নারী বৈষম্যের পথচলা
১৭ বছরের ‘মাধবী’ দু’দিন পর ১৮ বছর পূর্ণ হবে। মেধাবী মাধবী সেদিন কলেজ বিতর্কে সাফল্য পেয়ে খুশি মনে বাড়ি ফিরে এসে জানতে পারে ১মাস পর তার বিয়ে। পাত্রের বয়স তার দ্বিগুণ। ব্যবসায়ী পাত্রের সম্বন্ধ পেয়ে ছাড়তে চাননি আব্বা আর ভাইজান। মেয়েটি বিয়ের রাতে পালিয়ে যায় কিন্তু পরিবারের কথা ভেবে বেশিদূর যেতে পারে নি। ফিরে আসে এবং বিয়ে করে পরিবারের পছন্দের পাত্রকে। বর্তমানে স্বামীর আদেশে পড়ালেখা, ইচ্ছে ও আকাঙ্ক্ষা ছুড়ে ফেলে দিয়ে গৃহিণীর পেশা বেছে নিয়েছে।
মফস্বল শহরে বাস করা ‘রত্না আক্তার’ অভিজাত মুসলিম পরিবারের মেয়ে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয় বিধায় বেশ চিন্তা ভাবনার পর অনলাইনে কাপড় বিক্রির উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের আর্থিক সচ্ছলতার আপ্রাণ চেষ্টা চলছিলো। আশেপাশের মুরুব্বিবৃন্দ কিছুটা কটূক্তি, নিন্দা করলেও তা আমলে না নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন রত্না। দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন নিজের পায়ে। কিন্তু একদিন বাসায় ঢুকে ব্যবসার সব সরঞ্জাম ফেলে দেয় এলাকার নেতা। বলেন ‘এইসব নষ্টামি চলবে না’। নিজ চিন্তার আলোড়নে একজন উদ্যোক্তার গায়ে লেগে গেলো ‘পতিতা'র ট্যাগলাইন।
এমন অনেক কাহিনী জড়িয়ে আছে দেশের অলিতে গলিতে। জন্মের পরেই ‘মেয়ে হয়েছে’ শুনে ‘আহারে’ শব্দে রূপান্তরিত হওয়া মেয়েরা প্রায়ই স্বপ্ন আর ইচ্ছেগুলো বালি চাপা দিয়ে দেয় সমাজের চাপে। তবু পেটের তাগিদে, দম্ভের খাতিরে বা পরিবারের কথা ভেবে অনেকেই এগিয়ে যাচ্ছে কর্মক্ষেত্রে, সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।
“মেয়ে মানুষ, একটু নরম না হলে মানায়? মানানসই একটা ব্যাপার আছে না! যেমনটা ছেলেদের কাঁদলে মানায় না।” এই ভাবনা থেকেই শুরু হয় বিভিন্ন বৈষম্যের গল্প। যদিও বাংলাদেশ গত ২০ বছরে নারী ও মেয়েদের জীবন উন্নতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পাচ্ছে, এবং স্কুল নথিভুক্তিতে আরও বেশি লিঙ্গ সমতা বৃদ্ধি হচ্ছে। তা সত্ত্বেও ৮২ শতাংশ বিবাহিত নারী লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতায় ভোগেন এবং পরিব্যাপক যৌন সহিংসতা, পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জনে বাধা দেয়।
সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার বাল্যবিবাহের হার হ্রাস করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ১৮ বছর বয়সের আগেই ৫৯ শতাংশ মেয়েদের বিয়ে করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এগিয়ে। কর্মে নিযুক্তে নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত এবং স্বল্প বেতনে সীমাবদ্ধ রয়েছে। (সূত্র: ইউ.এস.এ.আই.ডি)
ইতিবাচক দিক হিসেবে, বাংলাদেশ বর্তমানে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের উপস্থাপিত গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্সে বেশ উন্নতি করছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে বাংলাদেশ যদিও প্রতিবেশীদের তুলনায় দেশ চার্টে শীর্ষে রয়েছে, তবু প্রতিবেদনটি পুরুষের তুলনায় নারীদের অসুবিধা, সাম্যের পরিমাণ এবং লিঙ্গের ভারসাম্যহীনতায় কোনো প্রভাব ফেলে না। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুসারে, মহিলা কর্মীশক্তির অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুরো এশিয় অঞ্চলে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে যে লিঙ্গ বৈষম্য, তা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার বিরোধী। কিন্তু বিশ্বব্যাপী, বাংলাদেশে মহিলা কর্মীদের অংশগ্রহণ ২০১৯ সালে ১১৩ তম তুলনায় বর্তমানে ১৩৫ তম অবস্থানে নেমেছে। সূচী অনুযায়ী, নারীর প্রতিনিধিত্ব ১০.৭ শতাংশ এবং পুরুষের ৮৯.৩ শতাংশ দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারীদের কর্মক্ষেত্রে সমতার জন্য আরো দুই শতাব্দীরও বেশি অপেক্ষা করতে হতে পারে, কারণ হিসেবে দেখা গেছে, সমতার চাহিদা বাড়ানো সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের হ্রাস হচ্ছে না। (রিপোর্ট এএফপি)
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, রাজনীতি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো ক্ষেত্রে যেহেতু নারীগণ ধীরে ধীরে বৈষম্য ব্যবস্থাকে বন্ধ করে দিচ্ছেন, সেখানে কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য ২২৭৬ সাল না হওয়া পর্যন্ত আশা করা যাচ্ছে না। ডব্লিউইএফ পূর্বাভাস অনুযায়ী নারীর গড়পড়তা অর্জন করতে ৯৯.৫ বছর সময় লাগবে।
যদিও কর্মক্ষেত্রে নারীর বৈষম্য দূরীকরণে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাসে দীর্ঘ সময়ের বিবৃত্তি দেয়, তবে নারীর শিক্ষাক্ষেত্রের এগিয়ে আসার রেকর্ডে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, হয়তো পরিসংখ্যানের সময়টা আরো হ্রাস পাওয়ার আশা দেখা যায়। যেখানে ২০০৮ সালে প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিলো ৫৭ শতাংশ, ২০১৭ তে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৯৫.৪ শতাংশ।
বলা হয়, শিক্ষাই সাফল্যের চাবিকাঠি। নারী যেখানে সমাজের দায়বদ্ধতা এড়িয়ে এগিয়ে এসেছে, সেখানে নারীকে রুখবে এবার কে?