সীতা: নীরব প্রতিবাদই যার ভাষা
‘সীতে! তোমার চরিত্রে আমার সন্দেহ জন্মিয়াছে, অতএব তুমি আমার সম্মুখে থাকিয়া নেত্ররোগগ্রস্ত ব্যক্তির সম্মুখস্থিত দীপশিখার ন্যায় আমাকে যারপারনাই কষ্ট দিতেছ। অতএব ভদ্রে! জনকাত্মজে! এই যে দশদিক দেখিতেছ, ইহার যে দিকে ইচ্ছা হয় তুমি যাও; তোমাতে আর আমার কোনো প্রয়োজন নাই।’
মেঘনাদবধ কাব্যে মধুসূদন দত্ত রামকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তাতে রামকে ঠিক বীর হিসেবে দেখানো হয়নি। হিন্দু নারীদের কাছে রাম একজন পরম আরাধ্য দেবতা হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই আমরা ভুলে যাই সীতার জীবনের বিড়ম্বনা।
রামায়ণ ও মহাভারতের দুই ট্র্যাজিক হিরোইন সীতা ও দ্রৌপদী। কিন্তু এই দুই নায়িকার মধ্যে পার্থক্য আছে। সীতা যে মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় বহন করে গেছেন, তার মূল্য কতটূকু? সীতার পতিব্রতের গল্প যেকোনো ভারতীয় নারীর জন্যেই আদর্শস্থানীয়। এমনকী ভারতে যখন সতীদাহ প্রথার আগুনে নারীরা দগ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেখানে সীতাকে অনেকেই উপমা হিসেবে টেনে এনেছেন।
রামায়ণের মূল সংকটের সৃষ্টি সীতাহরণের মাধ্যমে। কিন্তু বিষয়টি একটু সুক্ষ্মভাবে বিচার করে দেখা প্রয়োজন। রাবণের অনাচার ও অন্যায়ের মাত্রা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, তাকে বধ করার জন্যে রামকে অবতার হিসেবে জন্ম নিতে হয়েছিল। অর্থাৎ সীতাকে অপহরণ একটি বিরাট স্কিমের অংশ ছিল।
এই বিশাল স্কিমে গৌরবের ভাগীদার রাম। যেহেতু এটিই নিয়তি, সেহেতু সীতা সেই বড় স্কিমের ফাঁদে আটকে যাওয়া অসহায় প্রজাপতি। তবে, সীতা নীরবে প্রতিবাদ করে গেছে। অনেকেই হয়তো বলবেন, সীতার এই নীরবতাকে ঠিক নারীত্বের প্রতীক না বলে বোকামিই ভাবতে হবে। কিন্তু বিষয়টি আদতে কি এমন? সীতার আর কিছুই করার ছিল না।
পৌরাণিক ভারতের যে বিস্তৃত বিবরণ আমরা মহাকাব্য বা পুঁথিশাস্ত্রে পাই, তাতে কল্পনার রঙ মিশে আছে। সীতার প্রতি অবিশ্বাসের একটি বড় কারণ অনার্যদের প্রতি আর্যদের ঘৃণার মনোভাব। রাবণ অনার্য ছিলেন। তাই রামদের কাছে তিনি চরম ঘৃণ্য ছিলেন। রাবণ আদতে কতটা জঘন্য (অধিকাংশ শাসকেরই এই বদনাম থাকে) অথবা নারীলোলুপ ছিলেন, তা আমাদের পক্ষে পুরোপুরি অনুমান করা সম্ভব নয়। সীতা যেহেতু অনার্য দ্বারা অপহৃত হয়েছিল, তাই রাবন যে ভদ্রতাবশত তাকে ধর্ষণ করেনি, এই কথাটি ঘুণাক্ষরেও রাম বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
ফলে, রামের ভেতর ঈর্ষা ও সন্দেহই পুঞ্জিভূত হওয়া স্বাভাবিক। এমনকী রামায়ণে সীতার মুখেও আমরা সেই কথা শুনতে পাই, ‘প্রভূ! আমি আত্মবশে না থাকায় রাবণের সহিত আমার যে শরীর সংস্পর্শ ঘটিয়াছিল, তাহা আমার ইচ্ছাকৃত নহে, দৈবই সেই বিষয়ে অপরাধী…গাত্রসকল আমার বশীভূত নহে। অতএব রক্ষক না থাকায় রাবণ তাকে স্পর্শ করিয়াছে, তাহাতে আমার অপরাধ কী?’
নিজ স্ত্রীর নিরাপত্তা একেবারেই বিধান করতে না পারার দায়টুকু রাম তার ধর্মজ্ঞানের আড়ালে নিয়ে যান। আর এই ধর্মজ্ঞানের আড়ালে ব্যক্তিগত ঈর্ষাও ছিল। নারীর অন্তর থেকে তার শরীর নিয়েই রামের সব মাথাব্যথা। এমনটার জন্যে রামকে ঠিক দোষারোপ করাটা হয়তো যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ তৎকালীন ভারতে নারীশরীরই ছিল নারীর সর্বস্ব। রামও সমাজব্যবস্থা ও সেই শিক্ষার বাইরের কেউ ছিলেন না। কিন্তু যেহেতু তিনি দেবজ্ঞ বা স্বয়ং দেবতা, তার জন্যে এমন মানবিক খুঁত সাহিত্য সমালোচকদের জন্যে আশার বাণী জাগাতে পারে। যাক, রাম অন্তত অনেকটাই মানবিক।
কিন্তু সীতাকে পদে পদে লাঞ্ছনা ও পীড়নের মধ্যে রাখার কাজটি রাম কখনোই থামাননি। নিজ বনবাসে সীতাকে নিয়ে আসা এবং নিজের অপরাধে স্ত্রীর ওপর অপহরণের দায় চাপিয়ে দেওয়া, এসব কিছুই অমানবিক। এমনকী সীতার মধ্যেও কিছুটা আত্মমর্যাদা ছিল, ‘হায়! বহুকাল একত্রিত থাকিয়া আমাদের অনুরাগ এককালে সংবর্ধিত হইয়াছিল। কিন্তু আপনি যে তাহাতেও আমার চরিত্র অবগত হইতে পারেন নাই। আমি তাহাতেই অপার দুঃখে পড়িলাম। রাজ শার্দুল! আপনি ক্রোধান্বিত হইয়া সাধারণের ন্যায়, আমার কেবল স্ত্রীত্বই বিবেচনা করিলেন। আমি রাজর্ষী জনকের যজ্ঞভূমি হইতে উৎপন্ন বলিয়াই লোকে আমাকে জানকী বলিয়া থাকে, প্রকৃত পক্ষে জনকের ঔরসজাতা নহী, পৃথিবীর গর্ভে আমার জন্ম। কৃতজ্ঞ! আপনি আমার চরিত্র সম্বন্ধে সমুচিত সম্মাননা করিলেন না; বাল্যকালে শাস্ত্রানুসারে, আমার পাণিগ্রহণ করিয়াছেন, তাহাও আপনি দেখিলেন না, আপনার প্রতি আমার ভক্তি এবং আমার কী রূপ স্বভাব তাহাও বিবেচনা করিলেন না।’
কিন্তু যেহেতু রাম সমগ্র সমাজের সামনেই তাকে অপমানের মুখোমুখি করে রেখেছেন, তাই সীতা অগ্নিপরীক্ষা দিতে বাধ্য হলেন। তার সামনে আর কোনো পথ কি ছিল? না। হয় স্বামী পরিত্যাক্তা হয়ে তাকে পতিতার মতো সমাজে অবস্থান করতে হতো নাহয়, আত্মাহুতি দিয়ে নিজের কলঙ্ককে সমগ্র বিশ্বের কাছে চিরতরের জন্যে প্রলম্বিত করতে হতো।
অথচ বিয়ের পর সীতার সম্মানরক্ষার দায় ছিল রামেরই। কিন্তু সম্মান যখন শরীরসর্বস্ব সেখানে সীতার মানসিক দৃঢ়তা কিংবা দৃঢ়চেতা মনোভাবের প্রতি আস্থা থাকার কথাও না। সীতার পবিত্রতা যেন তার পরপুরুষ তারা ধর্ষণের শিকার না হওয়ার ওপর নির্ভর করে।
রামের অবশ্য নিজস্ব যুক্তি আছে এহেন কাজের পেছনে। তিনি নিজেই তো বলেন, ‘জানকি যে লোকসকলের মধ্যে সমাধিক পবিত্রা, তাহাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু ইনি রাবণের অন্তঃপুরে বহুকাল বাস করিয়াছিলেন, সুতরাং আমি যদি বিশুদ্ধরূপে পরীক্ষা না করিয়াই ইহাকে লইতাম, তাহা হইলে লোকে বলিত যে, ‘দশরথ পুত্র রাম নিতান্ত কামপরতন্ত্র এবং সাংসারিক ব্যবহারে একান্ত অনভিজ্ঞ।’
একজন অবতার মানুষের কথার লজ্জায় এমন হয়ে ওঠেন? অথচ ইনিই কি না কৃষ্ণরূপে আসবেন ও বৃন্দাবনে আরেক নারী রাধার সঙ্গে প্রেমে মেতে উঠবেন! তখনো তাকে ঠিক লোকলজ্জার ধূয়ো তুলে বাতিল করবেন না। ধর্মীয় আবেগে আঘাত করার উদ্দেশ্য অবশ্য এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু অবতার মানুষকে পথ দেখাবেন এবং নতুন দর্শনের সঙ্গে পরিচয় করাবেন। তেমনটা রাম করেননি।
সীতা এই পুরুষতান্ত্রিক রাজজগতে নিজস্ব স্বাবলম্বিতা দেখিয়েছেন। তাকে বনবাসে পাঠানোর পর দুই সন্তানকে সিঙ্গেল মাদারের মতোই প্রতিপালন করতে হয়েছে। একবার ভেবে দেখুন, রাজপুত বিধায় এই দুই সন্তানকে নীতিশাস্ত্র, ধর্মজ্ঞান, যুদ্ধশাস্ত্র, ইত্যাদি বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান দিতে হয়েছে। তাই সীতার নিজেরও এসব বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান ছিল।
সীতাকে দুর্বল ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং সীতাকে নতুন আলোকে বিচার করতে হবে। ভারতীয় নারীর যে নীরব প্রতিবাদ, সেই নীরব প্রতিবাদের প্রাথমিক উদাহরণ যে সীতা, তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
অনন্যা/ এআই