Skip to content

১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বাবলম্বী নারীরও অভিভাবক কেন পুরুষ হতে হবে?

দেশের অনেক নারীই এখন স্বাবলম্বী। চাকরি করেন। উপার্জন করেন। অনেকেই উদ্যোক্তাও। ব্যবসা করেন, কারাখানার মালিকও। তারা শত-শত মানুষের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থাও করেন। কিন্তু অন্যান্য সাধারণ নারী, গৃহবধূর মতো তাদেরও একজন পুরুষ অভিভাবক ছাড়া সমাজে নানামুখী প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী থেকে শুরু করে সমাজের পেশাজীবী নারীরা বলছেন, এই নিয়মের পেছনে পুরুষতন্ত্র দায়ী। আরও দায়ী নারীবিদ্বেষী, নারীস্বাধীনতার অন্তরায় ব্যক্তি-সংঘ-প্রতিষ্ঠানগুলোও।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক আয়েশা আক্তার বলেন, ‘নারী কি সত্যিই একা চলতে পারে না? নারী কি নিজের বা পরিবারের দায়িত্ব নিতে সক্ষম নয়? নারীর অভিভাবক সবসময় কোনো না কোনো পুরুষকেই হতে হবে? একুশ শতকের এই সময়ে যখন আমাদের দেশের নারীরাই দেশ শাসন করছে, পরিবারকে ছেড়ে একা এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করছে কিংবা পড়াশোনা ও কাজের জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে, সেখানে এই প্রশ্নগুলর উত্তর দেওয়া সত্যিই কঠিন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সমাজের একটি সাধারণ চিত্র, যা আমরা সচরাচর দেখি তা হলো একজন নারী শিশু ও কিশোর বয়সে তার বাবার সঙ্গে, তরুণ বয়সে ভাই কিংবা বন্ধুর সঙ্গে চলাফেরা করছে। তার সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বাবা অথবা বড় ভাই। বিয়ের পর ওই নারীর অভিভাবক হয়ে যায় তার স্বামী। আর শেষ বয়সে ছেলে সন্তান।’

আয়েশা আক্তার আরও বলেন, ‘একজন নারীর শিক্ষা, চাকরি কিংবা বিয়েসহ সব বিষয়ে তার নিজের ইচ্ছা গুরুত্ব পেয়েছে, এমন চিত্র এখন পর্যন্ত আমাদের সমাজের সব স্তরে দেখা যায় না। অথচ একজন শিক্ষিত-অশিক্ষিত স্বাবলম্বী নারী অনেক ক্ষেত্রেই তার পরিবারের আর্থিক দায়িত্ব নিয়ে নেন, যেখানে পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব নেওয়াতে নানা রকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সমাজ ব্যবস্থাই আসলে নারীকে তার প্রাপ্য সন্মান ও দায়িত্ব পালনে বাধা দেয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় একজন নারী তার পরিবার ও সন্তানের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক ও দৃষ্টিকটু চোখে দেখা হয়! পাশাপাশি ধর্মীয় গোঁড়ামি, কিছু কুসংস্কার ও সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি, সেটি হলো নিরাপত্তাহীনতা। এই নিরাপত্তাহীনতা নারীকে তার দায়িত্ব পালন থেকে বঞ্চিত করছে। তাই সামাজিক নিরাপত্তা, উদার মানসিকতা ও প্রকত মূল্যবোধ জাগরণের মাধ্যমে নারীদের মত-প্রকাশ ও দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ বাড়াতে হবে। তাহলে একজন নারী শুধু পরিবার নয়, আর্থ সামাজিক অবকাঠামোগত পরিবর্তন, উন্নত সমাজ গঠন ও আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।’

নারীর জানালার সম্পাদক ও তথ্য চিত্র নির্মাতা নাজনীন দীপা বলেন, ‘জন্মলগ্ন থেকে জেনে আসছি, আমাদের সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। যে সমাজে নারীদের একজন নারী হিসেবে কোনোভাবেই যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয় না। আমার প্রশ্ন হলো, এজন্য কি পুরুষরাই কেবল দায়ী? আমি বলবো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এখানে একটি বড় কারণ। কেবল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে একজন নারী সমাজে সাবলম্বী হয়েও স্বাধীনভাবে নিজের দায়িত্ব নিতে পারছে না বললে হবে না। আসলে এই সমাজ তাকে পারতে দেয় না। মূলত,একজন নারী তার ঘর থেকেই অবহেলিত হয়। আধুনিক যুগে পা রেখেও স্বামীভক্তির দাসত্ব যেন রক্তে মিশে গিয়েছে পুরো নারীজাতির। বিশেষ করে আমাদের এই অঞ্চলে। শিক্ষিত হয়েও পরাধীনতার শেকল তার পায়ে পরা থাকে আজন্ম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চান না নারীরা ঘরের বাইরে থাক। আদিম যুগের চিন্তাচেতনা উন্নতভাবে ভর করেছে আমাদের সমাজের ওপর। একজন শিক্ষিত সাবলম্বী নারী হয়েও তার কোনো মুক্তি নেই আমাদের এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কাঠগড়ায়।’

নাজনীন দীপা আরও বলেন, ‘কেবল সামাজিক লিঙ্গবৈষম্যের কারণে দীর্ঘকাল ধরে নারী চাইলেও নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারে না। কেবল সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমাদের সমাজে এমন কিছু মূল্যবোধ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বিরাজমান, যা পুরুষকে প্রবল,নারীকে দুর্বল,পুরুষকে প্রধান,নারীকে সহকারী হিসেবে ভাবার অনুষঙ্গ মনে গেঁথে দিচ্ছে। মনে আছে নিশ্চয়,সীতার নিরাপত্তায় এঁকে দেওয়া হয়েছিল লক্ষণগণ্ডি। গণ্ডি পেরোনো মানা। কারণ গণ্ডির ওপারেই রাক্ষসকুল! ওপারেই ওঁৎপাতা সমূহবিপদ। অথচ এই একুশ শতকে আমরা তো রাক্ষস-সংকুল রাজ্যে বাস করি না। তাহলে কেন আজও সমাজের মনস্তত্ত্বে নারীর জন্য আঁকা থাকে লক্ষণ-গণ্ডি? এর কারণ অবশ্যই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। বদলের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে দরকার সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগ। না হলে কোনোভাবেই নারী তার নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারবে না। তাকে আজীবন পুরুষকেই অভিভাবক হিসেবে মেনে নেওয়ার এবং মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা পোষণ করতে হবে।

আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা ব্র্যাক-এর জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রোগ্রামের রিজিওনাল ম্যানেজার মাহেরা বিনতে রফিক বলেন, ‘আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীদের দুর্বল অবস্থান অতীত থেকেই ভীত গড়েছে; এই ধ্যান-ধারণা ও আচরণ চর্চার। অতীতে মূলত অর্থনৈতিক সক্ষমতা না থাকায় জীবন ধারনের সবগুলো প্রয়োজনের জন্য নারী হয়ে থাকতো কারও না কারও মুখাপেক্ষী। আর সেখান থেকে আসে কারও না কারও তার অভিভাবক হিসেবে উক্ত দায় দায়িত্ব পালনের প্রসঙ্গ।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই ধারণা এত প্রাচীন ও আমাদের মনে এতটা বদ্ধমূল যে, এখন একজন নারী অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম এবং নিজের যাবতীয় প্রয়োজন মিটিয়ে বরঞ্চ অন্যের দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে পারলেও আমরা তাকে অভিভাবক ছাড়া দেখতে প্রস্তুত নই, কিংবা মানতে পারি না। তাকে কোনো না কোনো পুরুষ অভিভাবকের অভিভাবকত্বে না দেখলে আমরা তাকে পরিপূর্ণ মনে করতে পারি না। এই আচরণ দেশের বিভিন্ন সিস্টেমেও রয়ে গেছে। এখনো কোথাও কোথাও নারীকে ভেরিফায়েড হতে হয় তার কোনো না কোনো পুরুষ অভিভাবকের দ্বারা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রাতে রাস্তায় দেখলে একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ নারীকেও পুলিশ হেনস্তা করতে ছাড়ে না তার ‘অভিভাবক’ জানে কি না, এই প্রশ্ন তুলে। অথচ, একজন পুরুষকে কিন্তু কখনো এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না। ‘তুমি নারী তোমার অভিভাবক কে?’ এই প্রশ্ন আমাদের কথায় এবং আচরণে ততদিন পর্যন্ত থেকে যাবে, যতদিন না পর্যন্ত তাকে আমরা এজন আলাদা এবং সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে ভাবতে পারবো।’

মেহেরপুর জেলা শিশু অ্যাকাডেমির সহকারী আবৃত্তি প্রশিক্ষক ও নাট্যকর্মী আয়েশা আক্তার বলেন, ‘ছোট জেলা মেহেরপুরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা, দুইবোন আমরা। বাড়ির বড় মেয়ে হিসেবে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়া বাড়ির বিভিন্ন কাজ করা সবই করতে দিতেন মা-বাবা দুজনেই। যখনেই কাউকে বলতে শুনতাম কোনো ভাই নেই তোমাদের (অবশ্য আজও শুনি), মনে হতো ভবিষ্যতের জন্য দুই বোন থাকা অপরাধের! চলার পথে পুরুষের সঙ্গে চলাচল হবেই স্বাভাবিক, কিন্তু তারাই কেন নির্ভরশীলতার কেন্দ্রবিন্দু হবে, বুঝতে বেশ ভ্যবাচ্যাকা খেতাম।’

আয়েশা আক্তার আরও বলেন, ‘থিয়েটারকর্মী হিসেবে প্রচুর পুরুষ সহকর্মী পেয়েছি, যারা নারীদের সমান চোখে বিচার করতে পারেন, আবার এমনও দেখেছি সহকর্মীদের সমস্যা না হলেও নারী হিসেবে পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মেলানো অন্যেরা বাঁকা চোখে দেখেন। বাবা মারা গেলে ছেলে সন্তান না থাকার আফসোস মায়ের মাঝেও দেখেছি। কিন্তু মা চরম অসুস্থ থাকার অবস্থায় দুই বোন মিলে বিপদ উদ্ধারে ছিলাম বদ্ধপরিকর। বাবা-ভাই-স্বামী যেই থাকুক না কেন, বর্তমান সমাজে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি অনস্বীকার্য। যেন জীবনের বড় যেকোনো সিদ্ধান্তে সে নিজে কী চায়, কী পদক্ষেপ তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করা যায়, তার জন্য পুরুষদের অপেক্ষা না করতে হয়। এই যান্ত্রিকতার দুর্গম সময়ে নারী যত পুরুষের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাবে, ততই মঙ্গল। মেধা মননে যখন স্রষ্টা নিজেই বিভেদ রাখেননি, তবে কেন সে তা কাজে না লাগিয়ে পরনির্ভরশীল কীটের মতো আস্তাকুঁড়ে পড়ে থাকবে?’

এই নাট্যকর্মী আরও বলেন, ‘‘বাবা-ভাই-স্বামী-চাচা-মামাকেই নারীর জীবনের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব পালন করতে হবে কেন? যদি শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে নারীরা এগিয়ে যেতে পারে, তবেই তাদের অভিমতের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।
আমি ছেলে সন্তানের মা, তবে অনেককে দেখেছি শুধু বংশের বাতি হিসেবে ছেলে জন্মদানে চরম উৎসাহী। মেয়েরা যেন সেই বাতির তলার অন্ধকার! একটি মেয়েকে পরিপূর্ণ শিক্ষায় শিক্ষিত করে পরিবার সমাজ ও দেশের সম্পদ হিসেবে গড়ে তুললে ‘পুত্রসন্তান শেষ বয়সের লাঠি’ না হয়ে কন্যা সন্তান শেষ বয়সের সম্পূর্ণ সুখের নীড় হয়ে উঠতে পারে।’’

অনন্যা/এআই

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ