Skip to content

৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শনিবার | ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দীর্ঘ দূরত্বের সম্পর্ক ও বিশ্বাসের গল্প

একটা সময় ছিল যখন আমাদের হাতে হাতে না ছিল ফোন, ইন্টারনেট সুবিধা, ফেসবুক, হোয়াটস আপ এর মতো যোগাযোগ মাধ্যম। কিন্তু তখনও মানুষ দূরের বন্ধু বানাতো ভালবাসার সম্পর্কে জড়াতো। আর তার একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। চিঠির মাধ্যমেই দেশ-বিদেশে মানুষ বন্ধু বানাতো, ভালোবাসার সম্পর্কে জড়াতো। এইগুলো আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু তাই বলে চিঠির মাধ্যমে বিয়ে? 

হ্যাঁ চিঠির মাধ্যমেই বিয়ে একদম সত্য ঘটনা না হলেও “দ্য জাপানিজ ওয়াইফ” সিনেমায় এমনটাই তুলে ধরছেন পরিচালক অপর্ণা সেন। সিনেমার শুরুতে দেখা যায় একটি গ্রামের পথ ধরে নদী পার হয়ে একটি বিশাল বাক্স বয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। সেই বাক্সটি এসেছে সুন্দরবন এলাকার প্রত্যন্ত একটি গ্রামের গণিতের শিক্ষক স্নেহময়ের কাছে। বাক্সটি এসেছে জাপান থেকে।

বাক্স আসার খবরটি পৌঁছে যায় গণিতের শিক্ষক স্নেহময়ের কাছে। তখন ঘটনাটি বর্তমান থেকে ফ্লাশ করে নিয়ে যাওয়া হয় অতীতে দেখানো হয় চিঠির মাধ্যমে স্নেহময়ের সাথে জাপানি কন্যা মিয়াগির পরিচয়। আর তারপর থেকেই একে অপরকে দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা ইংরেজিতে লিখে পাঠায়। আবার মাঝে মাঝে টেলিফোনে ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে কথা বলা। স্নেহময় চিঠিতে তার গ্রাম নদীতে নৌকো করে ঘুরে বেড়ানো সবকিছু লিখে। 

মিয়াগিও জাপানের কথা তার মায়ে অসুস্থতার কথা চিঠিতে লিখে পাঠায়। এইভাবেই চলতে থাকে চিঠি আদান প্রদান। হঠাৎ একদিন চিঠিতে স্নেহময়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব আসে জাপানি কন্যা মিয়াগির কাছে থেকে। অনেক ভেবে চিন্তে রাজী হয়ে যায় স্নেহময়। কিন্তু কিভাবে বিয়ে হবে জানতে চায় স্নেহময়। তখন মিয়াগি তার উত্তর পাঠায় আর সাথে করে একটি আংটি পাঠায় স্নেহময়ের কাছে। এইভাবেই চিঠির মাধ্যমে গড়ে ওঠে তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। দুজনেরই আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় স্নেহময় পানে না মিয়াগির কাছে আর মিয়াগিও পারে না স্নেহময়ের কাছে আসতে। 

ঘটনা আবার ফিরে আসে বর্তমান আর জানা যায় বিয়ের ১৫ বছর উপলক্ষে স্বামীর জন্য উপহার হিসাবে এই বাক্সটি পাঠিয়েছে মিয়াগি। বাক্সটি খুলে পাওয়া যায় নানা রঙ্গের ঘুড়ি। স্নেহময় থাকত তার মাসির বাড়িতে। কিছুদিন পর তার মাসির বাড়িতে সন্তান পল্টুকে নিয়ে আসে বিধবা সন্ধ্যা। বিধবা সন্ধ্যা স্নেহময় মাসীর সইয়ের মেয়ে। একই বাড়িতে থাকলেও প্রথম প্রথম সন্ধ্যার চেহারা দেখতে পায় না স্নেহময়। পরপুরুষের সামনে চেহারা না দেখানো অথবা লাজুক প্রবৃত্তির কারণে। কিন্তু ধীরে ধীরে পরস্পর পরিচিত হয়ে ওঠে স্নেহময় ও সন্ধ্যা। এছাড়াও পল্টুর প্রতি পিতা সুলভ আচরণে সন্ধ্যা ও পল্টুর ফিরে যাওয়ার খবর কিছুটা বিচলিত করে স্নেহময়কে। 

কিন্তু মিয়াগির সাথে সম্পর্ক জড়ানোয় কিছুই করতে পারে না স্নেহময়। একদিন চিঠিতে খবর আসে মিয়াগির ক্যান্সার। তাই স্কুল থেকে ছয় মাসের ছুটি নেয় স্নেহময়। শহরের বিভিন্ন চিকিৎসালয় ঘুরে ঘুরে ঔষধ সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দেয় মিয়াগির কাছে। আর বিশ্বাস করে সেই ঔষধ খেয়ে চলে মিয়াগি। হঠাৎ এক প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টির দিনে সবার নিষেধ উপেক্ষা করেই শহরের ডাক্তারের কাছে যায় স্নেহময়। ডাক্তারের সাথে সাক্ষাৎও হয়। কিন্তু ফেরার সময় প্রবল ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পড়ে যার ফলে প্রচন্ড ঠাণ্ডা লেগে নিউমোনিয়া হয়ে যায়। সেই সময় প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টির কারণে নদীতে নৌকা পারাপার বন্ধ থাকে। আর তাই শহরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয় না এবং মারা যায় স্নেহময়। 

সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেখা যায় স্নেহময়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে স্নেহময়ের বাড়িতে হাজির হয় জাপানি বধু মিয়াগি। মাথার চুল কেটে এবং সাদা শাড়ি পড়ে একদম ভারতীয় বিধবার বেশে মিয়াগি উপস্থিত হয় স্নেহময়ের বাড়িতে। আর এর মধ্যে দিয়ে কোন দিন চোখে না দেখেও একটুখানি হাত না ছুঁয়েও যে বছরের পর বছর কাউকে সবটুকু দিয়ে ভালোবাসা যায় সেটাই পর্দায় তুলে ধরা হয়েছে।

 
“দ্য জাপানিজ ওয়াইফ” সিনেমাটি মুক্তি পায় ২০১০ সালের ৯ এপ্রিল। কুনাল বসুর “দ্য জাপানিজ ওয়াইফ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ” গল্প অবলম্বনে সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা ও পরিচালনা করেছেন অপর্ণা সেন। সিনেমাটিতে স্কুল শিক্ষক স্নেহময়ের চরিত্রের অভিনয় করেছেন রাহুল বোস। “দ্য জাপানিজ ওয়াইফ” সিনামাটিতে রাহুল বোস ছিলেন এক কথায় অনবদ্য। তার সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে চরিত্রটিকে সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরেছেন। আর বিধাবার চরিত্রে রাইমা সেন আসাধারণ অভিনয় করেছেন। 

বিশেষ করে লাজুকতায় বার বার শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে স্নেহময়কে এড়িয়ে চলা এবং এক্সপ্রেশন ছিল অনবদ্য। এদিকে মাসির চরিত্রে মৌসুমি চ্যাটার্জি ছিলেন যথেষ্ট সাবলীল। বিধবার ছেলে পল্টু চরিত্রে সত্যিই অসাধারণ অভিনয় করেছে রুদ্রনীল ঘোষ। 

আর মিয়াগি চরিত্রে অভিনয় করেছেন জাপানিজ অভিনেত্রী চিগুসা তাকাকু। যদিও সিনেমায় তার বেশি অভিনয় দেখানোর সুযোগ ছিল না। তবুও শেষ দৃশ্যে ঠিকই অভিনয় দক্ষতা দেখিয়েছেন তিনি। সর্বশেষে বলতেই হবে “দ্য জাপানিজ ওয়াইফ” সিনেমার মধ্য দিয়েই দর্শকদের নাড়া দিতে পেরেছেন পরিচালক অপর্ণা সেন। সিনেমাটি দেখতে দেখতে অশ্রুসিক্ত হবেন যে কেউ। দীর্ঘ দূরত্বের সম্পর্কে যারা আছেন তারাই হয়তো এই সিনেমাটির আবেদন বুঝতে পারবেন সবচেয়ে বেশি।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ