Skip to content

২রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ১৯শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মেরি স্টোপসের লড়াই

এইতো কদিন আগেই ম্যারি স্টোপস ফাউন্ডেশনের নাম বদল করে এম এস আই রিপ্রোডাক্টিভ চয়েস নামে আত্মপ্রকাশ করে। পথিকৃৎ এর নামকে সরিয়ে দেয়াটা অবশ্যই উদ্দেশ্য ছিলোনা। বাংলাদেশে অবশ্য সকলেই মেরি স্টোপস ক্লিনিককে একনামে চেনে। কিন্তু মেরি স্টোপস নামটির বিষয়ে কি আদতে খুব বেশি কিছু জানা আছে?

হ্যাঁ, পৃথিবীর ইতিহাসে মেরি স্টোপস একটি বৈপ্লবিক নাম তো বটেই। পেশায় উদ্ভিদজীবাশ্মবিদ হলেও ব্রিটেনে তিনিই প্রথম জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ক পরামর্শ দিতেই একটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন। এই ক্লিনিকেই সর্বপ্রথম বিবাহিত নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ক নানা পরামর্শ দেয়া হতো এবং সেবা প্রদান করা হতো। বিশেষত শ্রমজীবী বা প্রান্তিক অবস্থানে থাকা নারীদের জন্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ ছিলো কঠিন। ক্যাথলিক খ্রিষ্টান এবং পুরুষতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা যেন সমস্যা হয়েই দাঁড়িয়েছিলো। এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই তিনি খরগগস্ত হয়ে উঠেছিলেন। আর এভাবেই হয়ে উঠেছিলেন পরিবার পরিকল্পনার পথিকৃৎ।

স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে মেরি স্টোপস ১৮৮০ সালের ১৫ অক্টোবর জন্মগ্রহন করেন। বাবা ও মা দুজনেই শিক্ষিত ছিলেন। বাবা হেনরি স্টোপস পেশায় আর্কিটেক্ট এবং মা শারলট কারমাইকেল স্টোপস এক স্কটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। শেক্সপীয়রে ছিলো তার অগাধ দখল।

স্টোপসের জন্মের পরেই তার পরিবার লন্ডনে চলে আসে। এখানেই ১২ বছর বয়স পর্যন্ত ঘরেই তাকে লেখাপড়া করতে হয়েছে। মা’ই তার লেখাপড়ার তত্বাবধান করতেন। তারপর এডিনবার্গেই তাকে সেন্ট জর্জ স্কুলে লেখাপড়া করতে পাঠানো হয়। সেখানে কিছুদিন লেখাপড়া শেষে নর্থ লন্ডন কলেজিয়েটে চলে আসেন। এখানে এসে তিনি তার ক্লাসের সেরা ছাত্রী হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়ার সময় বেছে নেন রসায়ন। কিন্তু কিছুদিন পরেই বোটানিতে পড়া শুরু করেন। মূলত জিওলজি এবং বোটানিতেই তিনি তার অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

একজন প্রথম থেকেই তিনি চেয়েছিলেন বিজ্ঞানের কোনো বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়বেন। উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া করাটা এমনিতেই বেশ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৯০৪ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টর অফ সায়েন্স ডিগ্রি লাভ করেন। ব্রিটেনে এত কম বয়সে এর আগে কেউ এই ডিগ্রি লাভ করেনি। ঐ বছরই সকলকে চমকে দিয়ে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে যোগ দেন।

নিজের ক্যারিয়ারে যেখানেই হাত দিয়েছেন সফলতার দেখা পেয়েছেন। এনজিওস্পার্মের ইতিহাস নিয়ে চমৎকার একটি গবেষণা করেছেন। এছাড়া কয়লার গঠন নিয়েও পড়ালেখা করেছেন। নিজের কাজের জন্যেই তিনি ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটির সদস্যপদ পেয়েছিলেন। এই সম্মাননা যেকোনো নারীর ক্ষেত্রে প্রথম। রয়্যাল সোসাইটি থেকে তাকে ১৯০৭ থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত জাপানে গবেষণার জন্যে পাঠানো হয়।

বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিভার স্ফুরণ ঘটিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু অনেকেই জানেন না মেরি স্টোপস ছিলেন একজন অনবদ্য লেখক। জাপান থেকে ম্যানচেস্টারে ফিরেই তিনি তার প্রথম বৈজ্ঞানিক কাজের উপর লেখা প্রকাশ করেন। ১৯১০ সালে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ‘প্রাচীন উদ্ভিদ’ নামে একটি বই। ১৯১৩ সালে তিনি এক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত হন। এখানে পরবর্তী ৭ বছর শিক্ষকতার সাথেই জড়িত ছিলেন। এখানেই তিনি প্যালেওবোটানি এবং নিজের ক্ষেত্রের উপর কিছু বই লিখেন।

১৯১১ সালে কানাডিয়ান বোটানিস্ট রেজিনাল্ড রাগলস গেটসকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর অবশ্য স্বামীর দ্বিতীয় নাম তিনি গ্রহণ করেননি। বরং নিজের বাবা দেয়া নামই আজীবন বহন করেছেন। এই বিয়ে অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার স্বামী মিলনে অক্ষম। এই অভিজ্ঞতা তাকে কিছুটা নাড়িয়ে দিয়েছিলো। এবার তিনি ভালোবাসা, বিয়ে এবং মিলন বিষয়ে গবেষণা করতে শুরু করেন।

অবশেষে তিনি ‘ম্যারিড লাভ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। লক্ষ্য করলেন প্রকাশকরা এমন বই প্রকাশে রাজি হচ্ছেন না। কোনো বইয়ে বৈবাহিক সহবাস নিয়ে এত খোলামেলা আলোচনা ঠিক ভালো দেখায় না। স্টোপস ভাবলেন নিজের টাকায় বই ছাপাবেন। তারজন্যে অনেক টাকা প্রয়োজন। এবার তিনি ঋণের খোজ করতে শুরু করলেন। অবশেষে রো তাকে টাকা ধার দিতে রাজি হলেন।

১৯১৮ সালে বইটি মুদ্রিত হয়। পরের বছর তিনি রো-কে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি এক মৃত সন্তান প্রসব করেন। তবে তার সন্তানের মৃত্যুর জন্যে চিকিৎসকদেরই দায়ী করেছিলেন। এই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি আজীবন চিকিৎসকদের অবিশ্বাস করে গেছেন। যাহোক ১৯২৪ সালে অবশেষে মেরি এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। সন্তানের নাম রাখেন হ্যারি স্টোপস রো।

‘ম্যারিড লাভ’ বইটি ততদিনে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সহজ সরল ভাষায় লেখা বইটি অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিলো। বইটিতে মূলত একথাই বলা হয়েছিলো মানুষের ব্যক্তিগত এবং যৌন-জীবনে আনন্দ খোজা উচিত। পাঠকরা তাকে প্রায়ই চিঠি লিখে পাঠাতেন। এদের মধ্যে অনেক চিঠিতেই জন্ম নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে জিজ্ঞাসা ছিলো। স্টোপস তাদের কথার জবাব দিতেই লিখলেন ‘ওয়াইজ প্যারেন্টহুড’। ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত তিনি এ বিষয়ে অনেক বই লিখেন। তারমধ্যে ‘ওয়ার্কিং মাদার’ ‘র‍্যাডিয়েন্ট মাদারহুড’ ‘এন্ডুরিং প্যাশন’ উল্লেখযোগ্য।

এছাড়াও ১৯২১ সালেই তিনি মাদারস ক্লিনিক নামে একটি বার্থ কন্ট্রোল ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন। বলা বাহুল্য, এটিই ছিলো লন্ডনের প্রথম জন্ম নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক ক্লিনিক। কাজের প্রথমদিক থেকেই চিকিৎসকদের সমালোচনার শিকার হয়েছেন বহুবার। মেরি তখন সার্ভিক্যাল ক্যাপের মাধ্যমে জন্ম নিয়ন্ত্রণের ধারণা প্রচার করছেন। কিন্তু চিকিৎসকরা এর বিরোধিতা করছিলেন। হালিডে সাদারল্যান্ড নামক এক রোমান ক্যাথলিক ডাক্তার একটি প্রতিবেদন লিখেন। সেখানে তার অভিযোগ, স্টোপস গরীব নারীদের উপর অন্যায় পরীক্ষা পরিচালনা করছে।

মেরি অবশ্য এই অভিযোগ নাকচ করে পালটা অভিযোগ করেন। এ নিয়ে আইনের দ্বারস্থ হন। তবে সাদারল্যান্ড মুক্তি পেয়ে গিয়েছিলেন। এই মামলা অবশ্য মেরির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে। পাবলিক স্পিকার হিসেবে তিনি দ্রুতই খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৩৩ সালেই ক্যাথলিক প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করে লিখেন ‘রোমান ক্যাথলিক মেথডস অফ বার্থ কন্ট্রোল’। স্টোপস অবশ্য পরবর্তী জীবনে অসুখী হয়ে পড়েন। রো এর সাথে বিচ্ছেদ হওয়ার পর ছেলের সাথেও যোগাযোগ কমে যায়। এমনকি ছেলের বিয়ের বিষয়েও তার সম্মতি ছিলোনা। এই হতাশায় তিনি সাহিত্যের দিকে ফিরে তাকান। কিছু কবিতাও লিখেন যা তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি।

তার স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়ছিলো। চিকিৎসকদের তিনি বিশ্বাস করতেন না। বরং রোজ ঠান্ডা পানিতে গোসল আর এক গ্লাস সমুদ্রের পানি খেলেই সুস্থ থাকবেন এমন অদ্ভুত বিশ্বাস ছিলো মেরির। তাই প্রথম থেকেই নিজের অসুস্থতা বুঝতে পারেন নি। অবশেষে তার ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়লেও তিনি চিকিৎসা নিতে রাজি হননি। বরং সুইজারল্যান্ডে এক হলিস্টিক থেরাপি নিতে শুরু করেন। নরবারি পার্কে ফিরে আসার পর অবশেষে ১৯৫৮ সালের ২ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।

ইতিহাসে মেরির মতো সাহসী এবং ধারালো বক্তব্য আর কোনো নারী রাখতে পেরেছি কিনা জানা নেই। কিন্তু তিনি যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন তা সচরাচর জনসম্মুখে আলোচনা করাটা সভ্য বলে মানতেন না অনেকে। এই মানসিকতার সাথেই ছিলো তার লড়াই। জনগণ যদিও এই তথ্যের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করতেন, তবে লজ্জায় গোপন রাখতেন। মেরি সেখানেই কুঠারাঘাত করেন। আনেন বদল। আর এখন সমগ্র বিশ্বেই জন্মনিয়ন্ত্রণ বা পরিবার পরিকল্পনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অনন্যা/জেএজে

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ