মুনশী আবদুল হাকিমের কোট
বাড়িওয়ালা তো বলছে ভাড়া দিতে না পারলে বাড়ি ছাড়তে হবে। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুতুব মিয়া বলেন, জানি। পুরুষের কাপড় টাঙিয়ে রাখার জন্য একটা পুরুষ মুর্তি ‘ম্যানিকেন’ আছে। অনেকদিন আগে একজনের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। ‘ম্যানিকেনটা’ দেখলে মনে হয় একজন তরুণ। যার কাছ থেকে পেয়েছিলেন তিনিও ছিলেন দর্জি। তবে অনেক বড় আর নামকরা দর্জি। তার মত নুন আনতে পানতা ফুরানো দর্জি নয়। সেই দিয়েছিল তাকে। বলেছিল, নাও জিনিসটা। আমার এক বন্ধু কোন এক বিশেষ কাঠে ‘ম্যানিকেনটা’ বানিয়েছে। এখন আমার মরণের সময়। জিনিসটা তোমারে দিলাম। যত পুরুষের কোট, সার্ট বানাবা এইটার উপর রাখতে পারবা। কুতুব মিয়া তাই করেন। কোন কোট বা সার্ট বানানো হলে ম্যানকেনটাকে পরান। তারপর যার নেবার সে নেয়। হালিমা বলে, বাবা হাসমত চাচা বলছে এইটা যদি বেচ তিনি নেবেন।
কি বেচবো?
ওই যে যার উপর তুমি কোট সার্ট রাখো। জিনিসটারে পরাও। সেই জিনিস। একটা মডেল মানুষ। যদিও কাঠ আর উল দিয়ে বানানো কিন্তু পোশাক পরালে খুব সুন্দর লাগে দেখতে।
না এটা আমি বেচতে পারব না। এটা আমার ছেলের মত। হালিমা বাবাকে এক কাপ চা বানিয়ে বলে, তাহলে? ভাড়া ক্যামনে দিবা।
হালিমাও চায় না জিনিসটা যাক। ওটা ওর সঙ্গীর মত। মাঝে মাঝে ম্যানিকিনটাকে পরিস্কার করে। ওর মাথার চুল আঁচড়ায়। কালো সুতোর চুল ম্যানিকেনের তরুণের মাথায়। নতুন কোন শার্ট বা কোট ওকে যখন পরানো হয় বেশ লাগে দেখতে। এখন বাবার একটু পুরনো ফতুয়া পরে আছে। কারণ বাবা বেশ কিছুদিন ভালো কোন অর্ডার পায়নি। ভালো অর্ডার পেলেই আবার ও সেসব পরে সুন্দর একজন হবে।
বাড়িওয়ালাকে কুতুবমিয়া এটা সেটা বলে, আরো কিছু সময় চেয়ে নিয়ে, সে যাত্রা রক্ষা পায়। বলেন, বাড়িওয়ালা এরপর যখন আসবো ভাড়া দিতে না পারলে জিনিসপত্র সব ক্রোক করবো। থাকার মধ্যে আছে একটা পুরনো দিনের পা সেলাই মেসিন। সিঙ্গার কোম্পানির। অনেক দিন আগের। আর একটি দুর্লভ ‘ম্যানাকিন’। দুটো চকি, দুটো চেয়ার, পাতিল হাড়ি। কিছু পুরনো কাপড় চোপড়। কাপড় কাটবার কেঁচি। গজ ফিতা এমনি টুকিটাকি। বউ মারা গেছে পাঁচ বছর আগে। তখন মেয়ে হালিমার বয়স ছিল দশ। এখন পনেরো। মেয়ে বড় হয়ে উঠছে। হার্টে একটু ফুটো নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। ওর বিয়ের কথা ভাবছেন না দর্জি কুতুবমিয়া। নিজেও আর একটা বিয়ে করেননি। বাপ মেয়ের সংসার। মেয়েটা মাঝে মাঝে ভালো থাকে, মাঝে মাঝে খাবি খাওয়া মাছের মত ছটফট করে।
ডাক্তার বলেছেন, বিয়ে টিয়ে দিও না। ওসব জীবন ওর নয়। তোমার সঙ্গে থাক। ছেলেমেয়ে সন্তান হওয়া ওর ভাগ্যে নাই। স্বামীর আবদার সহ্য করবার মত তাজা কলিজা নয় ওর। ফুটো নিয়ে জন্মেছে। ওকে বিদায় করো না। করলে ওই ফুটো কলিজা নিয়ে ফিরে আসবে। তারচেয়ে বরং নিজের কাছে রেখে দাও। সংসারের কাজ, স্বমীর কাজ মেটানোর মত ওর শরীরের অবস্থা নয়।
কুতুব মিয়া তাই মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবেন না। মেয়ে আর বাবা চলে যায় দিন। যখন একটু টাকা হাতে পান হালিমার চিকিৎসা করেন। ওর জামা কেনেন। লাল ফিতে আর ক্লিপ কেনেন। ভালোমন্দ খাওয়া দাওয়া। যখন টাকা থাকে না? কোনমতে দিন গুজরান। বাবা তখন এটাসেটা গল্প করে। হালিমা শোনে। বলে, বাবা গল্পগুলো তুমি যদি লেখ অনেকেই সেসব পড়বে।
কি যে বলিস। আমি হলাম দর্জি মানুষ।
এমনিই যখন সময় বেশ রাতে একজন গ্রাহক এসে দরজায় কড়া নাড়ে। একজন বুড়ো মত মানুষ। দেখতে ঠিক সাধারণ নয়। তবে অসাধারণত্ব কোথায় বুঝতে পারেন না কুতুব মিয়া। ভদ্রলোকের হাতে একটি প্যাকেট। কতুব মিয়া তাড়াতাড়ি বসতে বলেন। কম পাওয়ারের ব্লাবের আলোতে লোকটা সেই প্যাকেট টেবিলে রাখে। বলে, কোট আর প্যান্ট বানাবেন।
ঠিক আছে।
বলে, এই নিন ডিজাইন। ঠিক যেমন নকশা আঁকা আছে তেমন বানাবেন। কতুবমিয়া চোখে চশমা লাগিয়ে নকশা দেখেন। বিশেষ নিয়মে কোট আর প্যান্ট বানাতে হবে। আমি কখনো কারো কাছ থেকে এমন নকশার কোট প্যান্ট বানানোর অর্ডার পাইনি।
পাননি এখন পেলেন।
আসলে আমার পছন্দেই আমি বানাই কিনা। তাই–
আর এই যে মেটেরিয়াল সেটাও কেমন যেন। ঠিক কাপড়ের মত নয়। কুতুবমিয়া নেড়ে চেড়ে মেটেরিয়াল দেখেন। এমন কিছু তিনি আগে দেখেননি। সবকিছুই কেমন রহস্যে ঘেরা।
বানাতে পারবেন কিনা বলেন।
পারব মনে হয়। তবে সেলাই মেসিনে এটা হবে বলে মনে হয় না। পুরোটা সেলাই করতে হবে সুঁচে। খুবই খাটনির কাজ।
জানি। সেজন্য আপনাকে দশ হাজার টাকা মজুরি দেব।
দশ হাজার? কুতুব মিয়ার মনে হলো ও স্বপ্ন দেখছে। বাড়ি ভাড়া, মেয়ের জন্য ডাক্তার, ওর নতুন শালোয়ার কামিজ, ভালোমন্দ খাওয়া সবকিছুই হবে এই দশ হাজার টাকায়।
কোট আর প্যান্টটা কি আপনার? প্রশ্ন করেন কুতুব মিয়া।
না। আমার ছেলের।
তাহলে ছেলেকে আনেন। তার মাপ নেই।
ও আসবে না। ওকে চমক দেব আমি। যে ডিজাইন লিখেছি সেটা ফলো করলেই এই মেটিরিয়ালে কোট আর প্যান্ট হয়ে যাবে। একটুও কাপড় বাঁচবে না। কাটতে গিয়ে যেসব টুকরা হবে আমাকে দেবেন।
আচ্ছা।
কতদিন লাগবে আপনার?
দিন পনেরো। বলেন কুতুবমিয়া। লোকটা কি ভাবে। তারপর বলে, এগুলো হলে আপনি নিজে এসে আমাকে ডেলিভারি দেবেন। এই আমার বাড়ির ঠিকানা। কুতুব মিয়া ঠিকানা দেখেন। রেল গাড়ি প্রথমে তারপর পায়ে হাঁটা।
এত লোক বা দর্জি থাকতে আপনি আমাকে কাজটা দিচ্ছেন কেন? আপনার এলাকায় কি আর কোন দর্জি ছিল না?
ছিল। কেন দিলাম সেটা বলবো না। আপনি মন দিয়ে কাজ করবেন সেটা জানি। যাবার খরচ দিলাম। আর আগাম দুই হাজার টাকা। আপনি কাল থেকে কাজ শুরু করেন।
আপনি একটু বসেন। চা পানি? লোকটা বলে, না। এখন আমি যাই। এই বলে দরজা খুলে লোকটা যেন অন্ধকারে হারায়। লোকটা যে সত্যি এসেছিল তার প্রমানতো এই মেটেরিয়াল আর আগাম দুই হাজার টাকা। হালিমা ঘুম থেকে উঠে প্রশ্ন করে কে বাবা?
একজন খরিদ্দার। কোট আর প্যান্ট বানাতে চায়।
ও। খুশী হয় হালিমা। যাক একটা ভালো কাজ পাইলা। তিনি কি চিন্তা করতে করতে বাইরে আসেন। না লোকটা নেই। চলে গেছে। অন্ধকারে কোন মানুষের ছায়া নেই। তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর ভেতরে আসেন।
বলেন, মেয়েকে তোকে নতুন জামা বানিয়ে দেব রে মা। আর সেই ওষুধটা আনবো যা আনতে পারছি না পয়সার অভাবে।
আর তোমার জন্য কি কিনবা বাবা?
আমার কিছু লাগবে না। পাশের চকি থেকে বলেন।
রাতে কি সব অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন কুতুব মিয়া। কে যেন বরফের বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। তারপর একটা ধারালো চাকু। চাকুটা কেমন যেন বাঘের মত চোখে তাকে তাকিয়ে দেখছে। শুন্যে ঝুলছে একটা চাকু। তিনি আয়তুল কুরশি পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে ডান কাত হয়ে ঘুমান। হালিমার মা ও এমন করতো। মেয়েটার ঘুমের শব্দ শোনেন। তারপর এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে যান কুতুবমিয়া। এক সময় সকাল হয়।
পরদিন থেকে মন লাগিয়ে তিনি কাজ করতে গিয়ে বোঝেন মেটেরিয়ালটা সত্যিই অচেনা। কখনো মনে হয় গাছের বাকল। কখন মনে হয় সাপের ছাল। কখনো মনে হয় বাঘের চামড়া। আবার কখনো মনে হয় এটা কোন চেনা শোনা প্রাণীর চামড়া নয়, একেবারে অজানা কোন প্রাণীর চামড়া। তবু যে ডিজাইনটা রেখে গেছেন মুনশী আবদুল হাকিম সেটা দেখে কাপড় টা ধারালো কাচিতে কাটেন। কেচিটাকে নতুন করে শান দিয়ে নিতে হয়। একটা চকচকে সোনালি আভা সেই মেটিরিয়ালে। যেন মেটিরিয়ালের অন্তরে একটা গোপন সোনালি আলো আছে কোথায়। ঠিক যখন প্রথম সূর্য ওঠে তেমনে চমৎকার শিশুরোদ। তিনি একটু অন্যমনস্ক হতেই সুঁইটা আঙুলে ঢুকে যায়। টুপটুপ করে দুই ফোটা রক্ত পড়ে সেই মেটিরিয়ালে। তিনি ভয় পান। এখন যদি দাগ না ওঠে? তিনি তাকিয়ে ভাবছেন কি করবেন হঠাৎ দেখেন একটা সোনালি আভা এসে কাপড়টার উপরের রক্তের দাগ টাকে এমন করে শুষে নিয়েছে ওখানে যে কখনো কোন রক্তের দাগ ছিল তা মনে হয় না। তিনি অবাক হন। হালিমা এক মগ চা আর দুটো বিস্কুট এনেছে বাবার জন্য। ও তাকিয়ে দেখে। বড় বড় চোখে বলে, বাবা এটাতো মনে হয় যাদুর কাপড়। তিনি গম্ভির গলায় বলেন. এসব নিয়ে কারো সঙ্গে কিছু আলোচনা করবা না হালিমা। এটা যে একটা নতুন কিছু সেটা আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম।
কার সঙ্গে আলোচনা বাবা? আমার তো কোন বন্ধু নাই যে এসব নিয়ে আলাপ করবো। কেবল রহিমাখালা মাঝে মাঝে আসেন।
ওই খালাকেও বলবা না।
না বাবা।
মেয়েদের পেটে তো কথা থাকে না। খবরদার এসব কথা–
বাবা একবার বলছো আবার বলার দরকার নাই। আমি কারো সঙ্গে আলাপ করব না।
তিনি মন দিয়ে ডিজাইন মেনে কোটটা কাটেন। যে সব টুকরো কাপড় এইসব কাটাকাটিতে পড়েছে সেগুলো যত্নে করে তুলে একটা প্লাসটিকের ক্যারিয়ার ব্যাগে রাখেন। মুনশী আবদুল হাকিম সবগুলো টুকরো কাপড় চেয়েছেন।
রাতেও কাজ করেন। সব সেলাই নিজের হাতে করেন। এ জিনিস সেলাই মেসিন দিয়ে হবে না। সেটা প্রথমেই বুঝেছিলেন। চোখ জ্বালা করে। ছানিপড়া চোখ উপেক্ষা করে তিনি চোখে পানি দিয়ে পোশাক বানাতে থাকেন।
এই করতে করতে পনেরো দিনের মাথায় একটা কোট আর একটা প্যান্ট বানানো শেষ হয়। তিনি তাকিয়ে দেখেন। এ কোট আর প্যান্ট যার জন্য করা হয়েছে সে একজন বারো তেরো বছরের ছেলে। কিম্বা আর একটু বেশি। মুনশী আবদুল হাকিমের এই বয়সের একটা ছেলে আছে? দেখেতো মনে হয় বুড়ো। বুড়োর ছেলে? না নাতি? সে যাক, শেষ হলে আরো আট হাজার টাকা! পুরোটা শেষ হয়ে যাবার আনন্দে পিঠ টান টান করে দাঁড়ান। মেয়েকে বলেন, আগামী কাল এটা দিতে যাব। তিন স্টেসন রেলগাড়ি তারপর এক মাইল হাঁটা। আমি রাতের মধ্যেই ফিরে আসবো। তুই দরজা বন্ধ করে ঘরে থাকিস। ভয় পাস না।
না বাবা। আমি ভয় না পাওয়ার দোওয়া জানি।
তিনি মেয়েকে একটু আদর করেন। বলেন, আমার হালিমামা আমার কলিজার টুকরা জানে কিভাবে নিজেকে দেখেশুনে রাখতে হয়।
স্টেসন থেকে নেমে ভাবনগর যেতে তিনি একটু পথ হারিয়ে ফেলেন। শেষপর্যন্ত একটা চায়ের দোকানে ঢোকেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। এটা ডেলিভারি দিয়ে রাত এগারোটার ট্রেনে তিনি ফিরে যাবেন। একটা লোক চা পান করছে। তিনি তাকে মুনশীর ঠিকানা দেখান। লোকটা বলে, ওকে আমি চিনি। ও তো প্রায় বিশ বছর হিমালয়ে কোন এক সাধুর চেলা হয়েছিল। তারপর ফিরে এসে বিয়ে করে। তেরো বছর আগে একটা ছেলে হয়। ব্উটা মারা যায়। এখন বাপ আর ছেলে। ও চায় না আমরা কেউ ওকে বিরক্ত করি। আপন মনে কি করে কে জানে। ছেলেটাকেও স্কুলে টুলে দেয়নি। ওর খবর তো বেশ কিছুদিন আমি জানি না। নিজের ছেলেটাকে কখনো বাইরে বের হতে দেয় না। তবে সেটা ওর ব্যাপার।
চা আলা যোগ দেয়। বলে, মাঝে মাঝে দেখা যায় বাজারে। নিজের মনে বাজার করে বাড়িতে চলে যায়। বড়ই অদ্ভুত একজন। দু-একজন আলাপ করতে চেয়েছিল, বোধহয় সাধুসন্নাসীর গল্প শুনতে চেয়েছিল। হিমালয়ে বিশ বছর কি করলো লোকটা। সকলে বলে ও নানা রকম অসুখ সারানোর ওষুধ জানে। কিন্তু সে কথা ওকে কে প্রশ্ন করবে? আর প্রশ্ন করলেই ও উত্তর দেবে নাকি? ও তো বাড়ির দরজা বন্ধ করে রাখে। ছেলেটাকেও এমন করে মানুষ করছে। বাবার কথামত বা ইচ্ছেমত ছেলেটার জীবন চলছে। বোধকরি নিজে যেসব জানে সব ছেলেটাকে শেখাবে। তাই স্কুলে দেয়নি। ওরা দুজন মিলে মুনশীর বাড়ি যাবার রাস্তাটা দেখিয়ে দেয়। কুতুবমিয়া বুঝতে পারেন একটা ভুল বাঁক নেওয়ার জন্য ও পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। বড় ব্যাগে কোট আর প্যান্ট। কুতুব মিয়া বলেন, না পেলে চলে যাব। বাড়িতে ছোট একটা মেয়ে রেখে এসেছি। বলেন না কি দিতে এসেছেন। বলেন, কেবল দেখা হলে ভালো। না হলে অসুবিধা নাই। এমন ভাব করেন লোকটাকে না দেখলে ওর কোন ক্ষতি নাই। আর ওর সঙ্গে যে জিনিস আছে সে নিয়েও কোন কথা বলেন না। জানেন এ কথা গোপন রাখা ভালো। এটা যে একটা বিশেষ গোপনীয় ব্যাপার সে কথা তো উনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
একটা বড় মাঠের শেষ প্রান্তে বাড়িটা। আশেপাশে আর কোন বাড়ি নাই। কেবল নানা সব গাছ ঘেরা একটা পুরনো বাড়ি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে কুতুব মিয়া গাছগুলো দেখেন। ফল ফলারি এ ছাড়া নানা ঔষধি গাছ। বড় বড় পেয়ারা আর জামরুলের গন্ধ। আতা ফলের মত কোন পাকা ফলের গন্ধ পান। একটা গাছে মাংসের টুকরোর মত কি যেন ঝুলে আছে। এ আবার কেমন গাছ? মনে মনে বলেন। এবং আরো সব অদ্ভুত গাছ ওঁর চোখে পড়ে। গাছের ফাঁক দিয়ে একটা বড় চাঁদ তাকে দেখছে। সেই আলোতে ঝিমঝিম করছে গাছ, বাগান, চারপাশ। তিনি বেশ কিছুক্ষণ সেসব দেখেন। বুঝতে পারেন অনেক দুর্লভ গাছ আছে ওর বাগানে। অনেক দুর্লভ লতা-গুল্ম। এক সময় দরজায় বেল টেপেন। ভেতরে টিংটিং আওয়াজ হয়। দরজায় মুনশী আবদুল হাকিম। তিনি কুতুবমিয়া ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করেন। কুতুবমিয়া বলেন, এত সব গাছপালা। বারান্দাতেও গাছ। উঠোনে গাছ। মুনশী বলেন, ওইসবই আমাদের ভবিষ্যত। খাবার এবং বাঁচবার। আমি সবকিছু লিখে যাব, এইসব গাছের কথা, লতার কথা। আরো নানা কিছু। তারপর বলেন, এনেছেন? কুতুবমিয়া ব্যাগটাকে সজোরে আঁকড়ে বলেন, আগে আমার টাকা দিন। মুনশী কেমন একটু বিব্রত। বলেন, ভেবেছিলম কিছু টাকা পাব, পাইনি। ভেতর বাড়ির ভেতরেও নানা গাছ গাছড়া। বলেন, আমি একটা বই লিখছি। এই একটি বই মানবজাতিকে বদলে দিতে পারে। মানুষ অনেকটা ঈশ্বর হয়ে যেতে পারে।
ওসব শুনতে চাই না। আগে টাকা। তারপর অন্যকথা। মানুষ ঈশ্বর হতে পারে কিন্তু আমি টাকা না নিয়ে এ জিনিস দেব না।
আপনার কি লেখকের জন্য কোন সন্মান নাই?
আছে। এবং আমার নিজের পেটের জন্যও মায়া আছে। মেয়েটা। থাক ওসব শুনে আপনি কি করবেন। টুকরো কাপড়গুলোয় এনেছি। টাকা দেন এসব দিয়ে আমি চলে যাব। আমি আলাপ করতে আসিনি। একটা অসুস্থ মেয়েকে বাড়িতে রেখে এসেছি।
হাত বাড়ান মুনশী। বলেন, আমি টাকা দেব। অনেক টাকা দেব। কেবল আপনি একটু ধৈর্য ধরেন। আমাকে একটু বিশ্বাস করেন। আমাকে একটু সময় দেন। আপনি ঠকবেন না।
পনেরো দিনের অমানুষিক পরিশ্রম। বাড়ি ভাড়া। মেয়ের ওষুধ। পেটের ক্ষুধা। দীর্ঘপথ এসে ডেলিভারি। বলেন কুতুব উদ্দিন না দিলে আমি জিনিস নিয়ে চলে যাব। কেমন যেন হিংস্রভাবে মুনশী তাকান। অন্ধকারে তার দুই চোখ জ্বলে ওঠে। বুড়ো নয় ভয়ানক এক তরুণের মত তিনি কুতুব উদ্দিনের উপর লাফিয়ে পড়তে চান। বলেন হিংস্রভাবে, অসাহায় ভাবে আপনি কিছুতেই ও জিনিস নিয়ে চলে যাবেন না।
হঠাৎ লাগোয়া ঘরখানাতে কিসের যেন শব্দ। তিনি তাড়াতাড়ি সে ঘরে উঁকি দেন। একটা বেড়াল ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তিনি তাকান। বিরাট বড় এক কাঠের বাক্স বরফে ভর্তি। তার ভেতরে একজন তেরো বছরের ছেলে শুয়ে আছে। মনে হয় মৃত। কুতুব উদ্দিন আঁতকে ওঠেন। এই সেই স্বপ্নের ছেলে। তিনি বলেন, আপনি তো একটা খুনী। নিজের ছেলেকে মেরে ফেলে এইভাবে বরফে রেখে দিয়েছেন। আগে জানলে–
আমি খুনী না। মুনশী আবদুল হাকিম গম্ভির গলায় জানান। ও মারা গেছে। হঠাৎ হার্ট বন্ধ হয়ে। যে ছেলেকে আমি আমার সব বিদ্যা-বুদ্ধি দেব বলে ঠিক করেছি সে মারা গেছে। আমার একমাত্র ছেলে। আমার উত্তরসুরী। যে আমার সব কিছু প্রচার করবে, যে আমার সব কিছু একদিন জানবে। এ দুঃখ আমি কোথায় রাখি। আপনাকে বললাম তো আমি একজন বিশেষ মানুষ। বইটা আগে লেখা হোক। তবে আমার ছেলে অবশ্যই আমার রেখে যাওয়া কাজগুলো করবে। আমি যেসব দিয়ে অনেক ভেবেছি। অনেক গবেষণা করেছি।
মিথ্যাবাদী। ছেলেটাকে মেরে বরফে রেখে দিয়েছেন। তারপর বলছেন ও সব করবে? পাগলতো আপনি। ঘোর উন্মাদ। কবর দেন নি কেন? ও ধরা পরবার ভয়?
না না ওকে কবর দিতে চাই না। ও আমার ছেলে। আমার ভবিষ্যত, আমার স্বপ্ন।
আপনি শুধু খুনী নন মিথ্যাবাদী। ঘোর উন্মাদ! তাইতো বলি এত লোক থাকতে আপনি আমাকে খুঁজে বের করে এসব বানাতে দিয়ে এলেন কেন। ভাবছেন আমি চুপচাপ কিছু না বলে পোশাকটা দিয়ে চলে যাব? একটা গরীব দর্জি! আপনার ধমকে ভয় পাবো। সেটা হবে না। মৃত ছেলের জন্য এইসব? ঠাট্টার তো একটা সীমা আছে। আপনি একটা সহাস্যাডিস্ট। আমি এখনি যাব এবং গিয়ে পুলিসকে বলবো আপনি কি কান্ড করেছেন। নিজের এলাকা বাদ দিয়ে আমাকে কেন দিয়েছেন এবার সেটা বুঝতে পারছি।
না আপনি যাবেন না। আপনি কোট-প্যান্ট দেবেন তারপর যাবেন। মুনশী আবদুল হাকিম একটা ছুড়ি হাতে। দপ দপ করছে তার দুই চোখ। আপনি যদি এটা না দিয়ে যেতে চান প্রাণে বাঁচবেন না।
পাগল নাকি। আপনি কি পাগল! আপনার মৃত ছেলে এসব পরবে?
আপনি যা জানেন না সেসব নিয়ে কথা বলবেন না। মুনশী চাকু হাতে কাছে এগিয়ে আসছেন। একটা হারিকেন জ্বলছে। বাতি নেই। অবাক দরজার ওই বেলটা তাহলে বিদ্যুতে চলে না।
মুনশী কেবল ঝাঁপিয়ে পড়তে চান বাঘের মত গর্জন করে, কেবল গর্জন বাঘের মত নয়, তাকে দেখতেও লাগছে বাঘের মত। দপদপ করছে চোখ। তিনি যেন আগের চেয়ে লম্বা আর শক্তিশালী হয়ে গেছেন। মাথার চুলগুলো মাথার উপরে দাঁড়িয়ে গেছে। তিনি কেবল ঝাঁপিয়ে পড়বেন তখনি কোটের পকেট থেকে একটা ধারালো চাকুতে মুনশীর কলিজা বিদীর্ন করেন দর্জি কুতুবমিয়া। কেঁচিটা এনেছিলেন যদি এাখানে কিছু কাটাকাটি করতে হয়। বরফের ভেতরে সেই তেরো বছরের ছেলে কি একবার নড়ে ওঠে? তারপর সব শেষ।
বেড়ালটা বাড়ি থেকে চলে গেছে। একটা অচেনা পাখি খাঁচায় পাখায় মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে আছে। কয়েকটা গিনিপিগ একটা খাঁচায়। হারিকেন এই ধ্বস্তা¦স্তিতে মাটিতে পড়েছে। কেরাসিন গড়িয়ে পড়ছে। কুতুব মিয়া পাগলের মত বাড়ি থেকে বের হন। খানিকপর বাড়িটা পুড়ে যাবে। পুড়ে যাবে মুনশী আবদুল হাকিম আর তার মরা ছেলে। টেবিলে যে বইটা দেখেছিলেন সেটাও পুড়বে। কুতুবমিয়া জানেন না এই পৃথিবীর একটি অত্যন্ত মূল্যবান বই এইসবের সঙ্গে ছাই হয়ে যাবে। পৃথিবীর কোন মানুষ এমন একটা বইএর কথা জানবে না। বিশ বছর ধরে যা জেনেছিলেন মুনশী আবদুল হাকিম। তাঁর সব জানা, সারা জীবনের যত জানা যত জ্ঞান সব তিনি এই বিশাল গ্রন্থে ঢেলে দিতে চেয়েছিলেন। কেউ জানবে না কি শেষ হয়ে গেল এই মুহূর্তে।
কোনমতে মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে কুতুব মিয়া স্টেসনে আসেন। পিছু ফিরে দেখতে পান বাড়িটা পুড়ছে। আগুনে জ্বলছে একটা বাড়ি। একজন জীবিত আর মৃত মানুষ। আর একটি গ্রন্থ। তিনি ছুটে চলে আসেন স্টেসনে। ট্রেন এসে যায়। তিনি লাফ দিয়ে ট্রেনে ওঠেন। পকেটে রক্তাক্ত চাকু। আর সারা শরীরে জবজবে ঘাম।
মেয়েটা জেগে ছিল। বলে, বাবা টাকা পেলে?
তিনি কিছু বলেন না। এরপর ব্যাগ থেকে কোট আর প্যান্ট বের করে ম্যনিকেনটাকে পরান। এগুলো ওর গায়েই থাক। যদি কেউ কিনতে চায় দেবেন। সোনালি আলোর দ্যুতি সেখানে। ঝক ঝক করছে সেই অদ্ভুত মেটিরিয়ালের পোশাক। ম্যানিকেনের কালো চুল আর কালো চোখ তাকে দেখছে।
ওনাকে দিলে না এসব? মেয়ে প্রশ্ন করে।
না। এই বলে তিনি বিছানা খোঁজেন। মেয়ে বুঝতে পারে কোথাও একটা বড় গোলমাল হয়েছে।
ক্লান্ত কুতুবমিয়া বিছানায় যান। সারাদিন না খাওয়া। শূন্য পকেট। ক্লান্তিতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন আচ্ছন্ন হয়ে।
সাতদিন পরে একটা কাজের অর্ডার নিয়ে বাড়ি আসছেন। রাত প্রায় বারোটা। বড় কাজ। মনটা প্রসন্ন। ঘরের কাছে আসতেই মেয়ের খিলখিল হাসি শুনতে পান। মেয়েটা কার সঙ্গে যেন গল্প করছে। বলছে, বাবা যখন থাকবে না এইভাবে আমরা গল্প করবো। কেমন? অন্যপক্ষের গলা শোনা যায় না। বলে হালিমা, বাবকে বলার দরকার নেই। এই পৃথিবীতে থাকবো কেবল তুমি আর আমি। তুমি আর আমি এই বিশ্বের সেরা বন্ধু। বন্ধু আরো কাছে আসো। এই পৃথিবীতে আমার আর কাউকে দরকার নেই। মেয়েটা এমন সব কথা কবে শিখলো? ডাক্তার যা বলেছিলেন সেই কথা ভেবে তিনি আতংকিত। দরজা খুলে মেয়েটাকে বকতে যাবেন এমন কাজে চমকে তাকান হেঁটে হেঁটে কাঠের ম্যানিকেন মেয়েটার বিছানার কাছে চলে এসেছে। মেয়েটা অবশ্যই ওই ভারী ম্যানিকেনটাকে এখানে আনতে পারে না। জীবন্ত মানুষের মত তাকিয়ে আছে সেই ম্যানাকিন কতুবমিয়ার দিকে। তার গায়ে সেই কোট আর প্যান্ট। সোনালি আলো ঠিকরে পড়ছে সেই কোট থেকে। আর সেই আলোতে ঘরটাও কেমন উজ্জ্বল মনে হয়। কাঠের ম্যানিকেনে প্রাণ এসেছে। এই পোশাকে? তিনি বিড় বিড় করেন? এই পোশাকে ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন আর এক জগত থেকে। আর সেইসব কথা লিখে রেখেছিলেন বইটাতে, যা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তার মাথা ঝিম ঝিম করছে। কোন গুপ্তবিদ্যা শিখে এসেছিলেন এই মুনশী আবদুল হাকিম কে জানে? হঠাৎ চমকে তাকান হাত বাড়ায় ম্যানিকেন কুতুব মিয়াকে শেষ করে দেবে বলে। তিনি নড়তে পারছেন না। সন্মোহিত। জ্বলজ্বলে চোখে তাকে দেখছে সেই বিশেষ ম্যানিকেন।
মেয়েটা বাবাকে রক্ষা করবে বলে এগিয়ে আসে না। মুনশী আবদুল হাকিমের নকশায় আর তারি দেওয়া বিশেষ ছাল বাকলে বানানো পোশাকে সেই প্রাণ পাওয়া ম্যানিকেন মনে হয় আর কাউকে সহ্য করবে না।