Skip to content

২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুজিব বায়োপিক: কিছু কথা

মার্কিন ফার্স্ট লেডি আন্না এলিয়ানর রুজভেল্ট বলেছিলেন, ‘অ্যা উইম্যান ইজ লাইক অ্যা টি ব্যাগ- ইউ কান’ট টেল হাউ স্ট্রং সি ইজ আনটিল ইউ পুট হার ইন হট ওয়াটার।’ নারীর ক্ষমতা তখনই বুঝতে পারা যায় যখন তাকে নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ কিংবা পরিবেশ দেওয়া হয়। কথাটার দেশি দৃষ্টান্ত গভীর আকারে রেখে গেছেন আমাদের রেণু। এই ছোট্ট রেণুই প্রস্ফুটিত পুষ্প হয়ে গোটা স্বাধীন দেশ গর্ভে ধারণ করেছেন দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে। শুধু নয় মাসের হিসেব করলে মাহাত্ম্য ঠিক প্রকাশ পাবে না। শেখ মুজিবের মহানায়ক হয়ে ওঠার পেছনে মূল কারিগর তিনি। পুরো নাম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ডাকনাম তার রেণু।

সম্প্রতি দেশে মুক্তি পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী নিয়ে বানানো চলচ্চিত্র, মুজিব: একটি জাতির রুপকার। ডুবতে বসা বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পে সদ্য মুক্তি পাওয়া এই ছবিটি যেন নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করেছে। হলভর্তি দর্শক, নিরলস মনোযোগ পর্দায়। গল্পটা ছোট্ট খোকা থেকে মুজিব হয়ে ওঠার। গল্পটা স্বাধীনতার, সংগ্রামের, লড়াইয়ের। এককথায় বলতে গেলে গল্পটা আমাদের। 

অজপাড়াগাঁয়ের কাঁদা-ধুলো গায়ে মেখে, মধুমতি, বাঘিয়ার কিংবা শৈলদাহ নদীর বুকে সাঁতরে বেড়ে উঠা বিপ্লবী তরুণ তার যৌবন দিয়েছিল হানাদার পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগারে, গল্পটা বিপ্লবের।একজন পিতা যখন তার সন্তানদের রেখে জেলে তখন তাদের নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম কতটা ভয়াবহ তা মোকাবিলা করেছেন রেণু। রেণু শুধু মাতা নন, বঙ্গমাতাও বটে। তিনি একজন আদর্শ রাজনীতিকও। পুরো লড়াই-সংগ্রাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কখনই একা চালিয়ে যেতে পারতেন না যদিনা রেণু থাকতেন।

যখন মুজিব ছয় দফার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন দশা বেগতিক দেখে আয়ুব খান সমঝোতার জন্য তাকে ডাকলেন। ছয় দফা দাবি থেকে সরে আসার শর্তে শেখ মুজিবকে তিনি পাকিস্তানের গভর্নর থেকে শুরু করে অঢেল অর্থ সম্পদের লোভ দেখালেন। বিনিময়ে মুজিবের জবাব ছিল, ‘দেখি, হাসুর মায়ের সঙ্গে একটু আলাপ করে।’ তিনি যখন রেণুকে বললেন আয়ুব তো আমাকে গভর্নর বানাতে চায়, তখন তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন, আয়ুব তোমারে গভর্নর বানানো কে? গভর্নরকে হবে তা ঠিক করবে দেশের জনগণ। 

বঙ্গবন্ধুর পছন্দের মনিষী ছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল। সিনেমা থেকে জানা গেল শেখ রাসেলের নামটা তিনি এই বিখ্যাত মনিষীর নাম থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে রেখেছেন। তার লেখা পড়তে হলে কিংবা বুঝতে হলে একজন মানুষের চিন্তাভাবনা কিংবা জ্ঞানের ক্ষুধায় তীক্ষ্ণতা প্রয়োজন। রেণু হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিদূর যেতে পারেননি, কিন্তু তিনি স্বশিক্ষায় এতটা শিক্ষিত ছিলেন যে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন দুরদর্শী রাজনীতিবিদকেও দুঃসময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেছেন। তিনি বার্ট্রান্ড রাসেল পড়তেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে বিস্তর আলোচনাও করতেন। এমনকি ছয় দফা দাবি কিংবা স্বাধীনতার ঘোষণার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো মুজিব নিয়েছিলেন রেণুর কাছ থেকে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পর। 

১৭৮ মিনিটের সিনেমায় এভারেস্টের মতো উঁচু একজন ব্যক্তির পুরো জীবনের গল্প ফুটিয়ে তোলার যে চ্যালেঞ্জ পরিচালক শ্যাম বেনেগাল নিয়েছেন তা তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই মোকাবিলা করতে পেরেছেন। বিশেষভাবে পর্দায় নজর কেড়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চরিত্রে অভিনয় করা তৌকির আহমেদ। বাস্তব জীবনে এই প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ পরিষ্কার বাংলা বলতে পারতেন না। সিনেমাতে এই বিষয়টি খুব চমৎকারভাবে অভিনয় করে দেখিয়েছেন তৌকির আহমেদ। 

গল্পের প্রাণ দিয়েছেন নাম চরিত্রে আরেফিন শুভ। পুরো সিনেমাজুড়ে মনে হবে একজন অসাধারণ অটল ব্যক্তিত্বের অধিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেই পর্দায় দেখছি। সেই অঙ্গভঙ্গি, বিখ্যাত স্টাইলে ঠোঁটের ফাঁকে গুজে থাকা পাইপ, বলিষ্ঠ কণ্ঠে পাকিস্তানের গণপরিষদের ভাষণ সবই তিনি বেশ যত্ন নিয়েই করেছেন। আর রেণু চরিত্রে নুসরাত ইমরোজ তিশা ছিলেন অনবদ্য। 

খন্দকার মোশতাক চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু এবং মওলানা ভাসানীর চরিত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদ দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। বাকি চরিত্ররাও ভাল করেছেন। এবার মূল গল্পে ফেরা যাক আবার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রেণুসহ পরিবারের অন্য সদস্যকে (শেখ হাসিনা, শেখ জামাল, শেখ রেহানা, শেখ রাসেল, এম এ ওয়াজেদ মিয়া এবং অন্যান্য) মগবাজার অথবা কাছাকাছি কোনো এলাকার এক ফ্ল্যাট থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আটক করে নিয়ে যায় ১২ মে ১৯৭১ তারিখে। তারা সকলেই ধানমন্ডির বাড়ি ২৬, সড়ক ৯এ (পুরনো ১৮)-তে বন্দি অবস্থায় ছিলেন ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত।

চারদিকে তখন বোমার প্রচণ্ড শব্দ আর এদিকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হানাদারদের হাতে বন্দি বঙ্গবন্ধুর পরিবার। শুধু নারী নয়, মানুষ হিসেবে পাহাড়সম মনোবল না থাকলে এই পরিস্থিতিতে তখন টিকে থাকা ছিল অত্যন্ত কঠিন।

রেণু এই অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেও পরিবারের সদস্যদের আগলে রেখেছেন। অপেক্ষা করেছেন স্বাধীনতার, নতুন সূর্যের। ঠিক যেমন করে একজন মা তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে রেণুও তেমনি এই স্বাধীন দেশ তার গর্ভে ধারণ করেছেন। তাইতো তিনি আজ বঙ্গমাতা।

এবার আসা যাক সিনেমার কিছু ঘাটতির কথায়। মুজিব সিনেমায় কিছু দৃশ্যে পরিচালক মনে হয় একটু বেশি তাড়াহুড়ো করেছেন। যেমন ভাষা আন্দোলন আর মহান ৭ মার্চের ভাষণের দৃশ্যে আরেকটু সময় দিয়ে করতে পারলে মনে হয় পূর্ণতা পেত। ছয় দফার ঘোষণা আর ৭ মার্চের ভাষণে আরও বেশি জনসমাগমের দৃশ্য ধারণ করতে পারলে বাস্তব মনে হতো। কারণ আমরা ৭ মার্চের ভাষণে সবসময় দেখে এসেছি লাখ লাখ জনতার সমাগমের সামনে ভাষণ দিচ্ছেন শেখ মুজিব।

স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর যতটা বয়স হয়েছিল পর্দায় ততটা ফুটিয়ে তোলা হয়নি। সিনেমায় তাকে দেখে যুবকই মনে হয়েছে। রেণু চরিত্রটাকে শেষ দিকে একটু বয়স্ক নারীর ছাপে উপস্থান করা হয়নি। আরেকটু বয়স্ক নারী হিসেবে তিশাকে উপস্থাপন করা যেত। কিছু দৃশ্যে আরেফিন শুভকে দেখা গেছে কালো চুলে। কিন্তু তার পরের দৃশ্যেই আবার পাকা চুল। এই জিনিসটা হয়তো পরিচালক খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি বলে মনে হয়েছে।
তবে পুরো সিনেমার কথা বলতে শ্যাম বেনেগাল সফল। তিনি একটি জাতির রূপকারকে বেশ ভালভাবেই দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর কৈশোরের সময়কার দৃশ্যগুলো তিনি দারুণভাবে দেখিয়েছেন। যেন সেই হারিয়ে যাওয়া গ্রাম বাংলা, সোনার মানুষ আর সোনালি দিন। নদীতে বয়ে যাওয়া ছৈ তোলা নৌকা বাড়তি সৌন্দর্য যুক্ত করেছে সিনেমায়। আর দৃশ্যের সঙ্গে গানের বিষয়টা ছিল একদম মানানসই।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ