হেটি গ্রিন: আমেরিকার প্রথম নারী মিলিয়নিয়ার
হেনরিয়েটা “হেটি” হাওল্যান্ড রবিনসন গ্রিন (২১ নভেম্বর, ১৮৩৪ – ৩ জুলাই, ১৯১৬) ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। অতিরিক্ত মিতব্যয়ী, বুদ্ধিমান এবং ব্যবসায়িক প্রজ্ঞার জন্য পরিচিত এই নারী ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম ধনী। “দ্য উইচ অফ ওয়াল স্ট্রিট” নামে পরিচিত হেটি প্রথম আমেরিকান নারী যিনি নিজ প্রচেষ্টায় বিপুল ধন-সম্পত্তি অর্জন করেছিলেন। এই সাফল্য তাঁকে অর্থনীতি ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রণী নারীদের একজন হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে দিয়েছে।

প্রাথমিক জীবন
হেটি গ্রিন ১৮৩৪ সালের ২১ নভেম্বর ম্যাসাচুসেটসের নিউ বেডফোর্ডে এক ধনী কোয়েকার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা এডওয়ার্ড মট রবিনসন এবং মা অ্যাবি হাওল্যান্ড তিমি শিকার এবং ব্যাংকিং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই হেটির ব্যবসার প্রতি আগ্রহ ছিল। মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি তাঁর দাদার সঙ্গে আর্থিক কাগজপত্র পড়া শুরু করেন, এবং তের বছর বয়সে তাঁর বাবার হিসাব-নিকাশ পরিচালনা করতে শুরু করেন।
ব্যক্তিগত জীবন এবং বিবাহ
১৮৬৭ সালে, ৩৩ বছর বয়সে, হেটি এডওয়ার্ড হেনরি গ্রিন নামের তুলনামূলক কম ধনী এক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করেন। বিয়ের আগে তিনি শর্ত রাখেন যে, তাঁর সম্পদ সম্পূর্ণ তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকবে—যা সেই যুগে নারীদের জন্য অত্যন্ত বিরল এবং ব্যতিক্রমী ছিল। তাঁদের দুই সন্তান হয়: নেড গ্রিন এবং সিলভিয়া গ্রিন।
আর্থিক দক্ষতা এবং বিনিয়োগ কৌশল
হেটি গ্রিন ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম আর্থিকভাবে দক্ষ ব্যক্তি। তাঁর সম্পদ তৈরি হয়েছিল শেয়ার বাজার, বন্ড এবং রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগের মাধ্যমে। তিনি অর্থনৈতিক অবস্থা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং বাজারে মন্দার সময় সম্পত্তি কিনে রাখতেন এবং চাহিদা বাড়লে তা বিক্রি করে বিপুল মুনাফা অর্জন করতেন।
যদিও তিনি অত্যন্ত ধনী ছিলেন, তবুও তাঁর জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত সাধারণ। তিনি নিউ ইয়র্ক সিটির ছোট্ট একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন, যেখানে কোনো আধুনিক সুবিধা ছিল না। তাঁর পোশাক ছিল সাদামাটা এবং অনেক সময় পুরনো ও ক্ষয়ে যাওয়া। কথিত আছে, তিনি প্রতিদিন একই পোশাক পরতেন এবং কেবল প্রয়োজন হলে তা ধুয়ে নিতেন।
‘দ্য উইচ অফ ওয়াল স্ট্রিট’ এবং মিতব্যয়িতার গল্প
হেটি গ্রিনের “দ্য উইচ অফ ওয়াল স্ট্রিট” উপাধি আংশিকভাবে তাঁর অতি সঞ্চয়ী মানসিকতা এবং অস্বাভাবিক জীবনের কারণে দেওয়া হয়েছিল। একটি বিখ্যাত গল্প অনুযায়ী, তিনি তাঁর ছেলের চিকিৎসার জন্য অর্থ খরচ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, যার ফলে তাঁর ছেলের পা কেটে ফেলতে হয়েছিল। যদিও এই গল্প অতিরঞ্জিত হতে পারে, এটি তাঁর মিতব্যয়ী ভাবমূর্তির প্রতিচ্ছবি।
তিনি বলেছিলেন, “আমি টাকা উপার্জন করতে ভালোবাসি, কিন্তু খরচ করতে ঘৃণা করি।” তাঁর জীবনযাত্রা ছিল তাঁর সময়ের অন্যান্য ধনী ব্যক্তিদের বিপরীত।
জীবনযাপন এবং ব্যক্তিত্ব
হেটি গ্রিন ছিলেন সাহসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমান। সেই যুগে, যখন নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা ছিল না, তিনি ছিলেন একটি ব্যতিক্রম। প্রচুর সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তিনি অতিরিক্ত ব্যয় এড়িয়ে চলতেন এবং সঞ্চয় ও বিনিয়োগকে প্রাধান্য দিতেন।
তিনি সমালোচনাকে কখনো গুরুত্ব দেননি এবং নিজের লক্ষ্যের প্রতি অটল ছিলেন। তাঁর দর্শন ছিল সহজ: “সম্পদ মানেই নিরাপত্তা, ভোগ বিলাস নয়।”
মৃত্যু এবং উত্তরাধিকার
১৯১৬ সালের ৩ জুলাই হেটি গ্রিন মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার, যা আজকের মানে বিলিয়ন ডলারের সমান। তাঁর সন্তান নেড এবং সিলভিয়া বিশাল এই সম্পদের উত্তরাধিকারী হন।
হেটি গ্রিন ছিলেন এমন একজন নারী, যিনি তাঁর সময়ের অনেক আগেই সমাজের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। তাঁর মিতব্যয়িতার জন্য সমালোচনা করা হলেও, তাঁর আর্থিক প্রজ্ঞা, বিনিয়োগের দক্ষতা এবং নারীর ক্ষমতায়নের পথিকৃৎ হিসেবে তাঁর অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে সফল হতে বিলাসী হওয়া প্রয়োজন নয়। নিজের প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা স্বাধীনতা, বুদ্ধিমত্তা এবং দৃঢ়তার উত্তরাধিকার আজও তাঁকে স্মরণীয় করে রেখেছে। আমেরিকান ইতিহাসে হেটি গ্রিন আর্থিক মেধা এবং অধ্যবসায়ের এক উজ্জ্বল প্রতীক।