাড়িতে। বাড়ির এক অংশ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। তালেবান হামলায় মারা যায় নাদিয়ার ভাই। পরিবারের বাকি সবাই গুরুতর আহত হয়। হাসপাতালে দীর্ঘ দুই বছর চিকিৎসা নিতে হয় নাদিয়াকে। বিছানা থেকে উঠতেও পারতোনা সে। এরপর ১৯৯৬ সালে কাবুল পুরোপুরি তালেবানদের দখলে চলে যায়। দেশের সামাজিক অবস্থা পুরোপুরি বদলে যায় তখন। অনাহারের হাত থেকে পরিবারকে এবং তালেবানের অত্যাচার থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য পুরুষের বেশে সামনে আসেন নাদিয়া। মায়ের কথামতো মৃত ভাইয়ের পরিচয়ে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন সবার সামনে। তালেবানের হাত থেকে রক্ষা পেতে এছাড়া আর কোন উপায় তার সামনে তখন ছিল না।
১১ বছর বয়স যখন মেয়ে শিশুদের শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখার সময় তখন নিজের সত্ত্বা বিসর্জন দিয়ে পুরুষের বেশ ধারণ করতে হয় নাদিয়াকে। বাইরে গিয়ে কাজ নেন তিনি। কাবুলের একটি মসজিদে কর্মচারীর কাজ শুরু করেন তিনি। সেই উপার্জনের টাকা দিয়েই চলতো তার পরিবার। ছেলে হওয়ায় স্কুলে পড়ালেখারও সুযোগ পান তিনি। ১৬ বছর বয়সে স্কুলেও ভর্তি হতে পেরেছিলেন। পুরুষ বেশে তিনি যেই কাজগুলো করেছেন নারী রূপে থাকলে তিনি তা কখনোই পারতেননা। কিন্তু এভাবে আর কতদিন?
দিন যত যাচ্ছিলো তার অভ্যন্তরের নারী সত্ত্বা বের হয়ে আসতে চাচ্ছিলো। পুরুষের পরিচয় বয়ে নিয়ে যেতে যেতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন নাদিয়া নিজেও। ২০০৬ সালে আফগানিস্তানের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থার সাহায্যে কাবুল থেকে পালাতে সফল হন তিনি। চলে আসেন স্পেনে। সেখানে বেশ কিছু দিন তার চিকিৎসা নেয়ার পর একটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন ও সেখানেই থাকতে শুরু করেন। স্পেন আবার পড়ালেখা শুরু করেন তিনি। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন সেখান থেকে। ২০১৬ সালে ‘ব্রিজেস অব পিস’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থাও গড়ে তুলেছেন তিনি। তার সেই শরণার্থী শিবিরের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার সুযোগ করেছেন তিনি।
২০১০ সালে ২৫ বছর বয়সে তিনি পুরো পৃথিবীর সামনে আসেন। তবে নাদিয়ার পরিবার এখনো আফগানিস্তানেই আছে। আফগানিস্তানে পুনরায় তালেবান শক্তির উত্থানে নাদিয়ার মতো লক্ষ লক্ষ মেয়েকে কেবল নারী হওয়ার কারণে আবার শিকার হতে হচ্ছে কঠিন নির্যাতনের।