নতুন জীবন ধারায় স্বাগতম
ডিসেম্বর ২৩, ২০১৯। ঠিক যখন পুরো চীন প্রস্তুত হচ্ছে বর্ষ বরণ উদযাপনে জন্য, তখনই উহানে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। একে একে গত কয়েক মাসে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে বিশ্বের ১৮৮ দেশে। বিশ্বজুড়ে অর্ধকোটিও বেশি মানুষকে ইতোমধ্যে সংক্রমিত করেছে এই ভাইরাস। কেড়ে নিয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষের জীবন।
এই দৃশ্যের একটি অংশ বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার সংক্রমণ নিয়ে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে লকডাউনে ছিল পুরো দেশ। অফিস-আদালত, দোকানপাট, মার্কেট, এমনকি গণপরিবহন, সবই বন্ধ ছিল শুধুমাত্র এই ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে। বেশিরভাগ অফিসের কর্মীরাই কাজ করেছেন এবং এখনও অনেকেই করছেন নিজ নিজ বাড়ি থেকে। খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছেন না কেউ। এমনকি নিয়ম করে সীমিত করে দেওয়া হয়েছে বাইরের নিত্যপ্রয়োজনীয় কার্যক্রম। ফলে পাল্টে গেছে বহু বছর ধরে চলে আসা সেই জীবনধারা।
দেশের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হয়তো ধীরে ধীরে শুরু হবে সব ধরনের কাজ। শিথিল হতে শুরু করেছে লকডাউন। কিন্তু আগামীতে কি আমাদের জীবনধারা আগের মতো থাকবে? নাকি এই দীর্ঘ লকডাউন পাল্টে দিচ্ছে সব? অনেকেই অনেক কিছু বলছেন। কেউ ভাবছেন, লকডাউনের পর নতুন পৃথিবীতে মানুষ নতুন অভ্যাস আর জীবনধারাকে আপন করে নেবে, আবার অনেকেই মনে করছেন, হয়তো কিছুটা সময় লাগলেও আবার আগের জীবনধারায় ফিরে যাবে মানুষ। কেউ চিন্তা করছেন, লকডাউনের পর চাকরিটা থাকছে তো! আবার কেউ ভাবছেন, আসন্ন বিশ্ব মন্দাকে সামাল দেয়ার উপায় কি হতে পারে?
সম্প্রতি গণমাধ্যমের একটি প্রতিবেদনে চোখ আটকে গেল। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতির কারণে শহরের মানুষের আয় কমেছে ৭৫ শতাংশ গ্রামে কমেছে ৬২ শতাংশ। শুধু তাই নয়, নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ৩ কোটি ৬৯ লাখ মানুষ। প্রশ্ন হচ্ছে, লকডাউন শেষ হলে তাদের জীবন কি আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে?
লকডাউন অবস্থা থেকে কখন পুরোপুরি মুক্তি মিলবে তার কোনো সুস্পষ্ট ধারণা কেউ দিতে পারছেন না। তবে করোনাভাইরাস পরবর্তী বিশ্ব সম্পর্কে যেসব বিশেষজ্ঞ এবং ফিউচারোলজিস্ট এরই মধ্যে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন, তারা সবাই একটা বিষয়ে একমত, পৃথিবী আর আগের মতো নেই। গত কয়েক মাসে যা ঘটেছে, তার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।
এই মহামারির পর পাল্টে গেছে আমাদের কাজ-প্রাত্যহিক জীবন-ভ্রমণ-বিনোদন থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতি-রাষ্ট্র-সমাজ সবকিছু। প্রতিটি মুদ্রার যেমন দুইটি দিক থাকে, এরও তেমনি আছে। এর প্রথমটি হলো, করোনায় মানুষের অভ্যাসগত পরিবর্তন। আমাদের দেশের মানুষের দৈনন্দিন অনেক অভ্যাস বদলে যাবে এই করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার কারণে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, এখন সাধারণত কেউ রাস্তায় চলার পথে থুথু কিংবা ময়লা ফেলছে না। সামাজিক দূরত্ব যতটা সম্ভব মেনে চলার চেষ্টা আর বার বার হাত পরিষ্কার করাটা এখন অভ্যাস হয়ে গেছে আমাদের।
নিজ বাড়ি থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র, লকডাউন পরবর্তী সময়ে আরো সচেতন হচ্ছে মানুষ। অফিসের ডেস্কেও জায়গা করে নিচ্ছে অন্তত ছোট্ট একটি হ্যান্ড স্যানিটাইজার। সহকর্মীর থেকে শারীরিক দূরত্ব আবার বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। চায়ের দোকানে কিংবা ফুটপাথে আড্ডা থেকে গণপরিবহন, সব কিছুতেই মানার চেষ্টা করা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব।
তাই বলাই যায়, হাত পরিষ্কার, মুখোশ পরিধান কিংবা যেখানে সেখানে থুথু কিংবা ময়লা না ফেলা, সাধারণ মানুষের এই অভ্যাসগুলোর কিছু হয়তো থেকে যাবে লকডাউন পরবর্তী সময়ে। লকডাউন খুলে দেয়ার পর অন্তত কিছু সময় মানুষ মেনে চলবে সামাজিক দূরত্বের বিষয়ও।
শুধু শহর কিংবা গ্রামেই নয়, লকডাউন পরবর্তী সময়ে বদলে যাবে পর্যটন স্পটগুলোর চিত্রও। দেখা যাবে সমুদ্র সৈকতে মুখে মাস্ক পরে রৌদ্রস্নান করছে মানুষ। তাদের মাঝখানে হয়তো থাকবে প্লাস্টিকের পার্টিশন দেওয়া। অতিথিদের হোটেল রুম থেকে শুরু করে বিমান ভ্রমণ সবকিছুতেই আসবে পরিবর্তিত নিয়ম। রেস্তোরাঁগুলো হয়তো পরিকল্পনা করবে, তাদের টেবিলগুলো আরো দূরে দূরে বসানো যায় কিনা। অনেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের মজুত গড়ে তুলছে, কেউ বা বুফে খাবার বন্ধ রাখার কথা ভাবছে। সেদিক থেকে ভ্রমণ ছাড়াও পরিবর্তন আসবে বিনোদন জগতে। বড় বড় সিনেমা হলগুলোর মধ্যেও হয়তো আসবে পরিবর্তন। পাশাপাশি সিটে দুইজন বসে সিনেমা দেখবেন কিনা সেটা নিয়েও আসবে নতুন সিদ্ধান্ত।
শুধু আমাদের অভ্যাসই নয়, এই লকডাউনে বদলেছে প্রকৃতিও। প্রকৃতি ফিরে পাচ্ছে এর আগের যৌবন। পাখিরা কলতান করছে গাছে গাছে, সাগরে খেলা করছে ডলফিন, বিরল প্রজাতির নীল গাই হাঁটছে রাজপথ ধরে। সাগরের পানি হয়ে গেছে নীল। বাতাসে আকাশ ঢেকে দেয়া কালো ধোঁয়া নেই, আকাশ স্বচ্ছ আর নীল, বৃক্ষগুলো আরো সবুজ। কমে গেছে দূষণ। বিশ্বব্যাপী ভূ-প্রকৃতি ফিরে পেতে শুরু করেছে আপন প্রাণ। লকডাউন পরবর্তী দিনগুলোতেও হয়তো প্রকৃতির এই রূপের দেখা মিলবে বেশ কিছুটা সময় ধরে।
এখন আসা যাক মুদ্রার আরেক পাশে। এই দিকটায় রয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। কেননা আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে এর সাথে জড়িত। আর এই করোনা সংকটের ফলে মানুষের জীবনহানির পর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দিক বিশ্ব অর্থনীতি। বিশ্বের ১৮৮টি দেশ সংক্রমিত হলেও সংক্রমণের বিস্তৃতি রোধে বন্ধ বিশ্বের সবকটি দেশ। স্বাভাবিকভাবেই তাই বন্ধ তাদের সব রকম আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক লেনদেন। তাও আবার বেশ কয়েক মাস ধরে। সামনের দিনগুলোতে বিশ্ব অর্থনীতির আসলে কী দশা হবে, তার ভয়ংকর সব পূর্বাভাস এরই মধ্যে আসতে শুরু করেছে।
সম্প্রতি বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদন তুলে ধরে তেমনই কিছু ভয়ঙ্কর তথ্য। ওই প্রতিবেদনে প্রথমেই উঠে আসে আইএমএফ এর হুঁশিয়ারি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ১৯৩০ এর দশকের বিশ্বমন্দার পর এরকম খারাপ অবস্থায় আর বিশ্ব অর্থনীতি পড়েনি। তাদের মতে, এবছর বিশ্ব অর্থনীতি সংকুচিত হবে তিন শতাংশ। যদি মহামারি দীর্ঘায়িত হয়, বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে অগ্নিপরীক্ষার মুখে পড়বে। আর ধনী দেশগুলোর অর্থনীতি ২০২২ সালের আগে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না।
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্ন স্কুল অব বিজনেসের প্রফেসর নুরিয়েল রুবিনির পূর্বাভাস মতে, ১৯৩০ এর বিশ্ব মহামন্দা বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও গোটা পৃথিবী জুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এভাবে বন্ধ হয়ে যায়নি। বিশেষ করে চীন, যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপ এখন যেভাবে স্থবির হয়ে আছে। তার মতে, তিরিশের দশকের ‘গ্রেট ডিপ্রেশনের’ চাইতেও ভয়ংকর এক অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি দিনে দিনে বাড়ছে।
অনেক অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বাজার অর্থনীতির যে রমরমা অবস্থা বহু দশক ধরে দেখা গেছে, তার জায়গায় এক ধরণের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কিংবা অর্থনীতিতে সরকারি খাতের ব্যাপকতর অংশগ্রহণ সামনের বছরগুলোতে দেখা যেতে পারে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা গেলে একটা সময় হয়তো আসবে যখন লকডাউন পুরোপুরি উঠে যাবে। পুরোদমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হবে। তবে সাধারণ মানুষের জীবনধারায় আসবে পরিবর্তন। মানুষ হবে আরো সহনশীল, আরো সচেতন। সেই সাথে নিজেকে প্রস্তুত করে নেবে বিশ্ব মন্দার হাত থেকে অর্থনীতি আর নিজেকে বাঁচাতে। চলমান ট্রেন্ডে একেই হয়তো বলা হচ্ছে 'নিউ নরমাল লাইফ'।
তথ্যসূত্র: বিবিসি