পেরুতে এত নারী নিখোঁজ হয় কেন
বিশ্বের প্রতিটি দেশেই নারী ঘটিত কিছু না কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা চোখে পড়ছে। আবহমানকাল থেকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের অবস্থান সংকটাপন্ন তবু যুগের চাহিদায় পরিবর্তন কাম্য। কিন্তু সেই পরিবর্তন খাতা-কলমে দেখানো হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। নারীরা বিভিন্নভাবে হিংস্রতার শিকার হচ্ছে। নারীর সঙ্গে অন্যায় আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। সহমর্মিতা, শ্রদ্ধা, সম্মান, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি যেন নারীর জন্য এখন অলীক স্বপ্ন!
সত্যি বলতে আজকের আধুনিক এবং সভ্য যুগে এসেও নারীকে শিকারে পরিণত করা হচ্ছে। শুধু তার কৌশলটা পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু মূল টার্গেট নারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মনে করেন নারীদের দমিয়ে রাখতে পারলেই তাদের রাজত্ব এবং পুরুষত্ব প্রমাণিত হবে। ফলে যেকোনো প্রকার ফাঁদ সৃষ্টি করে নারীকে করায়ত্ত করার কৌশল নতুন নয়।
সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকেই পৃথিবীর বৈশ্বিক কোন পরিবর্তনের জন্য দায়ী করা হয় নারীকে। ধর্মীয় অভিমতও এর ব্যতিক্রম নয়। আদম, হাওয়ার কাহিনি প্রচলিত সেখানেও হাওয়ার ত্রুটি দেখানো হয়েছে। ভুল করে ফল খাওয়ার কারণেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সমগ্র মানব জাতির সৃষ্টি বলা হয়। প্রকৃত বক্তব্য সেটা নয়, কথা হলো প্রতিটি স্তরেই নারীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। উল্লেখিত প্রসঙ্গটি একটি উদাহরণ মাত্র। তবে এর বাইরে এসে, হাজারও উদাহরণ দেখানো যায়, যেখানে নারীকে দোষী সাবস্ত করা হয়। সংসারিক সংকটে প্রধান দোষী নারী, সন্তান বিপথে গেছে – দোষ মায়ের, পারিবারিক সমস্যা সেখানে দোষ নারীর, পরিবারে বংশধর আসছে না সেখানে একবাক্যে নারীকে দোষী করা হয়, আবহাওয়া খারাপ অর্থাৎ বৃষ্টি নেই বা অতিরিক্ত খরা সেখানে কে দায়ী? নারী! এমন অসংখ্য সমস্যা ও সংকটের জন্য দায়ী কে! নারী! অর্থাৎ নারী মানেই যেন এক মুসিবতের নাম!
কিন্তু কী আশ্চর্য এ পৃথিবী। এর ধরণ-ধারণ এবং লালনের মূল চালিকাশক্তি কিন্তু এই নারীই। তবু
মানুষের যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেক খুইয়ে সবকিছুর জন্য দায়ী করা হয় নারীকে। কারণ নারী হচ্ছে অনেকটা নরম মাটির মতো। আমরা জানি, একটি বিড়ালও সেখানেই মলত্যাগ করে যেখানে সে নরম পায়। সুবিধাজনক স্থান লাভ করে। অর্থাৎ এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজও ঠিক তাই। তারা সুবিধা খোঁজে এবং দোষ চাপাতে অভ্যস্ত। আমাদের সমাজই নয় বরং বিশ্বের প্রতিটি নারী ঠিক এমনটাই। ফলে বিশ্বজুড়ে আজও নারীরাই নির্যাতিত। এই নির্যাতন জায়গা ভেদে ব্যাপক আকার ধারণ করে আবার কোথায় কিঞ্চিৎ কম। কিন্তু এ বিশ্বে সত্যি এমন কোন স্থান নেই যেখানে নারীরা নিরাপদ। নারীরা নির্যাতন শব্দের সঙ্গে পরিচিত নয়!
২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানের নারীদের কী হালহকিকত তা সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন। এবং উপলব্ধিও করেছেন। এরপর আসছে ইরান সেখানেও একই প্রকারে নারীরা নির্যাতিত। আমরা নিশ্চয়ই মাহসা আমিনির কথা ভুলে যায়নি। এই নিয়ে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, মিছিল কোনোকিছুই বাদ যায়নি। কিন্তু তারও সুরহা হয়নি। বরং তাদের একঘরে করতে, নজরদারি রাখতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে সিসিটিভিও কিন্তু বসানো হয়েছে। এছাড়া আফগানিস্তানের নারীদের ঘরে বন্দি রাখতে স্কুল, কলেজ বন্ধ। রেডিও স্টেশন বন্ধ। পার্কে বেড়ানো বন্ধ। অর্থাৎ সবদিক থেকে নারীদের অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে।
আফগানিস্তান, ইরান, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য কোথাওই নারীর পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হয়নি। এবং নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। যুক্তরাজ্য প্রাচীন সভ্য দেশ হিসেবে গণ্য কিন্তু আজও সেখানে নারীদের প্রতি বৈষম্য করা হয়। পুরুষ এবং নারীর বেতন কাঠামো ভিন্ন। সেটা শুধু যুক্তরাজ্যেই নয় এটি মূলত বিশ্বের সব দেশে। ঘটনাগুলো কোনটাই বিচ্ছিন্ন নয়। নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি তাই এগুলোর প্রতিটি ঘটনার মাধ্যমে উপস্থাপিত হচ্ছে।
সম্প্রতি একটি ঘটনা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমে উঠে এসেছে পেরুতে ঘটে যাওয়া কিছু দুর্বিষহ ঘটনা। যার শিকার নারী। পেরুতে এই বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে ৩,৪০০ জনের বেশি নারী নিখোঁজ হয়েছে। দেশটির ন্যায়পাল কার্যালয় শনিবার এ কথা জানায়।
‘তাদের কি হয়েছে?’ শিরোনামে কার্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের প্রথম চার মাসে ৩,৪০৬ জন নারী নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তাদের মধ্যে মাত্র ১,৯০২ জনকে খুঁজে পাওয়া গেছে। এবং ১,৫০৪ এখনও নিখোঁজ রয়েছে।
ন্যায়পালের ডেপুটি ইসাবেল অরটিজ বলেন, নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টিকে পেরুর আসন্ন বিপদ পরিস্থিতি হিসেবে দেখতে হবে। তিনি বলেন, ‘৩৩ মিলিয়ন মানুষের আন্দিয়ান দেশটির এই ধরনের ঘটনা রোধ করার জন্য রাষ্ট্র যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না।’
২০২২ সালে ৫,৩৮০ জনের বেশি নারী, বেশিরভাগই মেয়ে ও কিশোরী নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এই সংখ্যা ২০২১ সালের তুলনায় ৯.৭ শতাংশ কম। বিভিন্ন নারীবাদী এনজিওর মতে, পুলিশ ও প্রসিকিউটর অফিস অনেক মামলার পর্যাপ্ত তদন্ত করে না কারণ তারা বিশ্বাস করে যে নারীরা স্বেচ্ছায় পালিয়ে গেছে। এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে নারীদের প্রতি দায় ভুলতে চায় দেশটি।
দক্ষিণ আমেরিকার মধ্য পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত পেরু। যার রাজধানী লিমা। ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনের কাছ থেকে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। এর উত্তরে ইকুয়েডের ও কলম্বিয়া; পূর্বে ব্রাজিল ও বলিভিয়া; দক্ষিণে চিলি; পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর।
দেশটি ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে এখন দৃঢ় অবস্থানে। তবে দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। নারী বিদ্বেষ এখন যে ক্রমাগত প্রবল হয়ে উঠছে তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টটি প্রমাণ করে। তবে দিনে দিনে পেরুতে এত নারী নিখোঁজ থাকার কোনো সঠিক হদিস দেশটির প্রশাসন বা কর্মকর্তাবৃন্দ দেননি৷ এর নেপথ্যে কারণ কী!
গত চার মাসে ৩ হাজার ৪০০ নারী নিখোঁজ কোনো হেলাফেলার বিষয় নয়। এই নারীদের উদ্ধারকল্পে বা তাদের সঠিক কারণ দর্শাতে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। যে বা যারা ইতিমধ্যে উদ্ধার হয়েছে তাদের ওপর জরিপ চালানো প্রয়োজন।তাহলে হয়তো বাকিদের সম্পর্কে কিছু হলেও ধারণা মিলবে। নারীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় বৈশ্বিক তৎপরতা জরুরি। কারণ এখন প্রতিটি দেশেই নারীকে আবদ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্যায়-অপরাধ নিয়ে কথা বললে তাকে দমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর স্বদিচ্ছায়ও যদি ঘর ছাড়ে তবে কেনো ৩,৪০০ জন নারী সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো সে বিষয়ও সঠিক বার্তা প্রয়োজন। পেরুর এ ঘটনা বিশ্বের বুকে নারীদের অনিরাপদ জীবনযাত্রার কথা প্রমাণ করে। মানুষ দিনে দিনে সভ্যতার বুলি আওড়ালেও সেখানে নারীর অবস্থান কতটা নিম্নমুখী তা বোঝায় যায়।
আধুনিক, সভ্য ও উন্নত হিসেবে মানব জাতি পরিচিত। তবে বর্তমান সময়টা মানুষের অমানবিক, কদর্য ও বর্বরতাকেই উপস্থাপন করছে বেশি। সমাজের অস্থিতিশীলতা, গোটা বিশ্বে নারীকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা, গুম, খুন, ধর্ষণ সবটাই নারীর সঙ্গে ঘটছে। ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, পেরু প্রভৃতি দেশের মতো কোনো দেশেই বর্তমানে নারীরা নিরাপদ নয়। নারীদের নিরাপত্তা দিতে হলে সত্যিকার অর্থে প্রথমত মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। পেরুতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। প্রত্যেক নারী সুস্থভাবে তার আপনজনের কাছে ফিরে আসুক। মূলত এই ঘটনা কেনো ঘটেছে এবং কেনো এত নারী নিখোঁজ তা দ্রুত অনুসন্ধান করতে উপরমহলের সুদৃষ্টি দিতে হবে। এর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ণ জরুরি। বিশ্বে ক্রমাগত নারীদের প্রতি এমন বিদ্বেষ, অবরুদ্ধ দশা কখনোই কাম্য নয়।