সাহিত্যের চোখে মুক্তিযুদ্ধকে দেখি
আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত গৌরবাহ্নিত ও তাৎপর্যম-িত ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা। যে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে জড়িয়ে আছে আমাদের ত্যাগ ও গৌরবের ইতিহাস। যার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাংলা সাহিত্য।
আরও একটু গুছিয়ে বলা যায়, ১৯৭১ কেবল আমাদের একটি স্বাধীন বাংলাদেশই উপহার দেয়নি। আমাদেরকে বাংলা সাহিত্যের বিশাল সম্ভারে করেছে ধনাঢ্য। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে বাংলার অসংখ্য কবি -সাহিত্যিক চারন করেছেন সাহিত্য জগতে।
আমরা যখন বিশ্ব সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাকাই তখনও স্পষ্ট দেখা যায় কালের বাঁকে বাঁকে সাহিত্যের নতুন নতুন ধারা সৃষ্টি হয়েছে- যেমন ইংরেজী সাহিত্যে রয়েছে চসারেরর ধারা, সেক্সপিয়ারের ধারা, ক্লাসিকাল ধারা , রোমান্টিক ধারা, ভিক্টোরিয়ান যুগ এবং আধুনিক যুগ। তেমনি বাংলা সাহিত্যেও এমন বিভিন্ন ধারা রয়েছে।
যদিও ১৯৪৭ সাল অর্থাৎ দেশবিভাগের পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৭১ সালের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সাহিত্য ধারায় তেমন কোন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়নি। তবে এটা সত্য ১৯৪৭ সালে রাজনৈতিক ভাবে দেশ বিভাগ বাংলাদেশের সাহিত্যে বিবর্তন ঘটিয়েছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে জন্ম লাভ করার পর বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য কোন কোন ক্ষেত্রে স্পষ্টতর হয়ে ঊঠেছে। সেময় থেকে বাঙালি মুসলমান ভাষা- সাহিত্য- সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে শুরু করেছে ।
তখন দেখা যায়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনের গৌরবগাঁথার আবেগময় স্মৃতি ও গৌরবগাঁথা ইতিহাস নতুনরূপে সাহিত্যিকের মন ও মস্তিস্ককে আলোড়িত করেছে।
আজও সেই রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সাহিত্য চর্চা মাতৃরূপী দেশকে শত্রুমুক্ত রাখার অসীম সাহস ও শক্তি যোগায়।
লক্ষ করলে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে আমাদের সাহিত্যিকগন তাদের সাহিত্যে অজস্র সোনার ফসল ফলিয়েছেন। আমাদের কবিতা, ছোটোগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং নাটকসহ সাহিত্যের সকল শাখায় অনন্যভাবে উঠে এসেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের মাধ্যমে আমাদের দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, শৌর্য-বীর্যবত্তা এবং অসীম সাহসী গুণের সুপরিচয় যুগ-যুগান্তর ব্যাপী বিধৃত হয়ে এসেছে। সুতরাং স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলা সাহিত্য অনন্য বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাহিত্যে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নাটকের তুলনায় কবিতায় সবচেয়ে বেশি মর্মস্পর্শী হয়ে প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানী স্বৈরশাসনবিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক জীবনের মতো শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের গণজাগরণ ও বৈপ্লবিক চেতনা আমাদের সাহিত্যকে আলোকিত করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে শহীদ আনোয়ার পাশার (১৯২৮-১৯৭১) রাইফেল রুটি আওরাত (১৯৭৩), শওকত ওসমানের (১৯১৭-১৯৯৮) জাহান্নাম হইতে বিদায় (১৯৭১), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩), দুই সৈনিক (১৯৭৩) এবং জলাঙ্গী (১৯৭৬), শওকত আলীর যাত্রা (১৯৭৬), রশীদ হায়দারের (১৯৪১) খাঁচায় (১৯৭৫), অন্ধ কথামালা (১৯৮১) ও নষ্ট জোছনায় এ কোন অরণ্য (১৯৮২), মাহমুদুল হকের (১৯৪০) জীবন আমার বোন (১৯৭৬), সেলিনা হোসেনের (১৯৪৭) হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬) ও যুদ্ধ (২০০৫), সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের জীবনতরু, রাবেয়া খাতুনের ফেরারী সূর্য (১৯৭৪), আমজাদ হোসেনের (১৯৪২) অবেলায় অসময় (১৯৭৫), মির্জা আবদুর হাইয়ের ফিরে চলা (১৯৮১), রশীদ করিমের আমার যত গ্লানি (১৯৭৩), মাহবুব তালুকদারের অবতার (১৯৭৩), ঝর্না দাশ পুরকায়স্থের বন্দি দিন বন্দি রাত্রি (১৯৭৬), আহমদ ছফার (১৯৪৩) ওঙ্কার (১৯৭৫) ও আলাতচক্র (১৯৯০), হুমায়ূন আহমেদের (১৯৪৮- ) শ্যামল ছায়া (১৯৭৩), নির্বাসন (১৯৮৩), সৌরভ (১৯৮৪), ১৯৭১ (১৯৮৬), আগুনের পরশমনি (১৯৮৮), সূর্য্যের দিন (১৯৮৬), অনিল বাগচীর একদিন (১৯৯২) এবং জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প (২০০৬), সৈয়দ শামসুুল হকের নীল দংশন (১৯৮১), নিষিদ্ধ লোবান (১৯৮১), দ্বিতীয় দিনের কাহিনী (১৯৮৪), বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ (১৯৮৯-৯০) এবং এক যুবকের ছায়াপাত (১৯৮৭), ত্রাহি (১৯৮৮), হারুণ হাবীবের প্রিয়যোদ্ধা, প্রিয়তম (১৯৮২), হরিপদ দত্তের অক্ষর (প্রথম খ- ১৯৮৯, দ্বিতয়ি খ- ১৯৯১), আবু জাফর শামসুদ্দীনের দেয়াল (১৯৮৬), ইমদাদুল হক মিলনের মহাযুদ্ধ, ঘেরাও, নিরাপত্তা হই, বালকের অভিযান, কালো ঘোড়া, দ্বিতীয় পর্বের শুরু এবং রাজাকারতন্ত্র, মঈনুল আহসান সাবেরের পাথর সময় (১৯৮৯), সতের বছর পর (১৯৯১), কবেজ লেঠেল, শহীদুল জহীরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (১৯৮৮), আনিসুল হকের মা (২০০২), শাহীন আখতারের তালাশ (২০০৫), আবদুর রউফের মুক্তস্নান (২০০৭), হরিপদ দত্তের ঈশাণে অগ্নিদাহ (১৯৮৬) ও অন্ধকূপে জন্মোৎসব (১৯৮৭), রাবেয়া খাতুনের মেঘের পরে মেঘ, হানিফের ঘোড়া, ফেরারী সূর্য ও ঘাতক রাত্রি, আল মাহমুদের উপমহাদেশ, মঞ্জু সরকারের তমস (১৯৮৪) ও প্রতিমা উপাখ্যান, মহীবুল আজিজের বাড়ব (২০১৪) ও যোদ্ধাজোড় (২০১৪) ইত্যাদি অন্যতম। শহীদ আনোয়ার পাশার (১৯২৮-১৯৭১) রাইফেল রুটি আওরাত (১৯৭৩) একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সুদীপ্ত শাহীন লেখক আনোয়ার পাশারই প্রতিচিত্র। ২৫ মার্চের সেই ভয়াল কালোরাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের চিত্র ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। শওকত ওসমান মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে লিখেছেন চারটি উপন্যাস। জাহান্নাম হইতে বিদায় (১৯৭১), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩), দুই সৈনিক (১৯৭৩) এবং জলাঙ্গী (১৯৭৬)। জাহান্নাম হইতে বিদায় উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের মাতৃভূমি থেকে পলায়নপর মানসিকতা রুপায়িত। জাহান্নামের প্রতীকে শত্রুকবলিত তিনি বাংলাদেশকে দেখেছেন। এই উপন্যাসে শিক্ষক গাজী রহমানের মানসলোকই পুরো উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে। শওকত ওসমানের কৃতিত্ব এখানেই যে তিনি মানুষের অসহায়তা ও প্রতিরোধের চিত্র আঁকতে পেরেছেন। হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো- ‘মেশিন গানের গুলি ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটছে। কোলাহল, আর্তনাদ। …সঙ্গিনের আগায় গাঁথা শিশু চীৎকাররত, যখন অগ্নিবোমা তাকে নিমেষে কাবাব বানিয়ে দিলে। জল্লাদ অট্টহাসি পৈশাচিক উল্লাসের শিকার হওয়ার পর পাঞ্জাবি সেনানীর ধর্ষণেচ্ছু লালাসিক্ত ঠোঁটে ফিরে গেল…প্রলয়ের প্রকম্পন মর্টারের আওয়াজে রণতরীর শেল বর্ষণে, কামানের হুঙ্কারে …অসহায় দীর্ঘশ্বাসের গতিক্ষুব্ধ বাতাস যেখানে নিরর্থক।’
শহীদ আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত (১৯৭৩) আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতার বস্ত্তনিষ্ঠ শিল্পরূপ। উপন্যাসটির রচনাকাল ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাস। উপন্যাসের নায়ক সুদীপ্ত শাহীন প্রকৃতপক্ষে আনোয়ার পাশারই আত্মপ্রতিবাসের প্রতিচিত্র। পঁচিশে মার্চের সেই কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়াল, নির্মম, জান্তব নখরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত সময়ের অনুপুঙ্খ উপস্থাপন ঘটেছে এই উপন্যাসে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিমন্ডলে যে অমানুষিক বর্বরতা-তান্ডবলীলা চলেছিল, আনোয়ার পাশা বাস্তববাদী শিল্পীর নিরাসক্তিতে তাকে রূপদান করেছেন। সুদীপ্ত শাহীনের অভিজ্ঞতায় সেই বীভৎস, দীর্ণ নগ্ন রূপ পাঠককে আতঙ্কিত ও শিহরিত করে বটে, কিন্তু প্রত্যক্ষ অবলোকনের অবিকল উন্মোচন আমাদের জীবনের এক বস্ত্তসত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, যার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম।
শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের সংখ্যা চার : জাহান্নম হইতে বিদায় (১৯৭১), নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩), দুই সৈনিক ( ১৯৭৩) এবং জলাঙ্গী (১৯৭৬)। যে ব্যাপক, গভীর ও সমগ্রতাস্পর্শী জীবন-অনুধান উপন্যাস নির্মিতির মৌল শর্ত, মুক্তিযুদ্ধ আশ্রয়ী উপন্যাসে শওকত ওসমান সে-শর্ত পূরণে যেন অমনোযোগী। জাহান্নম হইতে বিদায় উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার প্রথম পর্যায়ে স্বদেশভূমি থেকে পলায়নপর মানসিকতা রূপায়িত হয়েছে। দুই সৈনিক ও নেকড়ে অরণ্য মুক্তিযুদ্ধকালীন বিচ্ছিন্ন ঘটনার গ্রন্থমাত্র। দুই সৈনিক উপন্যাসে মখদুম মৃধার পাকহানাদার বাহিনীর প্রতি আনুগত্য সত্ত্বেও তার দুই কন্যা পাকিস্তানি সৈনিকের লালসার শিকারে পরিণত হয়। এবং পরিণামে মুখদুম মৃধা আত্মহত্যা করে। জলাঙ্গীতে মুক্তিযোদ্ধার ভীরুতা ও কাপুরুষতাই শওকত ওসমানের বিবেচ্য প্রসঙ্গ।
শওকত আলীর যাত্রা (১৯৭৬), রশীদ হায়দারের খাঁচায় (১৯৭৫) ও অন্ধ কথামালা (১৯৮১), মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন (১৯৭৬), সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬), সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের জীবনতরু, রাবেয়া খাতুনের ফেরারী সূর্য (১৯৭৪), আমজাদ হোসেনের অবেলায় অসময় (১৯৭৫), মিরজা আবদুল হাইয়ের ফিরে চলো (১৯৮১) প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধের উপকরণনির্ভর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। গ্রাম এবং নগরজীবনের পটভূমিকায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের বিচিত্র প্রসঙ্গ উল্লিখিত উপন্যাসসমূহে বিন্যস্ত হয়েছে। যাত্রা উপন্যাসে ২৫শে মার্চ-পরবর্তী কয়েকদিনের ঘটনার উপস্থাপন ঘটেছে। অস্তিত্ব প্রশ্নে শঙ্কিত শহর থেকে গ্রামের দিকে ধাবমান জনস্রোতের অন্তর-বাহির অনেকটা সার্থকতার সঙ্গে রূপায়িত হয়েছে এ-উপন্যাসে। অধ্যাপক রায়হান তার স্ত্রী বিনু, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাসান, ছাত্রী লীলা এবং আরও কয়েকটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে যুদ্ধকালীন সময়ের তীব্র উত্তেজনা ও অস্থিরতা রূপায়িত হয়েছে। রায়হানের মধ্যে আত্মসুখসন্ধান এবং তজ্জনিত গ্লানিবোধ থাকলেও হাসানের চরিত্র আশাবাদী এবং মীমাংসিত। যুদ্ধজয়ের সুতীব্র আকাঙ্ক্ষায় তার উচ্চারণ : ‘এখন আমাদের জীবনের আরেক নাম হয়ে উঠেছে স্বাধীনতা।’ রশীদ হায়দারের খাঁচায় স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে অবরুদ্ধ নগরজীবনের আলেখ্য। ঢাকা শহরে অবরুদ্ধ ও শঙ্কিত জাফরের মানস-প্রতিক্রিয়ার চিত্র : ‘সমস্ত অনুভূতি নিষ্ক্রিয় হয়ে রাস্তার মতো হয়ে গেছে, যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে আমেরিকা, খাঁচাটা আরো সংকুচিত হয়ে আসছে, খাঁচার চারপাশে উদ্যত মারণাস্ত্র।’ বাইরের জগতে নিষ্ক্রিয় কিন্তু অন্তর্জগতের ক্রিয়াশীলতায় এ-উপন্যাসের অধিকাংশ চরিত্রই যুদ্ধকালীন সময়ের একটা অবস্থাকে অভিব্যক্ত করেছে। অন্ধ কথামালা উপন্যাসের নায়ক বেলাল হোসেন একজন শিক্ষিত গ্রামীণ যুবক। একাত্তরের পঁচিশ মার্চের নিকটবর্তী সময়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
তাদের এলাকার সঙ্গে বাইরের প্রধান যোগসূত্র একটি ব্রিজ ধ্বংস করে শত্রুর গতিরোধের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার পূর্বে অপারেশনের উদ্যোগ নেওয়ার নির্দিষ্ট সময়েই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোকসেদ শত্রুপক্ষের কাছে ধরিয়ে দেয় বেলাল হোসেন বেলটুকে। এই বন্দি, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও মৃত্যুতাড়িত বেলাল হোসেনের স্মৃতিগুচ্ছ এবং অনুভবরাশি এ-উপন্যাসে বিন্যস্ত হয়েছে। সময়ের দিক থেকে কয়েক ঘণ্টার এই কাহিনি। কিন্তু বেলাল নামক ব্যক্তির প্রতিক্রিয়ায় জাগ্রত স্মৃতি ও অনুভবের মধ্যে রশীদ হায়দার একটা জনপদ, তার অন্তর্গত ব্যক্তি ও সমাজ, ব্যক্তির প্রত্যাশা অপ্রাপ্তি, সংকট ও যন্ত্রণার যে-প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন, তা বাঙালি জীবনের সমগ্রতার স্পর্শ শিহরণে উজ্জ্বল।
সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড মুক্তিযুদ্ধকালীন গ্রামীণ জীবনের আবেগী শিল্পরূপ। তবে, বুড়ির মাতৃ-ইমেজ হলদি গাঁয়ের সীমাবদ্ধ পরিসর থেকে সমগ্র বংলাদেশেই প্রসারিত করে দেয় যুদ্ধের চেতনাকে। গ্রামীণ জীবনকাঠামো, যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় তার রূপ-রূপান্তর, চরিত্রসমূহের বাস্তবানুগ ক্রিয়াশীলতা এবং সর্বোপরি বুড়ির আত্মোজ্জীবন এ-উপন্যাসের জীবনদর্শনকে সমগ্রতাস্পর্শী করেছে। উপন্যাসের পরিণামে চিত্র, ঘটনা ও তার প্রতিক্রিয়ার রূপায়ণে সেলিনা হোসেনের শিল্পদৃষ্টি তীক্ষ্ণ, সংকেতময় ও গূঢ়ভাষী।
মুক্তিযুদ্ধের মর্মস্পর্শী জীবনচেতনার সফল রূপায়ন আমরা প্রত্যক্ষ করি জীবনতরু উপন্যাসে। ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থের বন্দি দিন বন্দি রাত্রি (১৯৭৬) উপন্যাসের জীবনচেতনা ও বিশ্বাস মুক্তিযুদ্ধের মৌল আবেগের সঙ্গে সম্পর্কিত। হাহাকার ও প্রার্থনার একটি চমৎকার বর্ণনা ফুটে উঠেছে এ উপন্যাসে। যেমন-‘নতুন স্বাথীনতা পাওয়া বাঙলায় ফুলের মতো ফুটে উঠা উন্মুখ কলিগুলো পাকিস্তানী পশুসৈন্যদের ধর্ষণে যে অবাঞ্জিত মাতৃত্বের বোঝা বহন করছে, ওদের অন্ধকার জীবনে যেন বিধাতা তুমি সূর্য হয়ে দেখা দাও। যাঁদের সিঁথি মৌর সিঁদুর মুছে গেছে, যাঁরা হারিয়েছে সন্তান সেই বাঙলার প্রতিটি মানুষের মনে তুমি আলোর সমুদ্র ঢেলে দাও।’
দুই সৈনিক ও নেকড়ে অরণ্য মুক্তিযুদ্ধকালীন কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার সন্নিবেশমাত্র। দুই সৈনিক উপন্যাসে মখদুম মৃধা পাক হানাদার বাহিনীর অনুগত থাকা সত্ত্বেও তার দুই কন্যা সাহেলী ও চামেলীকে পাক সেনাদের লালসার শিকার হয়েছে এবং মৃধা অবশেষে আত্মহত্যা করে। জলাঙ্গীতে মুক্তিযোদ্ধার ভীরুতা এবং কাপুরুষতার চিত্র পাওয়া যায়। বাঁকাজোল গ্রামের প্রতীকে বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন সময়ের জীবনবাস্তবতার চিত্র ফুটে উঠেছে। শামসুর রাহমানের অদ্ভুত আঁধার এক (১৯৮৫) মুক্তিযুদ্ধকালীন বুদ্ধিদীপ্ত জীবনমানসের শিল্পভাস্য।
রশীদ করিমের আমার যত গ্লানি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি ভিন্নধর্মী উপন্যাস। নারী আসক্ত নায়ক কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের কল্যাণে বদলে যায, তারই বর্ণনা পাওয়া যায় এ উপন্যাসে। রশীদ হায়দারের খাঁচা উপন্যাসে অবরুদ্ধ ঢাকার শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের বর্ণনা চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। তার অন্ধ কথামালা মুক্তিযুদ্ধের গেরিলাবাহিনীর অভিযানের অভিজ্ঞতায় রচিত হয়। এ প্রসঙ্গে মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একজন তরুণের উদাসিনতা ও নারী প্রীতিতার মোহ ভেঙে কিভাবে তার মধ্যে আত্মোপলব্ধি ঘটে, তারই বর্ণনা পাওয়া যায়। শওকত আলীর যাত্রা ২৫ মার্চ পরবর্তী কয়েকদিনের ঘটনা এখানে উপস্থাপিত হয়েছে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে শঙ্কিত শহরের মানুষ গ্রামের দিকে ধাবমান জনস্রোতের কাহিনী সার্থকতার সঙ্গে রূপায়িত হয়েছে এ উপন্যাসে। অধ্যাপক রায়হান তার স্ত্রী বিনু, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাসান, ছাত্রী লীলাসহ আরও কয়েকটি চরিত্রের মধ্য দিয়ে যুদ্ধকালীন সময়ের নানা সংকট চিত্রিত হয়েছে। রায়হানের মধ্যে আত্মসুখ সন্ধান এবং গ্লানিবোধ থাকলেও হাসানের চরিত্র আশাবাদী। যুদ্ধজয়ের সুতীব্র আকাক্সক্ষা তার উচ্চারণে পাওয়া যায়- ‘এখন আমাদের জীবনের আরেক নাম হয়ে উঠেছে স্বাধীনতা।’
রশীদ হায়দারের খাঁচায় স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে অবরুদ্ধ নগর ঢাকার নগরজীবনের আলেখ্য ফুটে উঠেছে। শহরে অবরুদ্ধ জাফরের মানসিক চিত্র ধরা পড়ে এভাবে- ‘সমস্ত অনুভূতি নিষ্ক্রিয় হয়ে রাস্তার মতো হয়ে গেছে, যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে আমেরিকা, খাঁচাটা আরও সংকুচিত হয়ে আসছে, খাঁচার চারপাশে উদ্যত মারণাস্ত্র।’ এ উপন্যাসে অধিকাংশ চরিত্রই যুদ্ধকালীন সময়ে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পতিত হয়েছে। অন্ধ কথামালা উপন্যাসের নায়ক বেলাল হোসেন একজন শিক্ষিত গ্রামীণ যুবক। তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর চলাচলের গতিকে সীমিত ও প্রতিরোধ করার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা ছিল একটি ব্রিজ ধ্বংস করবে তারা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার পূর্বেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোকসেদ কর্তৃক শত্রুপক্ষের কাছে ধৃত হয় বেলাল হোসেন। এই বন্দীর অনিশ্চিত জীবন ও মৃত্যুভাবনা এ উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে। সময়ের দিক থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার এই কাহিনী।
কেবল উপন্যাসই নয় মুক্তিযুদ্ধের পুরো চিত্র নানা সময়ে ফুটিয়ে তুলেছেন কবিরা তাদের কবিতায়।
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতায় স্বাধীনতার প্রতি অন্তরের গভীর আকাক্সক্ষা বিকশিত হয়ে ওঠে-
‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে চায়’
কবি শামসুর রাহমানের- ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা, ‘বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট’, সন্ত্রাসবন্দী বুলেটবিদ্ধ দিন-রাত্রি’, ‘স্বাধীনতা তুমি’; শহীদ কাদরীর- ‘রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন’; সিকান্দর আবু জাফরের- ‘জনতাকে দেখছি’; আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্র- ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’; সৈয়দ শামসুল হকের- ‘অন্তর্গত’; রফিক আজাদের- ‘সৈনিকের শপথ প্যারেড’; মহাদেব সাহার- ‘স্বাধীনতার প্রতি; নির্মলেন্দু গুণের- ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি আমাদের কী করে হলো’সহ অসংখ্য কবির কবিতায় ছন্দে ছন্দে অনন্য রূপ-রস ও মুগ্ধতায় উঠে এসেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ছোটোগল্পের অফুরন্ত ভা-ারে সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্য। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় রচিত গল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রেইনকোট’, অপঘাত; জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘দিন ফুরানোর খেলা, আমৃত্যু আজীবন, মুক্তিযোদ্ধারা; আলাউদ্দিন আল আজাদের- ‘স্মৃতি তোকে ভুলবো না’; আবু ইসহাকের ‘ময়না কেন কয় না কথা’; আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘কলিমদ্দি দফাদার’; মাহমুদুল হকের ‘বেওয়ারিশ লাশ’; জাহানারা ইমামের ‘রায়বাগিনী’; আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ব্ল্যাক আউট’; পূরবী বসুর ‘দুঃসময়ের অ্যালবাম’; ইমদাদুল হক মিলনের ‘লোকটি রাজাকার ছিল’ ইত্যাদি আরও অগণিত কথাশিল্পীর রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোটোগল্পে বাংলা সাহিত্য আলোকিত হয়ে আছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গল্পগ্রন্থের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হকের- ‘জলেশ্বরীর গল্পগুলো’; শওকত ওসমানের- ‘জন্ম যদি তবে বঙ্গে’; আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের- ‘অপঘাত’; রাহাত খানের- ‘মধ্যিখানের চর’; হুমায়ুন আহমেদের- ‘শীত, ‘উনিশ শ একাত্তর’; আবদুল গাফফার চৌধুরীর- ‘কেয়া’, আমি এবং জারমান মেজর’; শামসুদ্দিন আবুল কালামের- ‘পুঁই ডালিমের কাব্য’; সুচরিত চৌধুরীর- ‘নিঃসঙ্গ নিরাশ্রিত’, রশীদ হায়দারের- ‘কল্যাণপুর’, ‘এ কোন ঠিকানা’; রিজিয়া রহমানের ‘ইজ্জত’; মইনুল আহসান সাবেরের- ‘ভুলবিকাশ’; সত্যেন সেনের- ‘পরিবানুর কাহিনি’ ইত্যাদি গল্পগ্রন্থসমূহ বাংলা ছোটগল্পগ্রন্থের জগত জ্যোতির্ময় করে রেখেছে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচিত কালজয়ী প্রবন্ধ গ্রন্থসমূহের মধ্যে- জাহানার ইমামের- ‘একাত্তরের দিনগুলো’; সেলিনা হোসেনের- ‘একাত্তরের ঢাকা’; আসাদ চৌধুরীর- ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’; শামসুল হুদা চৌধুরীর- ‘একাত্তরের রণাঙ্গন’ এবং আনোয়ার পাশার- ‘রাইফেল রুটি আওরাত’সহ আরও বহু প্রবন্ধগ্রন্থ বাংলা সাহিত্যকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে রেখেছে।
সাহিত্যের অন্যতম প্রধান শাখা নাটক। নাটকের মাধ্যমেও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিকথা অনন্যভাবে দৃশ্যায়মান হয়ে ওঠেছে। মমতাজ উদ্দিন আহমদের- ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’, বকুলপুরের স্বাধীনতা’, কি চাহ শঙ্খচিল’; নীলিমা ইব্রাহিমের- ‘যে অরণ্যে আলো নেই’; সৈয়দ শামসুল হকের- ‘পায়ের আওয়াজ’; জিয়া হায়দারের- ‘সাদা গোলাপে আগুন’; আলাউদ্দিন আল আজাদের- ‘নিঃশব্দ যাত্রা’, ‘নরকে লাল গোলাপ’ ইত্যাদি মঞ্চ নাটকগুলোর মধ্যে উঠে এসেছে- আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দৃশ্য, পাক হায়েনাদের বর্বরতা প্রতিচ্ছবি, রাজাকার, আলবদরসহ দেশদ্রোহীদের ঘৃণ্যমত ইতিবৃত্ত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ইমদাদুল হক মিলন এবং হুমায়ুন আহমেদ টেলিভিশন নাটক রচনায় অনন্য অবদান রেখেছেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ছড়া সাহিত্যেও অনন্যভাবে উঠে এসেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মহান স্বাধীনতা। সুকুমার বড়–য়া, লুৎফুর রহমান রিটন, আমিরুল ইসলাম এর ছড়ায় মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে ছন্দ-মাত্রার আবদ্ধে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে হুমায়ুন আহমেদ, আবু কায়সার, শাহরিয়ার কবির, মাহমুদুল হক প্রমুখ অনন্য অবদান রেখেছেন। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে সকল প্রকার অপশক্তি, অন্যায়, স্বাধীনতাবিরোধী, দুর্ণীতি, ধর্মান্ধতাকে রুখে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাকে যুগ যুগ ধরে সাহস ও শক্তি যোগাবে।