নারীর হত্যা-আত্মহত্যা বন্ধে করণীয় কী?
সম্প্রতি পারিবারিক কলহ, দাম্পত্য সংকটসহ বিভিন্ন কারণে নারীর হত্যা ও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌতুক, বহুগামিতা, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক ও পুরুষতন্ত্রের সহিংস আচরণই এই ধরনের হত্যা ও আত্মহত্যার জন্য দায়ী। এ ধরনের অপরাধ বন্ধে সামাজিক-নৈতিক মূল্যবোধ ও মানবিক গুণাবলির চর্চা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে এই ধরনের অপরাধের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকরে রাষ্ট্রকে ব্যবস্থা নিতে হবে। একইসঙ্গে বাড়াতে হবে সামাজিক সচেতনতাও।
প্রধানত দুই কারণে নারীরা স্বামীর হাতে হত্যার শিকার হচ্ছেন বলে মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ, বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংক লি.-এর পরিচালক তানজিনা ইসমাইল। তিনি বলেন, ‘কারণ দুটি হলো যৌতুক ও বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক। যৌতুকের কারণে নারীকে হত্যা করে। যৌতুক চাওয়া একটি অপরাধ। যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি। প্রতিরোধ হিসেবে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে নারীর প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পুরুষ মানে প্রভু, নারী মানে ভৃত্য বা দাসী, এই মানসিকতা পরিবার ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে পরিহার করতে হবে।’
তানজিনা ইসমাইল আরও বলেন, ‘নারীর যোগ্যতা অনুসারে তাকে সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে। পারিবারিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে হবে। নারীদের উত্তরাধিকারী থেকে বঞ্চিত করা, স্বামী-স্ত্রী মতের মিল না হওয়া ও নারী হত্যার কারণ। মানুষের মানবিক মূল্যবোধ কমে গেছে। মানুষের মধ্যে শাস্তির ভীতি কমে গেছে। তারা মনে করে, ফোন করলে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বাঁচা যাবে। তাই তারা মনে করে, খুন করলে কিছুই হবে না।’
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের অপরাধ বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অপরাধীকে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। ধর্মীয় শিক্ষা, পারিবারিক বন্ধন আরও দৃঢ় করতে হবে।
যৌতুক যে একটি অপরাধ, সে বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পুরুষ মানেই প্রভু, নারী মানেই ভৃত্য; এই মানসিক অবস্থা পারিবারিক সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে পরিহার করতে হবে।
নারীর হত্যা-আত্মহত্যা প্রতিরোধে নারীকে তার যোগ্যতা অনুসারে সম্মান দেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধের আগে দেখতে হবে, সামাজিক দক্ষতার যদি অভাব থাকে, মানুষের মনের অবস্থা যেকোনো কারণে বিনষ্ট হতে পারে। আর তা যদি মোকাবিলা করা না যায়, তা হলে নারীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
এই প্রসঙ্গে তানজিনা ইসমাইল বলেন, ‘আর্থিক সমস্যা, মানসিক সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা, শারীরিক অসুস্থতা, সম্পর্কজনিত সমস্যা কিংবা কোনো দুর্ঘটনার প্রভাবেও নারী আত্মহত্যা করতে পারে। মূলত অপ্রতিরোধ্য ও অনিয়ন্ত্রিত দুঃখ ও কষ্ট থেকেই আত্মহত্যার মতো চিন্তা কাজ করে। আত্মহত্যার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নও জড়িত। তার বিষণ্নতার কারণ এবং সমস্যার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। সমাধানও করতে হবে। অবস্থা বুঝে দ্রুত তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে। বিশেষত ধারালো কোনো জিনিস ও তরল কেমিক্যাল জাতীয় জিনিস তার নাগালের বাইরে নিয়ে যেতে হবে। তার সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় বারবার আশ্বস্ত করতে হবে। জীবনকে উপভোগ করার জন্য তাকে উৎসাহ দিতে হবে। তার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করতে হবে। এতে নিজের চাপা কষ্ট বা ক্ষোভ নারী উগরে দিতে পারবে। পরিবারে সবার প্রতি সবার সহমর্মিতা যেন থাকে, সে বিষয়টি বড়দের খেয়াল রাখতে হবে।’
এই বিষয়ে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী আফরোজা ফেরদৌসী বলেন, ‘অপরাধ বাড়ছে। অপরাধ প্রবণতাও বারছে। আমাদের দেশে অপরাধ দিনদিন বেড়েই চলেছে। বর্তমান যে অবস্থায় আমরা আছি, সেখানে নরমাল কোনো বাকবিতণ্ডায় গেলেই হত্যা করে বসছে। এই ধরনের হত্যাকাণ্ডে নারীরাই বেশি শিকার হচ্ছেন। অনেক সময় ধর্ষণ করেও হত্যা করা হচ্ছে। সব চেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো, স্বামীর হাতেও নারীরা হত্যার শিকার হচ্ছেন।’
আত্মহত্যা প্রসঙ্গে আফরোজা ফেরদৌসী বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীরা হলো সবচেয়ে অসহায় ও নিরীহ। এই কারণেই নারীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ধর্ষণের শিকার একজন নারীকে সমাজ-সংসার কোথাও মেনে নেয় না। একটা সুস্থ, সাভাবিক জীবন দেয় না। ফলে ধর্ষণের শিকার নারী কোনো পথ না পেয়ে আত্মহত্যা করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মেয়েরা বিয়ের পরও নানাভাবে নির্যাতিত হয়। ফলে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সব শ্রেণীর নারীই সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার দিকেই এগিয়ে যায়। তবে, যাই হোক, সমাজের লোকজন এক হয়ে এগিয়ে এলে, জনসচেতনতা বাড়লে এবং পরিবারের লোকজন একে অন্যের পাশে থাকলে আমার মনে হয়, এসব সমস্যা ধীরে ধীরে কমে যাবে।’
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘এখন এই অপরাধগুলোতে কিশোররাই বেশি জড়িত হয়ে পড়ছে। এর কারণ, পরিবার থেকে তারা নিজাদের সরিয়ে রাখছে। বিভিন্ন সিরিয়াল দেখে সেগুলো ফলোআপ করে। এসব দেখে দেখে আস্তে আস্তে তাদের ব্রেইনে থেকে যায়, কোনো না কোনো জেদের ফলে সেটার প্রয়োগ তারা করে। আর অপরাধের সূচনা-ই হয় কিছু পরিবেশগত আর কিছু পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে।’
কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকর্মী রুমা মোদক বলেন, ‘আজও একটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সমাজে ঘটে যাওয়া সব সংকটের অসহায় শিকার সবচেয়ে বেশি হয় নারীরা। এজন্য মেয়েদের মনোবল আর আত্মসম্মানবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের সমাজ কাঠামো, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় শিক্ষা ব্যবস্থা নারীদের আত্মসম্মানবোধ তৈরি করতে ব্যর্থ। আমাদের অভিভাবকদের সবার আগে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। কন্যা সন্তানকে ছোট বেলা থেকে অন্তত এ শিক্ষাটাই দিতে হবে যে, তার জীবন খুবই মূল্যবান। এজন্য উপযুক্ত শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।’
কথাসাহিত্যিক ও উন্নয়নকর্মী কিযী তাহ্নিন বলেন, ‘‘নারী হত্যা কিংবা আত্মহত্যার শিকার হন, তিনি নারী বলেই। এ তো নতুন কিছু নয়। খনার জিভ কেটে ফেলা হয়েছিল, উপমহাদেশে যুগে যুগ ধরে ঘটে যাওয়া অনার কিলিং, নতুন তো নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়তো সামনে তুলে দেয় ঘটনাগুলোকে। ঘটনা কিন্তু চলছে, চলমান। যে ক্ষমতাতন্ত্রের মনস্তত্ত্বের ভেতরে আমাদের বাস, সেখানে নারীরা দুর্বল। যেখানে নারীকে এখনো মানুষ বলার সংস্কৃতিই তৈরি হয়নি, তাকে ডাকা হয় ‘মেয়েমানুষ’ নামে, যে সমাজ কাঠামো আমাদের ক্ষমতা চর্চা করতে শেখায়; সেখানে দুর্বলকে আঘাত করে জয়ী হওয়াটাই নিয়ম।’’
এই উন্নয়নকর্মী আরও বলেন, ‘নারী আঘাতের শিকার হয় সমাজের দ্বারা, পুরুষের দ্বারা এবং অবশ্যই অন্য নারীদের দ্বারাও। কখনো যার পরিণতি হত্যা কিংবা আত্মহত্যায় গিয়ে দাঁড়ায়। তাই হত্যা কিংবা আত্মহত্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এ অর্থ-সামাজিক কাঠামোর বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
নামমাত্র শিক্ষা এই পরিণতির সমাধান দেবে না। প্রয়োজন সেই শিক্ষা ও বোধের পরিবর্তন, যা নারীকে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করবে। সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সমাজে তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন করবে। অবশ্যই সমতার আইন প্রয়োজন। তাহলে অন্তত হত্যা কিংবা আত্মহত্যার মাত্রা কমবে।’