ডা. সায়েবা আক্তার: নারীদের প্রসব-পরবর্তী জটিলতা ঠেকালো যার উদ্ভাবন
বাবা ছিলেন শিক্ষক। বাবার অনুপ্রেরণায় বেড়ে উঠেছেন তিনি। আর বাবার মতোই শিক্ষক হতে চাইতেন। কিন্তু বাবা চেয়েছিলেন মেয়ে চিকিৎসক হবে। চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা নিয়ে একসময় খেয়ালিপনা ছিল তার। কিন্তু শেষপর্যন্ত চিকিৎসাসেবাকেই ভালোবেসে ফেললেন। তবে চিকিৎসক হয়েও তিনি দেশের হাজার হাজার চিকিৎসকের শিক্ষক হয়েছেন। ফলে অপূর্ণ থাকেনি শিক্ষকতার স্বাদ। ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ভীষণ জনপ্রিয় তিনি, অনেকেই তাঁকে সম্বোধন করেন ‘মা-ম্যাডাম’ বলে। নারীদের প্রসব পরবর্তী রক্তপাত বন্ধে তাঁর উদ্ভাবিত ‘সায়েবাস মেথড’ বিশ্বজুড়েই এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। অসহায় নারীদের ফিস্টুলা বিনামূল্যে অপারেশনের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘মামস ইনস্টিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড উইমেন্স হেলথ’।
বলছিলাম অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তারের কথা। কিংবদন্তী এই চিকিৎসক কখনো পুরস্কার বা স্বীকৃতির জন্য কাজ না করলেও একের পর এক ভালো কাজ তাঁকে এনে দিয়েছে দেশবিদেশের বহু সম্মাননা। ২০২০ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক লাভ করেছেন তিনি। ২০১৮ সালে পেয়েছেন ‘অনন্যা শীর্ষদশ’ সম্মাননা।
বুধবার (২৫ মে) রাজধানীর ইস্কাটনে মামস ইনস্টিটিউটে সায়েবা আক্তারের কার্যালয়ে পাক্ষিক অনন্যাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের বেড়ে ওঠার গল্প, কর্মজীবন, পারিবারিক জীবন ও নারীদের প্রসবকালীন জটিলতার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করেন তিনি।
১৯৫৩ সালে চট্টগ্রামে নানিবাড়িতে ডা. সায়েবা আক্তারের জন্ম। পৈতৃক নিবাসও চট্টগ্রামে, তবে বাবা টাঙ্গাইল জেলার করটিয়া সা’দত কলেজের অধ্যাপক ছিলেন, সেই ক্যাম্পাসেই সায়েবার শৈশব কেটেছে। তাঁরা পাঁচ বোন ও দুই ভাই।
টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে স্কুলজীবন শুরু হয়। পরে ভর্তি হন করটিয়ার সা’দত কলেজে। গণিত পছন্দ করতেন। শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছায় গণিতকেই বেছে নিতে চেয়েছিলেন। শেষমেশ বাবার ইচ্ছায় ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে। তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় যখন সরাসরি রোগীদের সংস্পর্শে আসেন, তখন তিনি উপলব্ধি করেন এই পেশার গভীরতা। সরাসরি মানুষের সেবা করার সুযোগ তাঁকে মুগ্ধ করে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ইন্টার্ন শেষ করার পর কিছুদিন প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮২ সালে ‘অবসটেট্রিকস ও গাইনোকোলজি’ বিষয়ে এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।
বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করার মাধ্যমে অগণিত নারীকে সেবা দিয়েছেন সায়েবা আক্তার। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কাজ করেছেন। সর্বশেষ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে ২০০৬ সালে অবসর নেন। এরপর নিজের হাসপাতাল গড়ে তোলে ফিস্টুলার চিকিৎসায় আত্মনিয়োগ করেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কর্মকালকেই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় মনে করেন তিনি। খুব অল্প সরঞ্জাম বা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ সেবা দেওয়াটা সেখানেই শিখেছেন। ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টার গঠনের উদ্যোগটাও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকেই শুরু করেন। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে একসময় ফিস্টুলা সেন্টার খোলার প্রয়াস সফল হয়। সরকারি উদ্যোগে এটি এখন পর্যন্ত পরিচালিত হচ্ছে। এটিকে নিজের আরেকটি সন্তান মনে করেন সায়েবা।
যে কারণে সায়েবা আক্তার পরিচিত, সেই ‘সায়েবাস মেথড’-এর কার্যপদ্ধতি ব্যাখ্যা করলেন নিজেই। ‘এটি খুব সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি। এই পদ্ধতির প্রধান উপকরণ কনডম, যা সবজায়গায় সহজে পাওয়া যায়। এই কনডমকে একটা টিউবে বেধে দিয়ে জরায়ুর ভেতর ঢুকিয়ে ফুলিয়ে দেওয়া হয়। এতে প্রসবপরবর্তী রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়।’ ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যের রয়েল কলেজ অব অবসটেট্রিশিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্টসের পক্ষ থেকে তাঁকে এই উদ্ভাবনের জন্য সম্মানসূচক ডিগ্রি দেওয়া হয়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অপারেশন টেবিলে প্রায় দুই দশক আগে এক রোগীর রক্তক্ষরণ দেখে অসহায় অনুভব করছিলেন সায়েবা। এ সময় উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে তিনি এই কৌশলটি উদ্ভাবন করেন। এখন এটি দেশে দেশে অনুসরণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি পল্লী অঞ্চলের নারীদের জীবনরক্ষায়ও ব্যবহৃত হচ্ছে। এর আগে এ ধরনের চিকিৎসায় বিদেশে যে বেলুন ব্যবহার করা হতো, তার দাম ছিল প্রায় ৩০০ ডলার। অথচ বাংলাদেশি টাকায় সর্বোচ্চ একশ টাকা খরচ করেই ‘সায়েবাস মেথড’-এর কিটটি তৈরি করা যায়।
সায়েবা আক্তার বলেন, বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে একজন করে প্রসূতি মায়ের মৃত্যু ঘটে সন্তান জন্মদানের সময়। এরমধ্যে প্রসবকালীন রক্তক্ষরণেই মারা যান ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিবছর এই সংখ্যাটি ১৩ লাখ। অনেকেই পুনরায় প্রসবের সক্ষমতা হারান। বিশেষ করে গরিব দেশগুলোতে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের মাঝেই এই সমস্যা প্রকট।
ফিস্টুলার চিকিৎসায় কেন আগ্রহী হলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. সায়েবা আক্তার বলেন, ‘যেসব মেয়েদের অল্পবয়সে বিয়ে হয়, তাদের একটি সন্তানধারণ করার মতো শারিরীক সক্ষমতা থাকে না। তারা বাচ্চা প্রসব করতে গিয়ে জেনিটাল অরগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এরপর প্রস্রাব-পায়খানায় নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যখন-তখন তা ঝরতে থাকে। ফলে শরীরে দুর্গন্ধ হয়। এতে করে স্বামীরাও তাদের ছেড়ে চলে যায়। এই মেয়েদের চিকিৎসার বিষয়গুলো বরাবরই উহ্য ছিল। সচেতনতারও অভাব আছে। আমার হাসপাতালে এ ধরনের রোগীদের আমরা বিনামূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছি।’
২০১২ সালে ফিস্টুলা, প্রোলাপ্স, পেরিনিয়াল টিয়ারসহ আরও কিছু প্রসবজনিত জটিলতার চিকিৎসায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘মামস ইনস্টিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড উইমেন্স হেলথ’ । হাসপাতালটিতে রোগীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও আছে। সায়েবা নিজের প্রভিডেন্ট ফান্ড ও কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর সহায়তায় ২০ শয্যার এই হাসপাতাল গড়েন তিনি। করোনার সময়কালেও নিরবিচ্ছিন্নভাবে সেবা দেওয়া চালিয়ে গেছে এই হাসপাতাল। সায়েবা আক্তারকে তাঁর সহকর্মীরা এইসময়টায় হাসপাতালে যেতে নিরুৎসাহিত করলেও তিনি থেমে থাকেননি। তাঁদের তিনি বলতেন, ‘আমার যদি আগামীকাল মৃত্যু হয়, আজকের রোগীগুলোর তো চিকিৎসা করে যেতে পারব। তারা সুস্থ হবে।’
ডা. সায়েবা জানান, তিনি যখন ট্রেনিংয়ে ছিলেন, তখন তাঁর শিক্ষক ছিলেন ডা. সুরাইয়া জাবিন। তিনি তখন ফিস্টুলা অপারেশন করতেন। ওই রোগীদের সেবা দিতে গিয়েই সায়েবা তাদের কষ্ট অনুধাবন করেন। তখন থেকেই ইচ্ছা ছিল ফিস্টুলার চিকিৎসায় কিছু করবেন। বরিশাল শের–ই–বাংলা মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বের থাকাকালে ৮টি বেড নিয়ে আলাদা একটি ফিস্টুলা ওয়ার্ড করেছিলেন। ওই সময় বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনাও করতেন। কাজ করতে করতেই দক্ষতা ও আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পায়।
ডা. সায়েবা আক্তারের স্বামী ডা. জাহাঙ্গীর কবির একজন কিডনি বিশেষজ্ঞ। ন্যাশনাল কিডনি ইন্সটিটিউট হাসপাতালের সাবেক পরিচালক তিনি। এই দম্পতির চার সন্তান জাকিয়া কবির, সারোয়াত জাহান কবির, মারগুব কবির ও সুমাইয়া কবির। সায়েবা বলেন, আমার কর্মজীবনের সাফল্যের অন্যতম কৃতিত্ব আমার স্বামীর, কারণ তিনি ভীষণ সহযোগী। আমার জীবনে দুইজন পুরুষ মানুষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, এক হলেন আমার বাবা, আরেকজন আমার স্বামী। তাঁরা সবসময় চেয়েছেন আমি যেন ভালো কিছু করি। বাবা চাইতেন মেয়ে ঘরে বসে না থেকে পড়াশোনা করে বড় কিছু করুক, আর স্বামী পাশে থেকে জুগিয়েছেন উৎসাহ। সংসারে বাচ্চাদের দেখভালের বিষয়টিও স্বামীর সহযোগিতায় সহজ হয়েছে। আমার ব্যস্ততার কারণে ছেলেমেয়েরা আমাকে খুব বেশি কাছে পায়নি, কিন্তু এতে তারা কখনো অসন্তোষ প্রকাশ করেনি। বরং তারাও আমার কাজের জায়গাটা উপলব্ধি করেছে। এখন বরং আমাকে নিয়ে গর্ব অনুভব করে।
শিক্ষকতা জীবনের প্রাপ্তি কথা বলতে গিয়ে ডা. সায়েবা আক্তার বলেন, কেনিয়ার এক হাসপাতালে ‘সায়েবাস মেথড’-এর প্রক্রিয়ায় এক চিকিৎসক ৬ নারীর জীবন বাঁচিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ নিয়ে মাতামাতি হয়। ওই চিকিৎসককেই এই পদ্ধতির আবিষ্কারক বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু সায়েবার ছাত্রছাত্রীরা এর প্রতিবাদ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক লেখালেখি শুরু করেন। সায়েবা আক্তার এসব জানতেন না। তাঁর প্রতি ছাত্রছাত্রীদের ভালোবাসার কারণেই বিষয়টি গণমাধ্যম পর্যন্ত গড়ায় এবং পর্যায়ক্রমে সায়েবার কৃতিত্বের বিষয়টি বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি পায়।
সায়েবাস মেথড তাঁকে একুশে পদকের সম্মানেও ভূষিত করেছে। সায়েবা আক্তার বলেন, আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি কখনো পুরস্কারের জন্য কাজ করিনি, যখন কাজ শুরু করেছি তখন এই বিষয়গুলো মাথায় ছিল না। আমি নিজেকে খুব সাধারণ মানুষ মনে করি, সাধারণ মানুষের সেবায় কাজ করতে চাই। প্রতিটি অর্জন আমার দুই কাঁধে দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি আমার শিক্ষার্থী ও তরুণদের সবাইকে বলতে চাই, প্রতিটি ছোট জিনিসও যেকোনো সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, যেমনটা সায়েবাস মেথডের কিটের ক্ষেত্রে ঘটেছে। সহজলভ্য একটা উপকরণ দিয়ে এটা তৈরি। তাই কোনো কিছুকে অবহেলা করা উচিত নয়।
ডা. সায়েবা আক্তার জানান, চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি অসহায়, দরিদ্র ও ছিন্নমূল মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে কাজ করছেন তিনি। তাদের জন্য হোস্টেল তৈরি করেছেন। গাইবান্ধা জেলায়ও এমন একটি উদ্যোগ রয়েছে তাঁর। তবে যেহেতু সব খরচ নিজেই বহন করছেন, তাই এখনো এর পরিসর সীমিত। ভবিষ্যতে এই কাজটি আরও ব্যাপক আকারে করার ইচ্ছা রয়েছে সায়েবার।