নিজ হাতে আইন তুলে নিতে পারবে ধর্ষিত ভুক্তভোগী?
বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্ষণ একটি গুরুতর অপরাধ যা সমাজে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পেতে দীর্ঘসূত্রিতার শিকার হন। বাংলাদেশের আইনব্যবস্থা ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করেছে। তবে কখনও কখনও এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যেখানে একজন ব্যক্তি তার বা অন্যের আত্মরক্ষার্থে একটি প্রাণঘাতী পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পেনাল কোড ১৮৬০-এর ১০০/৩ ধারাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ধারা অনুযায়ী, যদি কেউ নিজের বা অন্যের জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার্থে সহিংসতা প্রয়োগ করে। তখন সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাধারণত শাস্তি আরোপ করা হবে না।

পেনাল কোড ১৮৬০-এর ১০০ ধারা আত্মরক্ষার্থে সহিংসতা প্রয়োগের শর্তাবলী ও সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করে। এই ধারা বলছে, যদি কোনো ব্যক্তি তার জীবন বা সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সহিংসতা ব্যবহার করে তবে তাকে আত্মরক্ষার্থে প্রয়োগিত সহিংসতা হিসাবে গণ্য করা হবে এবং তা শাস্তির আওতায় আসবে না। ধর্ষণ একটি গুরুতর অপরাধ এবং যদি কেউ ধর্ষণের শিকার হয় এবং সে সময় তার আত্মরক্ষা করতে গিয়ে ধর্ষককে হত্যা করে। তখন সে ১০০ ধারা অনুযায়ী আত্মরক্ষার্থে সহিংসতা প্রয়োগের অধিকারী হতে পারে। তবে এটি নির্ভর করবে বিভিন্ন পরিস্থিতি এবং ঘটনাস্থলে ঘটনার প্রকৃতি কীভাবে ছিল তার ওপর।
বাংলাদেশ পেনাল কোড ১৮৬০-এর ১০০ ধারার ৩য় উপধারা (১০০/৩) বিশেষভাবে নির্দেশ করে যে, কোনো ব্যক্তি যদি তার আত্মরক্ষা করতে গিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটায় এবং এটি প্রমাণিত হয় যে সেই ব্যক্তির জীবন বা শরীরের ওপর নির্যাতন বা ঝুঁকি ছিল,তখন আদালত ঐ ব্যক্তিকে নির্দোষ হিসেবে খালাস দিতে পারে। এই ধারা কার্যকর হতে হলে আত্মরক্ষার পরিস্থিতি সঠিকভাবে প্রমাণিত হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ পেনাল কোড আত্মরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। ধারা ৯৬-১০৬ অনুযায়ী, কেউ জীবনের সুরক্ষার জন্য তৎক্ষণাৎ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে তা আইনের চোখে বৈধ হতে পারে। কিন্তু এটি প্রতিশোধমূলক হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি যদি ধর্ষণের সময় বা পরে ধর্ষককে হত্যা করে এবং এটি প্রমাণিত হয় যে, সে তার জীবন বা সম্মান রক্ষার্থে এ কাজ করেছে, তখন তাকে ১০০/৩ ধারায় সুরক্ষা প্রদান করা হতে পারে। তবে এটি স্পষ্টভাবে বলা যায় না যে, সব পরিস্থিতিতে এভাবে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলে বিচার হবে না। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে, তা হলো, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে সহিংসতা প্রয়োগ করা উচিৎ এবং তা অবশ্যই পরিমাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।
একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে আত্মরক্ষা শুধুমাত্র তখনই বৈধ হতে পারে যখন সহিংসতা কেবলমাত্র অপরাধী বা আক্রমণকারীর হাত থেকে নিজের জীবন বা সম্মান রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয়। অন্যথায় যদি কেউ অতিরিক্ত সহিংসতা প্রদর্শন করে তখন এটি আত্মরক্ষা হিসেবে গণ্য হবে না। ধর্ষণকারীর মৃত্যু যদি ন্যায়সঙ্গত আত্মরক্ষার কারণে ঘটে তবে আদালত বিবেচনা করবে ওই ব্যক্তি অতিরিক্ত সহিংসতা প্রয়োগ করেছে কিনা।
বাংলাদেশের সংবিধানও ব্যক্তির জীবন ও নিরাপত্তাকে সুরক্ষিত রাখার কথা বলে। এটি নির্দেশ করে যে, প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার রয়েছে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আত্মরক্ষার অধিকার। সামাজিকভাবে ধর্ষণ একটি অবমাননাকর অপরাধ এবং এমন পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষার জন্য সহিংসতা প্রয়োগ একটি প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আদালত প্রত্যেক ঘটনাকে আলাদাভাবে বিচার করবে এবং অপরাধীর দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি যাচাই করবে।
বাংলাদেশ পেনাল কোড ১৮৬০-এর ১০০/৩ ধারা অনুযায়ী, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে সহিংসতা প্রয়োগ করা হলে বিচারাধীন হবে এবং এটি সঠিক পরিসরে থাকলে শাস্তির আওতায় আসবে না। ধর্ষককে হত্যা করার মতো ঘটনায় বিচারের সময় আদালত আত্মরক্ষা, সহিংসতার পরিমাণ এবং অন্যান্য পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেবে। যে কোনো ব্যক্তিকে তার জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার্থে সহিংসতা প্রয়োগের অধিকার রয়েছে, তবে এই অধিকার যেন সীমিত ও প্রয়োজনীয় মাত্রায় থাকে, তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।