বাংলাদেশের প্রথম নারী ফটোগ্রাফার সাইদা খানম
ফটোগ্রাফ বা ছবি কার না পছন্দ। কিন্তু একটি সুন্দর ছবি তোলার জন্য একজন ফটোগ্রাফারকে অনেক দিকে খেয়াল রাখতে হয়। ছবি তোলাও একটি শিল্প। কি ভাবে ছবি হয়। কি ভাবে ছবি কাস্ট করতে হয়। কি ভাবে আলো কালার ঠিক রাখতে হয়। ফোকাস দৈর্ঘ কত থাকতে হয়। রঙ্গিন ফটোগ্রাফি কি ভাবে কালার পায়। কিন্তু তৎকালীন পূর্ববাংলায় কোনো নারী এই পেশায় ছিলোনা। ফটোগ্রাফারের ভূমিকায় কেবল পুরুষদেরই আধপত্য ছিলো। নারীরা হয়তো ফটোগ্রাফির দিকে তেমন আগ্রহও দেখায়নি। এর ব্যতিক্রম হলেন সাইদা খানম। ফটোগ্রাফির ওপর অগাধ ভালোবাসা থেকে বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসেবে তিনি ফটোগ্রাফি শুরু করেছিলেন।
নারী আলোকচিত্রীদের অনুপ্রেরণার নাম সাইদা খানম। শিল্পের প্রেমে উৎসর্গ করেছেন জীবনকাল। ক্যামেরা ও সাহিত্যকে ভালোবেসেছেন আমৃত্যু। আজ আমরা এই লড়াকু নারী সম্পর্কে জানবো।
১৯৩৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর পাবনায় তার জন্ম। তার বাবা আবদুস সামাদ খান এবং মা নাছিমা খাতুন। পৈতৃক বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। দুই ভাই, চার বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। বড় বোন মহসিনা আলী ছিলেন আর্ট কলেজের প্রথম মহিলা আর্টিস্ট। সাইদা খানমের ডাকনাম বাদল। শৈশব কেটেছে পাবনার ইছামতির তীরে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে। খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ছোটবেলা থেকেই। ১৯৪৯ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে ছবি তুলতে শুরু করেন সাইদা। এরপর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলতে থাকে তার চমৎকার কীর্তি যে সময়ে নারীরা ঘর থেকে বের হত না, ঠিক সে সময়েই তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন ক্যামেরা হাতে। ফ্রেমবন্দি করেছেন অসংখ্য দৃশ্য।
বাবা আবদুস সামাদ খান ছবি তোলার ক্ষেত্রে মাত্র দুটি বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। বিবাহ আসরে ও স্টেডিয়ামে গিয়ে ছবি তোলা সমর্থন করেননি। বাবার প্রথম নির্দেশটি পালন করতে পারলেও তিনি দ্বিতীয়টি মানতে পারেননি। স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলাধুলার ছবি তুলতেই হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে পুনরায় লাইব্রেরি সায়েন্সে স্নাতকোত্তর করেন। দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারিকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে সাইদা খানম তার ক্যামেরায় ধারণ করতে থাকেন সময় আর মানুষের মুখ, ইতিহাস আর জীবনের আখ্যান। তার ক্যামেরায় ধরা পড়েছে রুগ্ন শিশুকে স্নেহরত মাদার তেরেসা, অভিবাদন গ্রহণরত বঙ্গবন্ধু থেকে বিজয়ের বাংলাদেশে আনন্দিত মানুষের ছবি। দেখিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের নিহত হওয়ার নির্মম দৃশ্যাবলি। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষণের যে ছবি ইতিহাসের পাতায় দেখা যায়, সাইদা খানমই তা ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন।
‘বেগম’ পত্রিকার মাধ্যমে আলোকচিত্র সাংবাদিক হিসেবে ১৯৫৬ সালে কাজ শুরু করেন। এর আগে প্রেস ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। দুটো জাপানি পত্রিকাসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার তোলা আলোকচিত্র মুদ্রিত হয়েছে। তার ছবি ছাপা হয় ‘অবজারভার’, ‘মর্নিং নিউজ’, ‘ইত্তেফাক’, ‘সংবাদ’সহ বিভিন্ন পত্রিকায়। আলোকচিত্রী হিসেবে দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নেন সাইদা খানম। পেশাদার আলোকচিত্রী হয়ে ওঠার পথে সাইদা উৎসাহ পেয়েছেন বড় বোন হামিদা খানমের কাছ থেকে, যিনি অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদের স্ত্রী। আলোকচিত্রী হিসেবে পেশা গ্রহণের জন্য প্রথম থেকেই সাইদা খানমকে সামাজিকভাবে বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি পাড়ি দিতে হয়েছে। পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর এমনকি আশির দশকেও এই পেশায় নারীর কাজ করাটা অনুৎসাহিতই ছিল।
১৯৫৬ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেন সাইদা খানম। ওই বছরই জার্মানিতে তার ছবি পায় আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ভারত, জাপান, ফ্রান্স, সুইডেন, পাকিস্তান, সাইপ্রাস ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে তার ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। বাংলাদেশের ছবি নিয়ে সাইদা খানম বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন, পেয়েছেন বহু পুরস্কার। সত্যজিৎ রায় আর মাদার তেরেসার ছবি নিয়ে একক প্রদর্শনীও তিনি করেছেন।
সাইদা খানমের প্রায় ৩ হাজার ছবি প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি। শুধু বিদেশে নয় দেশেও নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হন। ১৯৫৬ সালে জার্মানিতে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড কোলন লাভ করেন। ১৯৬০ সালে ‘অল পাকিস্তান ফটো প্রতিযোগিতা’য় প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৮০ সালে সাইপ্রাসে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ ফটো প্রতিযোগিতায় সার্টিফিকেট লাভ করেন। এ ছাড়াও ইউনেস্কো অ্যাওয়ার্ড-জাপান, অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার, বেগম পত্রিকার ৫০ বছর পূর্তি পুরস্কার, বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সম্মানসূচক ফেলোসহ বিভিন্ন স্বীকৃতি পান। এ ছাড়া আলোকচিত্রে অনন্য অবদানের জন্য সরকার ২০১৯ সালে শিল্পকলা শাখায় সাইদা খানমকে একুশে পদকে ভূষিত করে।
সমাজসেবামূলক কাজে তিনি বেশি তৃপ্তি পেতেন। ভালোবাসেন অসহায়, অসুস্থ মানুষের সেবা করতে। সেবামূলক কাজেও তার যথেষ্ট অবদান আছে। মুক্তিযুদ্ধের পর হাসপাতালে নার্স সংকট দেখা দিলে তিনি হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী নার্সিংয়ের কাজ করেছেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় তিনি সেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।
আলোকচিত্রী সাইদা খানমের অনুপ্রেরণায় পরবর্তীতে এ সাহসিকতা ও মর্যাদাপূর্ণ পেশায় অনেক নারীর পদচারণা ঘটেছে। বাংলাদেশে নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ এ মহীয়সী নারী তার কর্মের মধ্য দিয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।