Skip to content

২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বুধবার | ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মনে হবে গল্পটি বানোয়াট

 

কালেভাদ্রে যখনই আমি এই স্বর্গে  আসি সারাটা সময় ভীষণ মুগ্ধতা নিয়ে শায়লা শনবমকে গিলতে থাকি। ক্ষুধার্ত সাপ যেমন ব্যাঙকে আয়েস করে গেলে। সে সময় কোন প্রয়োজনীয় কথা আমার কানে পৌঁছায় না। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। শায়লা মিষ্টি গলায় দরকারি কথাগুলো বলে চলল, আর আমি আমার সবটুকু মনযোগ নিয়ে গভীর সুখময় দীর্ঘ ক্লিভেজের মসৃন গিরিখাদ বেয়ে নামতে থাকি, সময় হারিয়ে যায় দ্রুত। তীব্র এসির মাঝেও আমার গরম লাগে। দৃষ্টিটা কেমন যেন ঘোলা হয়ে আসে। আমি টাইয়ের নটটা সামান্য হালকা করার চেষ্টা করতেই স্টেনোগ্রাফার শায়লা শবনম বলে, ডা. আলম, শুনেছেন তো সব, কালই আপনার ফ্লাইট? 

 

মুহূর্তে আমি টেবিলে ফিরে আসি। তারপর ধোঁয়া উড়া ক্যাপাচিনোতে হালকা চুমুক দিয়ে পুনরায় টোটাল বিষয়টা শুনি মনযোগ দিয়ে। 

 

আগামীকাল সাতদিনের জন্য আমকে যেতে হবে অখ্যাত অন্ধকারাচ্ছন্ন এক গ্রামে। গ্রামের নাম জয়পুর। সেখানে আর্সেনিকের ভয়াবহ প্রকপ। মাটি, পানি, মানুষ পরীক্ষা করে রিপোর্ট করতে হবে। 

আগামীকাল সকাল নয়টা ত্রিশে আমার ফ্লাইট। নভ এয়ার। ঢাকা থেকে যশোর, সেখান থেকে মেহেরপুর মুজিবনগর। বাঁকিটুকু লোকাল ম্যানেজমেন্ট। সীমান্তবর্তী এলাকা। একেবারেই বর্ডারঘেষা গ্রাম। আমার চিঠি লাল কালিতে সাবধান থাকার কথাও উল্লেখ করা আছে। 

 

অথচ ছোটবেলা থেকেই আমার সীমান্তের প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। রোমাঞ্চ ভরা কৌতুহল ছিল আমর সমগ্র মনটা জুড়ে। গ্রীস্মের ছুটিতে বাবার সাথে যখন দিনাজপুর যেতাম, তখন চলন্ত ট্রেন থেকে দেখেছি হিলি বর্ডার। দেখতাম তাগড়া জোওয়ান সৈনিক অস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছে একটা উঁচু ঢিবির এপাড়ে ওপাড়ে। চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখতাম কালো রঙের ওয়াচিং টাওয়ার চোখের নিমিষে পিছনে হারিয়ে যাচ্ছে। দেখতাম ছোট ছোট বাড়ি-ঘর, রৌদ্র দগ্ধ লাউমাচা, ছাপড়া চায়ের দোকান, জীর্ণ মানবেতর মানুষ আর কালো কুকুর। কুকুরগুলো আমাদের ট্রেনের দিকে মুখ করে ঘেউ ঘেউ করত, কাকে যে গালি দিত, কেনই বা এত রাগ ওদের, তা আমার এখনো বিস্ময়। বর্ডার দেখার সেই রোমাঞ্চ এখনো ভুলতে পারি না। 

 

আমার জার্নি কষ্টদায়ক হয়নি। যশোর থেকে অফিসের গাড়িতে মেহেরপুর আসার পর জানলাম আমাকে বাঁকি পথ যেতে হবে মোটরসাইকেলে। আমাকে যিনি নিতে এসেছেন তিনি তার ডিসকভার মোটরসাইকেল নিয়ে পান চিবুতে চিবুতে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি ভদ্রলোকের পিছনে চড়ে বসলাম ভয়ে ভয়ে। ভদ্রলোক বললেন, আমার নাম আলমগীর হোসেন। গ্রামের নির্বাচিত মেম্বার, স্যার।

 
আমি সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বললাম, ও আচ্ছা। আমি অবাক বিস্ময়ে রাস্তার দুপাশের সবুজ দেখতে থাকি। এমন সুন্দর সবুজের সম্ভার অনেককাল দেখিনি। ঢাকা শহরে সবুজ নেই। রাস্তার মাঝে যে গাছগুলো লাগানো আছে, তার পাতাগুলো ধুলো আর শিষার অদৃশ্য প্রলেপে সবুজ আভা হারিয়েছে অনেক আগেই। বিবর্ন গাছগুলোকে সবুজের মমি বা ফসিল মনে হয়। 

 

গতবার চারশো ভোটে ফেল করিলাম, স্যার। ইবার আমিই নোমিনেশন পেইলাম-শুমুন্দিদের ছেন্টারেই আসতে দিইনি। সাতশো ভোটে পাশ। গর্বের সাথে বলে চলে আলমগীর মেম্বার। আমি শুধু ‘হু’ ‘হ্যাঁ’ করে যাই, পাছে তার ড্রাইভিংয়ে অসুবিধা হয়। মোটরসাইকেল চালাতে চালাতে সে বলে, ইবার কাজ করিছি ম্যালা, আশা করি আগামীতে জিতব হেসে খেলে ইনশাল্লাহ। আই ক্যান চ্যালেঞ্জ। 

 

আমি বললাম, আপনাদের গ্রাম থেকে সীমান্তটা কতদূর? 
সীমান্ত মানে কাঁটাতারের বেড়া? 

 

আমার মনে পড়ে বর্ডার এখন খুব সংরক্ষিত। ওরা কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দিয়েছে সীমান্তরেখা। তারপরও ওরা গুলি চালায়; ওদের দেওয়া কাঁটাতারে, ওদের ছোঁড়া গুলি খেয়ে অসহায়ভাবে ঝুলতে থাকে আমাদের নিষ্প্রাণ ফেলানিরা। মেম্বর সাহেব বললেন, কাঁটাতার আমার ওপাড়ার পরই। সন্ধ্যা হলি, আলা জ্বালিয়ে দেয় ওরা স্যার! এই আলাতেই গিরাম আলা হয়ি থাকে। 

 

চলন্ত বাইকে বসে আমি কাঁটাতারের বর্ডারের কথা ভাবতে থাকি আর গ্রামের নির্মলতা গায়ে মেখে সবুজগাছ, ধানী মাঠ, পুকুর, চকচকে রোদ নাচন দেখতে থাকি। মাথার উপর সুনীল আকাশ, উদার মাঠের নির্মল বাতাস আর সবুজের অদ্ভুত গন্ধ, সাথে বাইকের ছন্দময় ঝাঁকুনি, আমার কেমন যেন ঘুমঘুম ভাব হতে থাকে। 

 

দুই

 

এ ক’দিন প্রচুর রোগী দেখলাম। আমার গবেষণা এই রোগীরা অনেক সহজ করে দিয়েছেন। আমি সারা রাত ল্যাপটপে কাজ করি; সকালে ইবাদত সাহেব নাস্তা করান। তারপর বলেন, ছার কটা রোগী আছে ছার, একটু দেখে দেবেন ছার। 

 

এমন কি অন্য গ্রামের রোগী আসে ঢাকা থেকে বড় ডাক্তার এসেছেন শুনে। ইবাদত ডাক্তার কিন্তু ফিস নিতে ভুলেন নি। গ্রামের সেবা মেডিসিন ঘর দু’বার মাল এনেছেন শহর থেকে। গ্রামের তিনজন রোগীকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাঃ সাইফুল ভুঁইয়াকে ফোন করে ভর্তি করে দিয়েছি। সারাদিন রোগী দেখি, বিকেলে গ্রাম বেড়াই। সাথে থাকে মেম্বার। সন্ধ্যা হলে সীমান্তে আলো জ্বলে ওঠে। আমি মুগ্ধ চোখে বর্ডার দেখি। ওপাড়ের হলুদ আলোতে ভেসে যায় বাংলাদেশ। 

 

আজ গ্রামটাকে ছেড়ে যেতে বেশ খারাপ লাগছে। কাল সকালে গাড়ি। আমি উদাস হয়ে যাই। তাকিয়ে থাকি দূরের কাঁটাতারের দিকে, যেখানে আর দৃষ্টি যায় না। দূরের সীমান্তে হলুদ আলো এক ধোঁয়াসা তৈরি করে; আলোর মাঝে ঝাঁক বেঁধে উড়ছে ক্ষুদ্র পোকা। রাত যত গভীর হবে, এদের প্রাণবায়ু ক্ষীণ হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যাবে। পরের সন্ধ্যায় আবার ওরা জড় হবে দল বেঁধে; উড়তে থাকবে মনের আনন্দে, এরা আসে মরার জন্য। কিন্তু বাঁচে প্রাণভরে। সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে রুমে ঢোকার মুখে মনে হল, কোথা থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছে। পরক্ষণে মনে হয় মনের ভুল হতে পারে। অস্থির মস্তিষ্কের বিলাপ মাত্র। প্লেট ঢাকা জলটুকু এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ল্যাপটপের কাছে যেতেই, শব্দটা আবার কানে এল। হাঁফ ধরা গলায় মিনমিন করে কেউ ডাকছে, ডাক্তার বাবু…. ডাক্তার ছ…আর। 

 

গভীর কুয়োতে পড়ে যাওয়া মানুষ যেমন সাহায্যের জন্য ডাকে, ঠিক তেমন। 

 

রাত হয়েছে। সীমান্তের আলো, আলোর পোকা, আর ঝিঁঝি ছাড়া এই গ্রামে আর কেউ জেগে নেই এখন। ঘড়ি দেখি। দশটা পঁয়তাল্লিশ। গ্রামে মধ্যরাত। শব্দটা আবার কানে এল। আমি এখন নিশ্চিত যে, কেউ ডাকছে। কিন্তু নিচে যাওয়া কি ঠিক হবে! আমি দোতালার ঝুল বারান্দায় আবার এলাম। আর তখনই আবার কেউ ডেকে উঠল ডা…ক্ত…আ…র র….আ…, শব্দের পিছনে আমি দ্রুত আমার দৃষ্টিকে ছড়িয়ে দিই। একটা মানুষের মত মূর্তি সারা শরীর মলিন চাদরে ঢাকা একজন এই বাড়ির দিকে পিছন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সীমান্তের তীব্র হলদে আলোতে মূর্তিটাকে ঝুলন্ত বাদুড়ের মত দেখাচ্ছে।  

 

ডাক্তার বাবু … ছার আমি…
কিছু বলবেন ?
এ্যগ্গে;
কি সমস্যা? এত রাতে তো আমি রোগী দেখব না। 

 

ডাক্তার বাবু, এ্যগ্গে, একটু কথা ছ্যাল। আলোর কাছে ভিড় করা পোকাদের মত কিসের টানে আমি নিচের দিকে এগিয়ে গেলাম। তখন দ্বাদশীর চাঁদ আকাশ রাঙিয়েছে। চাঁদের কোমল আভায় এক মায়াময় স্নিদ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে নিকানো উঠানে। পুকুরপাড়ের উত্তর-পূর্ব কোণের বাঁশবাগানে বাঁশের ঘর্ষণে ভৌতিক শব্দ রাতের নিঃস্তব্ধতাকে রহস্যময় করে তুলেছে। আমি মাটিতে পা রাখতেই বেশ একটা ছন্দ মেনে যে প্যাঁচাটা এতক্ষণ গম্ভীর কণ্ঠে ডাকছিল কোন নোটিশ ছাড়াই চুপ করে গেল হঠাৎ। নিশ্চুপ হল সমগ্র চরাচর আর তখনই কুকুরগুলো ডেকে উঠল; প্রথমে একটা দুটো পরে দল বেঁধে চিৎকার করতে লাগল। 

 

তিন

 

লোকটি বসে আছে আমার দিকে পিছন দিয়ে। ওরা পিঠটা নিঃশ্বাসের তালে দুলছে। এখন শরৎকাল আকাশে কালপুরুষ জেগেছে। বাতাসে শিউলির মৃদু গন্ধ ভেসে আসছে। পদ্মপুকুরে বড়মাছ ঘায় দেয় শব্দ করে। আমরা এই পুকরের শানবাঁধা ঘাটের সিঁড়িতে বসে আছি। 

 

আপনি আমার সাথে ঘরে চলুন, বসে আপনার সমস্যা শুনি, আমি প্রথমেই বলেছিলাম। 
না না ছার ঘর নয়; জোসনা রাইতে পুকুরপাড়েই বসি, যদি আপনি দয়া করেন।

 
আমার নাম ছার আপয়া শ্রীধাম, আমাদের চারপাশের জমাট নৈশব্দকে ভেঙে লোকটি তার পরিচয় দেয়। আমি লক্ষ্য করলাম কুকুরগুলো ডাকছে না, চারদিকে শুনশান নীরবতা এমনকি ঝিঁঝি পোকারাও স্তব্ধ।  

 

বয়স? সমস্যা কী? আমি জিজ্ঞাস করলাম।
এ্যাগ্গে, বয়েস দুই কম একশো।
এই কথায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। গ্রামের মানুষ বয়স আর দূরত্ব বোঝে না। 
দুই কম একশো মানে আটানব্বই বছর? 

 

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রীধাম বাবু উত্তর করলেন, আমার বাবা দেহরাখেন একশো বচ্চর বয়েসে; আর ঠাকুর দা, একশো দশ বচ্চর বয়েসে হাটে যেতেন। কিন্তু আমার আর বাঁচতে সাধ হয় না ছার। 

 

আমি আষাঢ়ে গল্প শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কাল জার্নিটা করতে কষ্ট হবে। আমি সিগারেট ধরাই। শ্রীধাম বাবু বলে, আহা কী সুন্দর ঘ্রাণ! ছার আমাকে একডা সিকাড দিয়া যায়, ছার? 
আমি আবারো একটা দীর্ঘশ্বান গিলে নিই। কিন্তু লোকটা আমার দিকে তাকাচ্ছে না। সে উল্টো দিকে তাকিয়ে সিগারেটটা নিল। 
আপনার সমস্যাটা কি?  

 

সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে, রাতের অন্ধকারকে কাঁপিয়ে খকখক করে কাশতে থাকে শ্রীধাম। তারপর দম নেওয়ার জন্য থামে। কাশির ধকলে তার পিঠ উঠা নামা করতে থাকে। দীর্ঘ সময় চলে যায় যেন। তারপর বলে, ডাক্তার বাবু আমাকে আপনি মেরে ফ্যালেন; এমন একটা অষুধ দেন যা খেলে আমার মৃত্যু হবে। আমি আর বাঁচতে চাচ্ছি না। 

 

আমি হকচকিয়ে যায়। আমি চেয়ে থাকি বৃদ্ধ মানুষটার দিকে। প্রশ্ন করি, আপনার ছেলে-মেয়েরা কোথায়? 
আমি পরিবার করিনি ছার। আমি অপয়া। আমার সাথে আত্মীয়তা করনি কেউ। 
অপয়া? এর মানে কী? 

 

আমি নিঃস্তব্ধ অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকি। তখন শুক্লাপক্ষের চতুর্দশী নিঃসঙ্গ এক জ্যোতির্ময় চাঁদ পশ্চিম আকাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে। আকাশের নিচে পাতলা কুয়াশার আভরণের আড়লে রূপবর্তী চাঁদ লুকোচুরি খেলছে; চাঁদের কণক আভা পদ্মপুকুরের শান্ত জলের নিচেও জ্বেলে দিয়েছে দীপাবলী। শ্রীধাম বাবু সেই আলোর দিকে তাকিয়ে বলে, আমাদের কোন সংসার নেই; কেউ আমাদের চোখের দিকি তাকায় না। কুটুম বানায় না। 

 

কিন্তু সমস্যা হল, এখন এই আজগুবি ফালতু গল্প শোনার মুড নেই আমার। আগামীকাল আমাকে একটা লম্বা জার্নি করতে হবে। কিন্তু একজন বয়ষ্ক লোককে রেখে চলে যাওয়াটা সৌজন্যবিরোধী। আমি দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে আরো একটা সিগারেট জ্বালাই। শ্লেষা আটকানো গলায় বিড়বিড় করে বলে শ্রীধাম, সারা জেবন লোকে ঘৃণা করেছে; ভয় করিছে, ভালবাসেনি কোনদিনই। রাতের নির্জনতায় তার কথাগুলো টাঁস লাগা কোন পশুর গলার ঘরঘর শব্দের মত শোনায়। এবার মরিয়া হয়ে লোকটা বলে, ডাক্তার বাবু, আপনি আমারে মেরি ফ্যালার ওষুধ দ্যান; এমন এক জুলাপ দ্যান, খাওয়া মাত্তর ঘুম-বড় আরামের ঘুম। দ্যান আমি ঢকঢক গিলি। 

 

সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে আমি কার্তিকের আকাশের দিকে ধোয়া ছাড়ি। মুহূর্তে আকাশটার প্রেমে পড়ে যাই। মাথার উপর অপূর্ব আকাশ, হালকা কুয়াশার চাদর গায়ে রূপালী জোসনা, নীচে পদ্মপুকুরে ফুটন্ত পদ্মের গোলাপি পাঁপড়িতে টলটলে শিশির, পুকুরের স্থির জলে গহীনের মাছ ঘায় মারে, তার শব্দ আর তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে চারধারে। পুকুরের কোণায় শিমূলগাছ থেকে এক রাতজাগা পাখি পাখা ঝাঁপটে উড়ে যায়। অন্ধকারে। আমার মনে এই অপূর্ব জগৎ বড় বিচিত্র। কত বিচিত্রতা, কত রহস্যময়তা ছড়িয়ে আছে আমাদের চারপাশে। আমি একটা মাঝারি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সামান্য গলা ঝেড়ে বলি, আরে আমি ডাক্তার! আমার কাজ মানুষকে বাঁচান, অসুখ সারানো।

 

আমার জন্মডায় ব্যামো ডাক্তার বাবু, আমরা ডাইনির বংশধর; শত বচ্চর আমার জেবন; ত্যাবে আমিই শেষ মানুষ আমার বংশের। ডাক্তার, তুমি আমারে মেরি ফ্যালাও, আমাকে মেরি বাঁচাও।

 

তখনই দূর থেকে দাপিয়ে আসা বাতাস পদ্মপুকুরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে বাতাসে আমিও কেঁপে উঠি। হুহু বাতাসে আসন্ন শীতের গন্ধ। কাঁটাতারের ওপাশে টহলগাড়ির হর্ণের শব্দ সেই বাতাসে ভেসে ছড়িয়ে পড়ে অনেক দূর। আমি সমগ্র বিষয়টাকে হালকাভাবে নিয়ে বলি, আপনার ভুল হচ্ছে; এই পৃথিবীতে পিশাচ, ডাইনি, রাক্ষস বলে কিছু নেই, কোনদিন ছিলও না। আপনি আপনার সমস্যাটা একটু খুলে বললেন কি? আমি কাল ঢাকা যাব, ঘুমাতে হবে। 

 

শ্রীধাম বাবু খল খলিয়ে হেসে উঠলেন। এ কোন স্বাভাবিক হাসি নয়। অদ্ভুত এক শব্দ! হাড়ে জাড়ে বাড়ি খেলে এমন এক ধরনের শব্দ তৈরি হয়। সেই অস্বাভাবিক শব্দ তরঙ্গে নৈশব্দ যেন আরো জমাট হল। হাসি থামিয়ে তিনি বলেন, ধারালো ছুরি দিয়ে জলের বুকে দাগ কাটলে কি সেই দাগ থাকে ডাক্তার আমি অপয়া, আমি পিশাচ বংশীয়। আমি মানুষের অমঙ্গল দেখতে পাই; যা বলি তা ফলে যায়; কিন্তু মঙ্গলময় কিছু ঘটাতে পারি না; আমি জানি আমাকে বাঁচতে হবে আরো দীর্ঘ সময় আমার পূর্ব-পুরুষের ইচ্ছা। ডাক্তার আমাকে তুমি মেরে বাঁচিয়ে দ্যাও।   

 

আমি তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, আপনার বৈকল্য ঘটেছে। এক ধরনের ইলুশনের মধ্যে আপনি বাস করছেন। এক ধরনের “ওভার ভ্যালিউড আইডিয়া” তৈরি করছে আপনার অবসন্ন  মন জগৎ। অবশ্য এ বিষয়টা আমার নয়। আমি ঢাকায় ফিরে দেশের বিশিষ্ট সাইক্রেটিস্ট ডা. ফারজানার সাথে আপনার বিষয়টি নিয়ে আলাপ করব। 

 

আবারো একটা দমকা বাতাস আমাদেরকে ছুঁয়ে যায়। সে বাতাসে শীতের গন্ধ মাখা। দূরে একটা কুকুর কেঁদে ওঠে। পদ্মপুকুরের কোণায় ঝটপট শব্দ হয়। হয়তো ঢোড়া সাপে ছোটমাছ ধরেছে। আমার সামনে পিছন ফিরে বসে থাকা লোকটা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশ দেখছে। আমার কথা সে শুনছে কি না আমি বুঝতে পারি না। আমার মায়া হয়, এই মনবৈকল্যসম্পন্ন বৃদ্ধ মানুষটির প্রতি। আমি আবারো বলতে থাকি, তাছাড়া, আমার রিসার্চ শেষ হয়নি এখনো। আগামী সপ্তাহে আবার আসব। তখন আমার সাথে একটা ডক্টরস টিম থাকবে; সম্ভব হলে ডা. ফারজানাকেও আসতে অনুরোধ করব।

 

শ্রীধাম বাবু উঠে দাঁড়ালেন। তারকাঁটার ওপাশে জ্বলে থাকা তীব্র হলুদ আলোর হালকা আভা শ্রীধাম বাবু গায়ে এসে পড়ে। তিনি আমার দিকে একপা এগিয়ে আসেন। আর তখুনি একটা ভীষণ দুর্গন্ধ আমার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। গন্ধটা খুবই অসহ্যকর, কিন্তু পরিচিত। আমি মনে করতে পারছি না দুর্গন্ধটা কিসের। আমি আমার স্মৃতিতে হাঁতড়াতে থাকি, তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকি। সে আমার মুখোমুখি হল এতক্ষণে। সামান্য আলোয় আমি শ্রীধাম বাবুর মুখ দেখতে পারছি না। কিন্তু তার চোখ দেখতে পাচ্ছি। বরফ দেওয়া ইলিশের মত অনুভূতিহীন স্থির দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চাঁদের সাথে মিশে থাকা বর্ডারের আলোয় শ্রীধামের চোখে ক্যাটেল ড্রাইভ হচ্ছে যেন। তার দৃষ্টি আমাকে গেঁথে ফ্যালে যেমন তীব্র আলো সাপকে বেঁধে রাখে। 

 

তারপর হঠাৎ শ্রীধাম বাবু হেসে ওঠেন। আমাকে চমকে দিয়ে শব্দ করে হেসে ওঠেন। সে হাসিতে আমি কিছুটা ঘাবড়ে যাই। এটা ঠিক হাসি নয়, বেশ কিছু ধাতব পয়সা একসাথে মেঝের উপর ফেললে যেমনটি শব্দ হয় ঠিক সেই রকম খণ্ডখণ্ড করে হেসে উঠে শ্রীধাম। হাসি থামিয়ে শ্রীধাম কেমন যেন অস্বাভাবিক কন্ঠে বলে, ডাক্তার, তোমার সাথে শহরের এই ডাক্তারের আর যোগাযোগ হবে না, তুমিও এই গাঁয়ে আর আসাতে পারবে না। আমার সাথে আর তোমার দেখা হবে না ডাক্তার, হা হা হা হা…

 

আর না; আমি উঠে পড়ি। অনেক হয়েছে। আকাশের দিকে তাকাই। তারায় তারায় খচিত আকাশ। চকচকে থালার মত চাঁদের চোখে ঘর পালানোর ইশারা। আমি ইবাদত সাহেবের বাড়ি দিকে হাঁটা দিই। কাল জার্নি করতে হবে অনেকটা পথ। সামনের দিকে পা বাড়াতেই আমার মনে পড়ল সেই দুর্গন্ধের সন্ধান। দুর্গন্ধটা আমার ভীষণ পরিচিত। ছাত্রাবস্থায় আমি যখন জাফর স্যারের এ্যনাটমি ক্লাসে ফরমালিন দেওয়া লাশ ওপেন করতাম তখন এই গন্ধটি মুহূর্তে  ছড়িয়ে পড়ত সারা ঘরে। আমাদের অ্যাপ্রনে এমকি শরীরেও লেগে থাকত সেই লাশের পচা গন্ধ। গোসল করেও যেতে না। শ্রীধাম তখনো খণ্ডখণ্ড করে হাসছে। সেই শব্দ যেন কাল থেকে কালন্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। 

 

আজ সতের বছর আমি বার্লিনে আছি। এখন বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। তুষারপাত আমাদের দেশের বৃষ্টিপাতের মত সুন্দর না। আমি শহরের একটা পানশালায় বসা। কেন জানি তুষারপাত হলেই আমার সেই গ্রামটির কথা মনে হয়। নেশাটা জমে উঠলে শ্রীধাম বাবুকে দেখতে পাই। মাংসপচা দুর্গন্ধটাও পাই। ও ভাল কথা, আমার আর ওই গ্রামে যাওয়া হয়নি। জানি না অপয়া শ্রীধাম বেঁচে আছেন কি না। 

 

আর একটা কথা, ডা. ফারজানার সাথে আমার আর দেখা হয়নি। কেন হয়নি জানি না। অনেক চেষ্টা করেও দেখা হয়নি। আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমি যখনই যতবার ডা. ফরজানার সেল নম্বর প্রেস করেছি ততবরাই আমার সেল ফোনটা আউট অব ওয়ার্ক দেখিয়েছে। টেলিফোনে ফোন করার চেষ্টা করেছি অনেক বা ফোনটা অযথা গোঁ গোঁ শব্দ করে। 

 

আরও আশ্চর্যের কথা, আমি জয়পুর গ্রামের গ্রাম্য ডাক্তার ইবাদ হোসেন সাহেবকে ফোন দিয়েছিলাম। অপয়া শ্রীধাম বলে এ নামের কোন লোক গ্রামে কোনদিনই ছিল না বলে জানিয়েছিলেন। 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ