ডিভোর্সি নারীদের কেন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়
কালের পরিবর্তন হলেও পরিবার-সমাজের মজ্জাগত ধ্যান-ধারণার কোনোই পরিবর্তন ঘটেনি আজও। পান থেকে চুন খসলেই নারীকে দোষারোপ করা হয়। তবে সবকিছুর জন্য কি শুধুই নারী দায়ী? পরিবার গঠন হয় নারী-পুরুষের সম্মিলিত ভালোবাসা-শ্রদ্ধায়। কিন্তু অসম্মান-অশ্রদ্ধার পরও কেন নারীরা জীবনকে বিকিয়ে দিলো না, এই নিয়ে হাজারও প্রশ্ন করা হয় তাকে। কোনো নারী যদি দাম্পত্য সম্পর্কে সুখী না হতে পেরে চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ডিভোর্স দেয় বা নেয়, তবে সেক্ষেত্রেও নারীকেই প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলা হয়। বারংবার তাকে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। কেন ডিভোর্সি নারীরা প্রশ্নের সম্মুখীন? কেন সবকিছুর জন্য নারীকেই দোষারোপ করা হয়।
বর্তমানে ডিভোর্সের পরিমাণ বহুল পরিমাণে বেড়ে গেছে এবং পরিসংখ্যান বলে নারীদের পক্ষ থেকেই ডির্ভোস বেশি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আজকাল ডিভোর্স কেন বাড়ছে? কারণ মেনে নাওয়া বা মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান নারীরা আপসহীন। অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত নন নারীরা। নিজের সম্মান নিজে রক্ষা করার মতো শক্তি-সামর্থ্য নারীদের আছে। তবে নারীদের কি আদৌ সামাজিকভাবে ভালোমতো জীবনধারণ করতে দেওয়া হয়। যন্ত্রণা-নিপীড়ন-অত্যাচার কমিয়ে যেখানে দাম্পত্য সম্পর্কের ইতি টানছে সেটাকেই কেন্দ্র করে পুরুষতন্ত্র নারীর জীবনকে আবারও প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলছেন। তাহলে নারীর কি সত্যিই মুক্তি মিলছে? নারীরা কেন ডিভোর্সের শিকার হলেও সেখানেও নারীর প্রতিই আঙুল উঠছে?
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীরা প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন। নিজের মতো বাঁচার অধিকার যেন নারীর থাকতেই নেই। সাংসারিক অশান্তিকে ঘিরে যখন নারী বিচ্ছেদের পথে হাঁটে তখন নারীর প্রতি গড়ে তোলা হয় বিশেষ শৃঙ্খল। পরিবার সমাজের দোহায় দিয়ে নানারকম বুঝিয়ে সুঝিয়ে মেনে নেওয়া-মানিয়ে নেওয়ার বুলি আওড়ানো হয়। সেখানে জীবন অতি তুচ্ছ হয়ে ওঠে। দাম্পত্য সম্পর্কে পুরুষ ও নারী উভয়ের প্রতি শ্রদ্ধা-বিশ্বাস-ভালোবাসা মূলধন। কিন্তু যেখানে এসবের লেশমাত্র নেই সেখানেও কিছু ব্যক্তির স্বার্থের কারণে নারীকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলা হয়। তবে সংসারে সবসময়ই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হয় কিন্তু সেখানেও ব্যক্তির সীমারেখা থাকে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে নারী যখন শুধু একটু শান্তি পেতে নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে তখনো ঘটে নানারকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার!
সম্পর্কের ইতি টানা কারও কাম্য নয়। কিন্তু যেখানে জীবন অতিষ্ঠ সেখানে ডিভোর্স অনিবার্য হয়ে ওঠে। তবে এক্ষেত্রে নারীকে বেশি বিপাকে পড়তে হয়। পরিবার-সমাজের সবার একটাই প্রশ্ন নারীর দিকে খুব সাধারণভাবেই ওঠে মানিয়ে নেওয়া কেন গেলো না। একটু ছাড় দিলেই তো সংসার টিকতো। একটা সাপোর্ট থাকতো। ভালো থাকা যেতো। কিন্তু নারীকে এইগুলো ছুড়ে দেওয়ার আগে কেউ কি ব্যক্তির কষ্ট-দুঃখের সমব্যথী হয়। পরিস্থিতি সবারই আলাদা। জীবনও আলাদা। প্রত্যেকের অভিজ্ঞতাও ভিন্ন। জীবনে কতটা ছাড় দিলে বা মানিয়ে নিলে দাম্পত্য সম্পর্ক টিকে যাবে সুস্থভাবে বাঁচা যাবে, সেটা ব্যক্তি নিজেই বুঝবেন। এমন তো নয় যে একসঙ্গে না থাকার উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছিলেন। সবাই চায় সুন্দর সুস্থ দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে যেতে। কিন্তু যখন নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়ে একজন অন্যজনকে ছেড়ে আসতে বা ছেড়ে যেতে বাধ্য হন, সেটাও বিবেচনা করা উচিত। এক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকেই ডিভোর্স নিয়ে অনাকাক্ষিত প্রশ্ন না করা বিবেকবান মানুষদের উচিত।
নারীদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা হাজারগুণ বেশি। ডিভোর্স কেন নিলো। কেন থাকা গেলো না। একটু মানিয়ে নিলে কী হতো। এরকম হাজারও প্রশ্ন নারীর স্বাভাবিক গতিধারা আবারও বিঘ্নিত করে তোলে। আর এক্ষেত্রে যদি সন্তান থাকে তাহলে নারীর জীবন আরও বিপাকে। কারণ ডিভোর্স দিলেও সন্তানকে তো নিজের কাছেই রাখতে হয়, সেক্ষেত্রে আজীবনের জন্য ফেলে আসা স্মৃতি তাকে বহন করতেই হয়। প্রতিপদে নারীকে রক্তাক্ত করে তোলা হয়।
পারিবারিক, সামাজিকভাবে নারীকে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন না করে বরং নারীর জীবনকে সুন্দর করে তুলতে সবার এগিয়ে আসা উচিত। অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন নয় বরং শ্রদ্ধায় অবনত হওয়া উচিত। কারণ সমস্যার সম্মুখীন হয়েই একজন নারী জীবনের চরমতম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। তার ওপর যদি কড়া প্রশ্নে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে তোলা হয়, তবে অশান্তি তো থেকেই যাবে। তাই ব্যক্তির ইচ্ছেকে সম্মান করতে শিখি, সহোযোগিতার হাত বাড়িয়ে তাকে নতুনভাবে বাঁচার পথ দেখানোই হোক আমাদের ব্রত।
অনন্যা/ জেএজে