নারী-পুরুষের পারিশ্রমিকে বৈষম্য আর কতকাল
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তরতরিয়ে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষার উন্নয়ন উঁকি দিলেও নারীর সামগ্রিক উন্ননয় আজও ধরাছোঁয়ার বাইরে। পত্রিকায় ফলাও করে নারীর উন্নতি, ক্ষমতায়নকে দেখানো হলেও নারী আজও বৈষম্যের শিকার। নারীকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এখনও ব্যাপকভাবে রুদ্ধ করে রেখেছে। নারী আজও বৈষম্যকে হজম করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় রত। কিন্তু সমমানের কাজে নারীকে কেন কম পারিশ্রমিক প্রদান করা হয়? কেন নারী তার সবটা দিয়েও এভাবে লৈঙ্গিক বৈষম্যের শিকার!
শুধু নারী হওয়ার কারণে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস এমনকি বেসরকারি নামি-দামি প্রতিষ্ঠানেও বেতনের বৈষম্য দেখা যায়। একজন পুরুষকে একই কাজে যে পরিমাণ পারিশ্রমিক প্রদান করা হয় নারীকে তা করা হয় না। এর জন্য বিশেষ কোনো খুঁত নারীর নেই। শুধু তিনি লিঙ্গ ভেদে নারী এটাই জন্মগত অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের স্বীকৃতি এ সমাজে আজও নেই।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নারীর অংশগ্রহণ, অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ, সমাজ ও পরিবার পরিচালনায় নারীর অংশগ্রহণ কোনটাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ স্বীকার করতে চায় না। আর তাদের স্বীকৃতি তো অনেকদূরের বিষয় হয়ে যায়! বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী পুরুষদের তথ্য-উপাত্ত রক্ষিত হলেও নারীদের ক্ষেত্রে তা নয়৷
বিগত শতাব্দী থেকে বর্তমান পর্যন্ত নারী শ্রমের ইতিহাসে রদবদল দেখা গেলেও তাদের পারিশ্রমিকে যে বৈষম্য তা আজও দূর হয়নি। পুরুষের জন্য ১০ টাকা বরাদ্দ হলে সেখানে নারীর জন্য ৫ টাকা বরাদ্দ হয়। কারণ দরিদ্র্য ঘরের মেয়েরা কাজে অংশ নেওয়ায় চাকরি যাওয়ার ভয়ে কম মজুরিতেই টিকে থাকতে চেষ্টা করে। অযথা সময় নষ্ট না করে মালিকশ্রেণিকে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের সুযোগ করে দিলেও তাদের ভাগ্যে থাকে দুঃখ-দুর্দশা।
শ্রমবাজারে নারী-পুরুষের ব্যবধান সবসময়ই ছিল। বিশ্ব উন্নত হচ্ছে, আধুনিক হচ্ছে মানুষ কিন্তু কর্মজীবী নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনও পরিবর্তন হয়নি। এ দৃষ্টিভঙ্গির স্বরূপ হয়তো একেক দেশ ও সমাজে একেক রকম। কিন্তু বাস্তবে কর্মজীবী নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনও সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। এর কারণও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। পুরুষ সবসময় নারীকর ওপর কর্তৃত্ব করতে চায়। নারীকে বশে রাখতে চায়। ফলে নারীর বেতন বৈষম্য সেই কর্তৃত্বেরই বড়াই। বেতন-ভাতা-মজুরির এই বৈষম্য আর চলতে দেওয়া যায় না। এলক্ষে এখনই উপর্যুপরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। নতুবা নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতের যে এজেন্ডা বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ তা মুখ থুবড়ে পড়বে৷ নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন নারীর মানসিক শক্তির অন্যতম উৎস। সমাজের বৈষম্য দূর করার অন্যতম সহায়ক।
একজন ছেলে সন্তানের জন্য সমাজ যতটা অনুকূল মেয়ের জন্য ঠিক তার বিপরীত। কোনরকম শিক্ষার গণ্ডি যদি নারী পেরোয় তবে তাকে তার অমতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় অধিকাংশ সময়। পরবর্তীকালে নারী গৃহবধূ হবে নাকি পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করবে সে সিদ্ধান্তও স্বামী বা তার পরিবার থেকে আসে। নারী আজও সে সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে না কারণ বিবাহিত নারী মানেই তার সব সিদ্ধান্ত নেওয়া বা দেওয়ারর ক্ষমতা স্বামী নামের প্রভুটির ফলে সেখানে নারীকে নত থাকতেই হয়। নতুবা সংসারে অশান্তি শুরু হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আবার নারী যখন কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করছেন তখন এই পুরুষই নারী শব্দের মধ্যে কোট-আনকোট করে পারিশ্রমিকে বৈষম্য করছেন!
অর্থনীতিতে নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক ক্লডিয়া গোলডিন তার গবেষণায় তুলে ধরেছেন, নারীর প্রতি সমাজের বৈষম্য, অর্থনীতিতে নারীর অংগ্রহণ সম্পর্কে। তিনি গবেষণায় তুলে ধরেছেন, উন্নত দেশগুলোতে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বাড়ছে। উন্নত অনেক দেশে গত এক শতাব্দীতে মজুরি বা বেতনভিত্তিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু সমস্যা রয়ে গেছে মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে। সাধারণত মনে করা হয়, নারীরা পুরুষের তুলনায় কর্মশক্তির দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে; তাই তার মজুরি বা বেতন কোনোভাবেই একজন পুরুষের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না। গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে, উনিশ শতকে কর্মক্ষেত্রে বিবাহিত নারীর অংশগ্রহণ কমেছে; কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে সেবা খাতের ব্যাপক বিস্তারের ফলে কর্মক্ষেত্রে বিবাহিত নারীর অংশগ্রহণ আবারও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে নারী লৈঙ্গিক বৈষম্যের শিকার। মজুরি-ভাতা-বেতন প্রদানে তাকে মানুষ নয় নারী হিসেবে গণ্য করা হয়। এ কারণে দেখা যায় অধিকাংশ গার্মেন্টসে নারী শ্রমিক বেশি। কারণ তারা অধিকার আদায়ে বার বার পথে নামতে পারে না। দারিদ্র্যতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অধিক মুনাফা অর্জন! পুরুষতান্ত্রিক এই মানসিকতা পরিবর্তন করা জরুরি৷
কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে কথাটা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ পোশাকখাতে নারী বেশি শ্রম দিলেও সেখানে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা নেই। অনন্যা পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত। সমাজ থেকে এ ধরনের বৈষম্য দূর করতে হবে। তবেই নারী তার কাজের প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হবে। কাজের মান ভালো হবে।