শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যা: দ্রুত সমাধান চাই
বর্তমানে সবাই একটা যান্ত্রিক সময় পার করছে। মানুষের একমাত্র সম্বল স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট। আর এই চক্রে পড়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। মাদক যেমন শরীর-মনকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে, তেমনই ফোন ও ইন্টারনেটের নেশায়ও মানুষ বুঁদ হয়ে পড়ছে। প্রত্যেকটা আসক্তিই মানবজীবনকে ক্ষুণ্ন করে। ঠিক তেমনই এক আসক্তি এ সমাজকে ঘিরে ধরেছে। পারিবারিক সম্পর্কগুলো যতটা শিথিল হচ্ছে, ঠিক ততটাই জীবনযাপনের ক্ষেত্রে মানুষ অন্যমুখী হচ্ছে। নিজদের মনসিকভাবে চাপমুক্ত রাখতে গিয়ে ঠিক ততটাই চাপ বাড়াচ্ছেন এখনকার শিক্ষার্থীরা।
সম্প্রতি একটি গবেষণায় এমনকিছু ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। যা আরও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। মানুষ দিনদিন কতটা অনিরাপদ হয়ে উঠছে তা এই গবেষণটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় উঠে এসেছে, যেসব শিক্ষার্থী জীবনে কখনো না কখনো মানসিক সমস্যায় পড়েছেন, তাঁদের ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশই এর কারণ হিসেবে ইন্টারনেটের কোনো না কোনো ভূমিকার কথা বলেছেন। ব্যবহারকারী শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ অবসর কাটাতেই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এবং অনেকেই আসক্তি অনুভব করছেন।
আঁচল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রভাব: কতটুকু সতর্ক হওয়া জরুরি’ শীর্ষক সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়। অনলাইনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সমীক্ষার ফল তুলে ধরেন ফাউন্ডেশনের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস ইউনিটের সদস্য ফারজানা আক্তার। সেখানেই এসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত সমীক্ষার কাজ হয়েছে। সমীক্ষায় ১ হাজার ৭৭৩ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন, যার মধ্যে নারী ৪৯ দশমিক ৫ এবং পুরুষ ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের আছেন শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭২ দশমিক ২ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা জীবনে কখনো না কখনো মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন, তাঁদের মানসিক সমস্যার পেছনে ইন্টারনেটের ভূমিকা রয়েছে।
মানসিক সমস্যার কারণ হিসেবে ইন্টারনেটকে পুরোপুরি দায়ী মনে করেন ২৬ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর মোটামুটি দায়ী ভাবেন ৫৯ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষার্থীর বয়স ১৬ থেকে ১৯ বছর, ৭৬ দশমিক ৩ শতাংশের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর এবং ১০ দশমিক ৫ শতাংশের বয়স ২৬ থেকে ৩০ বছর। এসব শিক্ষার্থীর ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ অপরিমিত ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।
সমীক্ষা বলছে, পড়াশোনার কাজে ৯৪ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। কিন্তু পড়াশোনার ফাঁকে অনলাইনে প্রবেশ করলে ৫২ দশমিক ৬ শতাংশের পড়াশোনার মনোযোগ হারিয়ে যায়। এবং ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি আসক্তি অনুভব করেন। তাঁদের মধ্যে ‘খুব বেশি আসক্ত’ ২২ দশমিক ৪ শতাংশ, ‘মোটামুটি আসক্ত’ ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ‘অল্প আসক্ত’ ২০ দশমিক ৯ শতাংশ।
আঁচল ফাউন্ডেশনের এই সমীক্ষা ভবিষ্যতের যতটা কতটা হুমকি স্বরূপ তা স্পষ্ট। বর্তমান জীবনযাত্রাকে গিলে খাচ্ছে এই স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট। শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক বিকাশ রোহিত হচ্ছে। তাদের মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটছে। কারণ ইন্টারনেট ঘাটলেই এক ধরনের বিষণ্ণতা এবং অস্থিরতা মানুষের মধ্যে অজনা কারণেই ঢুকে যায়। এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যায়, মিথ্যা কনটেন্ট, অসামাজিক কথাবার্তা, বিকৃত রুচির প্রলাপ, মিথ্যা অহং প্রভৃতি। বিশেষ করে ইন্টারনেটের যুগে কমোলমতি শিক্ষার্থীদের আরও বেশি গ্রাস করছে মিথ্যা বা ভুল প্রচারণা। হাসির খোরাক করতে গিয়ে নীতি-নৈতিকতার জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে সমাজ। এর ফলে মানুষের মনেও প্রভাব পড়ছে।
অবক্ষয়ের এই যুগে সন্তানেরা ভালো-মন্দের বিভেদ ভুলে যাচ্ছে। বয়স হওয়ার আগেই তারা এমন কিছু কনসেপ্ট এবং কনটেন্টের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে যাতে তাদের মনে ননেতিবচক মনোভাব সৃষ্টি করছে। ছেলে শিক্ষার্থীরা যেহেতু বাইরের পরিবেশ বা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কিছু গল্প, আড্ডা দিতে পছন্দ করে। এবং তাদের জীবনযাপন অনেকটা বহির্মুখে ফলে তারা কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাচ্ছে। কিন্তু মেয়ে শিক্ষার্থীরা ছোট থেকেই বেশ লাজুক প্রকৃতির। পরিবারের সবার অগোচরে নিজেকে বড় করে তোলে। শৈশব পেরিয়ে কৈশোর এবং যৌবনে পা দেয়। সে সময় মা বা পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না থাকলে মেয়েদের জীবনে প্রথমেই একটা ধাক্কা লাগে। ফলে ছাত্রীদের ক্ষেত্রে এই নাভিশ্বাসপূর্ণ জীবন আরও বিষণ্নতা সৃষ্টি করে!
মানসিক সমস্যাকে কমিয়ে আনতে হলে প্রথমেই ফোন এবং ইন্টারনেটের আসক্তি কমাতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাস্তবতা এবং কল্পনার মধ্যে আকাশ-পাতাল প্রভেদ। ফলে যা অনলাইনে দেখানো হয় সেটার নিরানব্বই ভাগই মিথ্যা। এবং এটা শুধু হিসেব অনুযায়ী নয়, দেখুন আপনি বা আমি যে ছবিটা ফেসবুক প্রোফাইলে দিই তা নিজের কাছে শতভাগ সুন্দর হলে তবেই দিই। ফলে এই ছোট্ট একটি দিয়ে আমরা বুঝতেই পারি, কনটেন্ট বা অন্যান্য যা দেখানো হয় সবটা সাজানো-গোছানো। প্রকৃতার্থে মানুষের জীবন এতটা গোছানো বা সাজানো নয়। তবু শিক্ষার্থীরা মানসিক ট্রমায় পড়ছে। কষ্ট পাচ্ছে! কেউবা জীবনের প্রতি বেশি বিতৃষ্ণ হয়ে মারা যাচ্ছে!
সমাজের সবার সহোযোগিতা ছাড়া বর্তমান প্রজন্মকে রক্ষা করা দায়। মানসিক সমস্যা থেকে বের হতে হলে আগে সবাইকে ফোন এবং ইন্টারনেট আসক্তি কমাতে হবে। ফোনের বদলে হাতে বই নিতে হবে। একটি বই হাজার মানুষের চেয়ে ভালো বন্ধু। ফলে এই বন্ধুই পারে জীবনের গতি দান করতে। জীবনকে মুখর করতে।