করোনার করাল গ্রাসে যখন কৃষি, তখন কী করা!
অভূতপূর্ব আকস্মিক করোনা সংক্রমণে সমগ্র জীবনব্যবস্থা ও অর্থনীতি বিপর্যস্ত এক সংকটকাল অতিক্রম করছে। সারা দেশেই গৃহাবদ্ধ জীবন মাসাধিক কাল হতে চলেছে। গৃহাবদ্ধ জীবন হলেও, জীবনধারণে অন্নসংস্থানের চাহিদা তো অপরিহার্যভাবেই মেটাতে হচ্ছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক ও স্বনিয়োজিত কর্মজীবীদের প্রায় সাড়ে ৫ কোটি পরিবার এখন আয়-রোজগারবিহীন। সে কারণেই বিশেষভাবে দারিদ্র্যপীড়িত ও স্বনিয়োজিত রুটি-রোজগারে জড়িত মানুষদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য হাঁসফাঁস করছে এবং বেরিয়েও আসছে।
অপ্রত্যাশিত হলেও জীবনের বাস্তব চাহিদার কারণেই এখন ‘ঘর কইনু বাহির বাহির, বাহির কইনু ঘর’—এমন দোলাচলে অসংখ্য মানুষ। অর্থনীতির অচলাবস্থা চিন্তা করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দ্রুত শিল্প, সেবা, কৃষি, আমদানি-রপ্তানি খাতে স্বল্প সুদে (সুদে ভর্তুকি দিয়ে) প্রায় লক্ষাধিক কোটি টাকার পুনর্বাসন ও সহায়তা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। দরিদ্র পরিবারগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বিস্তৃতিকরণসহ সরাসরি অর্থ ও খাদ্যসহায়তার ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৫ কোটি পরিবারকে খাদ্যনিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। এদিকে অর্থনীতি সচল করতে হলে বাজার কার্যক্রম চালু ছাড়া অর্থনৈতিক পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
কৃষিপণ্য বাজারে ব্যবসায়ী সর্বাধিক নিয়োজিত, সর্বাধিক উদ্যোক্তা জড়িত। এই বিবেচনায় সরকার কৃষি পুনর্বাসনে সর্বাধিক গুরুত্ব ও সহায়তা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সার, কীটনাশক, সেচ, বিদ্যুতে নিয়মিত ভর্তুকি ৯ হাজার কোটি ছাড়াও কৃষি যান্ত্রিকায়নে সহায়তায় ২০০ কোটি টাকা; ফুল ও ফলচাষি, গবাদি, মত্স্য উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণসহায়তায় ৫ হাজার কোটি টাকা; বিএডিসিকে বীজ, চারা সরবরাহ বাবদ ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কৃষিশ্রমিকদের চলাচল উন্মুক্ত করা হয়েছে। এই চলমান বোরো ধান কর্তন ও সংগ্রহে কৃষি মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে যাচ্ছে। কৃষিমন্ত্রী মহোদয় ঝুঁকি নিয়েই হাওর এলাকা ও সরেজমিন পর্যবেক্ষণে বোরো এলাকাগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সেই সঙ্গে, পাট, আউশ বপন ও প্রসারে কৃষি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পদক্ষপ গ্রহণ করেছে। এবার অবশ্য পাটবীজের প্রাপ্তি সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমাদের ৮৫ শতাংশ পাটবীজ আসে ভারত থেকে। পুরো বীজ এখনো পৌঁছায়নি। কারণ ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন শর্তের কারণে ভারতীয় ট্রাকচালকগণ বেনাপলে প্রবেশ করতে পারছে না গত দুই দিন আগে পর্যন্ত। এ কারণে ১ হাজার টন বীজ নিয়ে অর্ধশতাধিক ট্রাক পেট্রোপোলে আটকে আছে (২৮ এপ্রিল)। কোয়ারেন্টাইন শিথিলের প্রশ্ন উঠেছে। অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও এ জটিলতা দেখা দেবে।
বর্ষা মৌসুমে শাকসবজি ফলন, আগামী আমন উত্পাদন এলাকা সম্প্রসারণের বিভিন্ন কর্মসূচি মন্ত্রণালয় গ্রহণ করছেন। সেই সঙ্গে বর্তমান বোরো চাষিরা কীভাবে ন্যায্য মূল্য পেতে পারে, কীভাবে বোরো ধান সংগ্রহ কার্যক্রম সফল হতে পারে এসব বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণে, কৃষি অর্থনীতিবিদ, বীজ ও কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবসায়ী, আমদানিকারক, সুপারমার্কেট ব্যবসায়ী, কৃষি প্রতিষ্ঠানপ্রধানগণ, কৃষির সঙ্গে জড়িত সাবেক আমলাদের নিয়ে কৃষিমন্ত্রী মহোদয় ২৭ এপ্রিল ২০২০ বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত মোবাইল ‘জুম অ্যাপ’-এ এক মিটিংয়ের আয়োজন করেন। সংযোগত্রুটিতে কেউ কেউ অবশ্য বলার সুযোগ পাননি বা পুরোটা বলতে পারেননি।
কৃষিশ্রমিকদের করোনা থেকে সুরক্ষা, কৃষি ও কৃষকের স্বার্থ সুরক্ষা, দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি রুখে দেওয়া?, সার্বিক অর্থনীতিতে স্বস্তি আনয়নে কৃষি খাতের জন্য যা করণীয় সেসব, একজন কৃষি অর্থনীতিবিদ হিসেবে আজকে নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ কিছু প্রাসঙ্গিক পরামর্শ সংক্ষেপে তুলে ধরছি :
১) ২৩ মিলিয়ন মে. টন বোরো ধান উত্পন্ন হবে আশা করা হচ্ছে। এটা মোট ধান উত্পাদনের ৬২ শতাংশ। এ ফলন ঘরে তোলার সবরকম প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। কৃষকের জীবিকা ও সমগ্র দেশবাসীর খাদ্য নিশ্চয়তায় এ করোনা কালেও কোনো বিকল্প ছিল না মাঠে না নেমে। প্রশাসন, পরিবহন ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এখন হাওর এলাকায় ৩ লাখ ২৫ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় হাওর এলাকায় ৪০০ কম্বাইন হারভেস্টার ও ৪০০ রিপার মেশিন বোরো ধান কেটে যাচ্ছে। ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৫ শতাংশ বোরো ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। নেত্রকোনা জেলায় সম্পন্ন হয়েছে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত। এটা চমত্কার সাফল্য। এই সাফল্য ধরে রাখতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনের উচিত হবে করোনা থেকে নিরাপদে রাখার সম্ভাব্য সব রকম স্বাস্থ্য শিষ্টাচার নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনীয় সুরক্ষা উপকরণ শ্রমিকদের বিনা মূল্যে সরবরাহ করা। প্রশাসন খাদ্য বিতরণ, গরিবদের তালিকাভুক্তি—এসব নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত, এটা হলো চ্যালেঞ্জের এক দিক। চ্যালেঞ্জের আরেক দিক হলো উত্পাদন কার্যক্রম ও বিপণন কার্যক্রম চালু রাখতে সর্বতো সহায়তা প্রদান। কর্মহীন গরিবদের আয়-রোজগারের পথ খুলবে না বাজার কার্যক্রমের পুনরুত্থান না ঘটলে। পণ্যের দাম প্রাপ্তিই এখন কৃষকের বড়ো চাওয়া। কৃষিই যেহেতু সবচেয়ে বড়ো শ্রমবাজার, সেখান থেকেই বাজারের পুনরুত্থান শুরু হবে এবং কার্যত বোরো সংগ্রহের মাধ্যমে তা ব্যাপক শুরু হয়েছে।
২) বোরো কর্তন শেষ কথা নয়। ঝাড়াই, বাছাই, শুকনো—এসব প্রক্রিয়া শেষ হয়ে চাল ভোক্তা কেন্দ্রগুলোতে নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন পরিবহন, ফড়িয়া, ব্যাপারী, পাইকার, মজুতদার, মিলার, আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ। মানে পুরো বাজার চেইন কার্যকর হওয়া। এই বাজারশৃঙ্খলা চালু না হলে কৃষক জরুরি ধান বিক্রি করতে পারবেন না, শহর ও ভোক্তা কেন্দ্রগুলোতে চাল দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠবে।
৩) চাল, ডাল, গম, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ফল, মসলা এগুলো আমদানি পণ্য এবং সামগ্রিক খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার অংশ। আমরা হাইব্রিড ধানের পুরোটা, পাটবীজ, আলুবীজ, গম, শাকসবজির উন্নত বীজের চাহিদার ৯৫ শতাংশ আমদানি করে থাকি। পাট ও পাটজাত পণ্য, চা, শাকসবজি, ফল, আলু চিংড়ি আমাদের রপ্তানি তালিকায় রয়েছে। এসব কৃষিপণ্যের দেশজ ও বাইরের বাজারেও সুযোগ নিতে বিপণন শৃঙ্খল চালু থাকতে হবে। এর জন্য স্থল, সমুদ্র এবং বিমানবন্দর (কার্গো-সুবিধা) চালু থাকা প্রয়োজন। কৃষির উত্পাদন ও বিপণন কার্যক্রম অবিচ্ছেদ্য, যার সংযুক্তি কৃষি উত্পাদন থেকে দেশ-বিদেশের খুচরা বাজার পর্যন্ত।
৪) কৃষিসংশ্লিষ্ট শিল্পকারখানা চালু রাখা। যেমন ফিড মিল, ওয়েল মিল, রাইস হাস্কিং, বরফ কল, মিট প্রসেসিং, চিনিকল, দুধ প্রক্রিয়াকরণ কারখানা, প্যাকেজিং, প্রিন্টিং, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, কৃষি-যন্ত্রপাতি মেরামত, অ্যাসেম্বেলিং ও প্রস্তুতকরণ কারখানাসমূহ, বেসরকারি পাটকলসমূহ দ্রুত খুলে দিতে হবে পূর্ণ স্বাস্থ্যসুরক্ষাবিধি নিশ্চিত করে। এরা সবই কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট বাজার কুশীলব (market players)।
৫) সুপার মার্কেট, পাইকারি বাজার, খুচরা বাজার, প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রের হাটবাজার দৈনিক বসবে। হতে পারে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। এতে ভিড় পরিহার করা সম্ভব হবে। তবে সংক্রমণে লালচিহ্নিত এলাকায় এর ব্যতিক্রম হতে পারে।
৬) জাতীয় এই দুর্যোগকালে কৃষিতে স্বাস্থ্যসুরক্ষা, শ্রমিক পরিবহন, পণ্য পরিবহন, সেচব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, নিশ্চিত বিদ্যুত্ সরবরাহ, কৃষির সব উপখাত, যেমন—মত্স্য, গবাদি খাতসমূহের সমন্বিত সিদ্ধান্ত ও সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। সেজন্য কৃষিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট সচিবদের নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব করছি।
৭) এই সময়ে আবহাওয়া ও বন্যা পূর্বাভাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্তত তিন দিন আগে ভারী বর্ষণ ও বন্যার সঠিক পূর্বাভাস পেলেও চাষিরা দ্রুত মাঠ থেকে ধান তুলে আনতে পারবে দরকার হলে পূর্ণ যান্ত্রিক সহায়তায়। অবশ্যই আমাদের পূর্বাভাস সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। তবু প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে আমাদের আবহাওয়া-বিষয়ক তাত্ক্ষণিক তথ্য বিনিময় সমঝোতা চুক্তি থাকা প্রয়োজন (যদি এমন চুক্তি থেকে থাকে তা হলে চমত্কার)। আমাদের ‘স্টেট অব দ্য আরট’ আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম আবশ্যই অর্জন করতে হবে। প্রত্যেক তিন ঘণ্টা অন্তর বৃষ্টিপাতের এলাকা, বৃষ্টির পরিমাণ, বন্যা সম্ভাবনা-বিষয়ক আবহাওয়া পূর্বাভাস রেডিও, কমিউনিটি রেডিও, টিভি, মোবাইল অ্যাপস কৃষক, সম্প্রসারণ কর্মী, ব্যবসায়ীদের কাছে ব্যাপক প্রচারে যেতে হবে।
৮) কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রম নিবিড় ও জোরদারকরণ। আলোচনায় উঠে এসেছিল কৃষি সম্প্রসারণ জেলা উপজেলা (হাওর অঞ্চল ছাড়া) কর্মকর্তারা সারা দেশে অফিস করছেন না, যেহেতু সাধারণ ছুটি চলমান রয়েছে। কৃষিমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী পাট, আউশ, গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি এবং পরবর্তী আমন এলাকায়ও উত্পাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের রয়েছে এবং সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। আকাঙ্ক্ষিত এসব গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে কৃষকের সম্পৃক্ততা নিশ্চিতকরণে কৃষি সম্প্রসারণ ও কৃষিসংশ্লিষ্ট সব এজেন্সি (বিশেষভাবে বিএডিসি) জেলা উপজেলা ও স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অফিস কর্যক্রম খোলা রাখা অতি প্রয়োজনীয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনা থেকে জীবন রক্ষায় ব্যাপৃত রয়েছে, ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের হুমকি থেকে জীবন রক্ষার প্রয়োজনে সব কৃষি, পশুপালন ও মত্স্য কর্মকর্তাদের কর্তব্যরত থাকা জরুরি। আমার এ প্রস্তাবনাসমূহ হতে পারে বর্তমান পরিস্থিতিতে পুনর্বাসন কর্মসূচির প্রথম ধাপ।
জীবন রক্ষায় মহামারি সংক্রমণ ঠেকানো ও ব্যাপক ক্ষুধা থেকে মুক্তি দুইই এ অভাবিত মহাযুদ্ধে জরুরি। বাস্তবে জীবন ও জীবিকা অবিচ্ছেদ্য।
লেখক: অর্থনীতিতে একুশে পদকপ্রাপ্ত সামষ্টিক পরিকল্পনাবিদ