ইরানে হিজাব প্রসঙ্গ : নারীর প্রতি রূঢ়তা আর কত!
সারা বিশ্বেই এক অদৃশ্য জালে আবদ্ধ মানব জাতি। ক্রমাগত বিবেক- বুদ্ধি- যুক্তিকে খুইয়ে মানুষ এক বদ্ধ উন্মাদনায় মেতেছে। যার নেপথ্যে নেই শান্তি। আছে শুধু শাসন- শোষণ- নিপীড়ন এবং নিয়ম- নীতির শৃঙ্খল! যার দ্বারা এ সমাজ-মানসের নেই কোন উপকার। তবু মানুষ নামের মানুষগুলো ক্রমাগত সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে বৈষম্য-বিভেদ। আর এই বৈষম্য-নিপীড়ন-নির্যাতন নারীর প্রতি সবচেয়ে বেশি। এক শ্রেণির মানুষ অরাজক কিছু নিয়ম – নীতির ফাঁদে আঁটকাতে চাচ্ছে নারীকে। যেন কোন বর্বর এক সমাজে এসে উপস্থিত মানব জাতি। ঘোর কালো অমানিশা মানুষকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে তার ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে কুসংস্কার, শোষণের কিছু রীতিনীতি! মানুষ নামের মানুষগুলোর এই ক্রমগত হারিয়ে যাওয়া সমাজকে নরকসম করে তুলছে প্রতিনিয়ত।
খুব হতাশ হতে হয়, সমাজের সৃষ্টি যেহেতু একে অপরের সাহায্য- সহোযোগিতায় এগিয়ে আসার জন্য সেই সমাজই আজ এক কঠিন ফাঁদ! যার দৌরাত্ম্যে এখন জীবন চলার পথে অন্যতম বাধা। শুধু বাঙালি জাতি নয় বিশ্বের প্রায় দেশেই মানব জাতি কঠিন সময় পার করছে। অরাজকতা সর্বত্রই ঠেসে আছে মানুষের ওপর। সমাজের কিঞ্চিৎ মনুষ্যত্ব – বিবেকবান মানুষ সেখানে অসহায়, নির্বিকার। আর এই নির্বিকারত্বই বিবেকবান মানুষদের ক্রমাগত শোষণ করে চলেছে। এর মধ্যে থেকে যে বা যারা একটু আওয়াজ তুলছে তাদের সঙ্গেই চলছে কট্টরপন্থীদের নিপীড়ন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইরানের তেহরানে গ্রেফতার হন ২২ বছরের কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনি। পুলিশি হেফাজতে কয়েকদিন পর মাহসার মৃত্যু হয়। এবং পরিবারের দাবি, পুলিশের নির্যাতনে মাহসার মৃত্যু হয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, আগের শারীরিক অসুস্থতার কারণে মারা গেছেন আমিনি। সেদিন থেকেই ইরানজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ দমাতে কঠোর অবস্থান নেয় ইরানের পুলিশ। ডিসেম্বর থেকে গ্রেফতার করা হয় হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে। তাদের মধ্যে চারজনের মৃত্যুদণ্ড ইতোমধ্যে কার্যকর করেছে ইরান সরকার। এরপর চলতি বছরেও ইরানে নারীদের বিক্ষোভে অংশ নিতে দেখা গেছে। নারীরা তাদের স্বাধীন জীবনযাপনকে তুলে ধরতে পথে নেমেছে। সেখানেও পুলিশি বাধা এসেছে। চলতি মাসেই ইরান সরকার নারীদের হিজাববিহীন চলাচলকে শনাক্ত করতে জনসমাগমস্থলে ক্যামেরা বসিয়েছে। এবং শনাক্তকারী নারীদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানিয়েছে । এতে দেশটিতে নারীদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। কেউ কেউ প্রতিবাদস্বরূপ সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের হিজাববিহীন ছবি, ভিডিও পোস্ট করছেন। এর মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নারীরা তাদের বিষোদগার করছেন।
ইরানের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আলি জামাদি বলেন, ‘হিজাব না পরার বিষয়টিকে উৎসাহিত করার অপরাধের বিচার ফৌজদারি আদালতে হবে। বিচারের রায়ই হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল গ্রহনযোগ্য হবে না।’ এবং ইরানে কেউ নারীদের হিজাব ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করলে ফৌজদারি আদালতে তার বিচার করা হবে।
জীবনযাপনের ওপর এমন বিধিনিষেধ কখনোই কাম্য নয়। স্বাধীন দেশের জনগণ স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, মানুষ কোন জন্তু নয় যে, তার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। হিংস্র বাঘকে যখন খাঁচায় পুরে রাখার পায়তারা করা হয় তখন তার গতি হয় অপ্রতিরোধ্য। মানুষ হিসেবে মানুষকে বিবেচনা না করে যখন জোর করে কোন নিয়ম-নীতি- প্রথাকে চাপিয়ে দেওয়া হয় তখন তা পালনের কোন মর্মার্থ থাকে না। ধর্মীয় অনুভূতির কথা বললে বলতে হয়, যে কোন ধর্ম পালন এবং জীবনযাপন পদ্ধতি ব্যক্তির নিজস্ব চেতনার সঙ্গে মিশে থাকে। মানুষ সর্বোচ্চ সেখানে জোর প্রয়োগ করতেই পারে কিন্তু মনের বেরিকেড ভাঙা কঠিন। ফলে কাউকে ধর্ম মানার বিষয়ে জবরদস্তি করা কোন বিবেকবান জাতির কাজ নয়। আজকাল ধর্মের অপব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে নারীরা নির্যাতিত। ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান কোথাও নারীরা নিরাপদ নয়। একটু গভীরভাবে ভাবা প্রয়োজন, যেই ধর্মকে শান্তির বার্তা হিসেবেই মানুষ প্রচার – প্রসার করছেন সেই ধর্মের অজুহাতেই যখন নারীকে শোষণ করা হচ্ছে তখন কোথায় পর্যবসিত হবে ধর্মবোধ? নারী কি কোন খাঁচার পশু যে তাকে পোষ মানিয়ে রাখতে হবে!
বিবেক- যুক্তিবোধের ন্যূনতম ব্যবহার নাই অধিকাংশ মানুষের মধ্যে। ভেড়ার পালের মতো একই স্রোতে প্রবহমান। জাতি- ধর্ম- গোত্র নির্বিশেষে মানুষের পরিচয় কী! সেটা যতদিন বিশ্বের সমগ্র মানুষ নামক অপগণ্ডদের কাছে পরিষ্কার না হবে ততদিন নারী যেমন নির্যাতনের শিকার হবে তেমনি সমগ্র মানব জাতি ধ্বংসের পথে হাঁটতে থাকবে!
ইরানী নারীদের প্রতি এমন রূঢ় আচরণ মানবতার বিপর্যয়। মানবিক সমাজ, ন্যায়পূর্ণ সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে কখনোই এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কাম্য নয়। জনসমাগমস্থলে সিসি ক্যামেরা বসিয়ে নারীদের আরও অনিরাপদ করে তুলছে এ সরকার। কারণ নারীরা হিজাব কাণ্ডে যতটা না ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তার চেয়ে বেশি ক্যামেরায় দৌরাত্ম্যে অনিরাপদ হবেন। একটি স্বাধীন দেশের মাটিতে সেদেশের নাগরিক – নারীর সঙ্গে এ ধরনের কাণ্ড বিবেকবর্জিত। এর প্রতিকার শুধু ইরানী বা আফগানী নারীদের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। সারা বিশ্বের সম্মিলিত আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। প্রত্যেক মানুষ তার ব্যক্তিসত্তায় বিশ্বাসী- কর্মে বিশ্বাসী। সেখানে চাপিয়ে দিয়ে, জুলুম করে নিয়ম মানতে বাধ্য করা অন্যায়।একইসঙ্গে বলতে হয় যার পন্থাটাই শারীরিক – মানসিক নির্যাতন দিয়ে শুরু সেখানে কোন ধর্মের ব্যখ্যা দাঁড় করাতে চান তারা!