বাল্যবিবাহ বন্ধ হোক: এগিয়ে যাক নারী
সম্প্রতি নানা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলেও নারীদের জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে গোড়ায় গলদ রয়েই গেছে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক কন্যাসন্তানকে পাত্রস্থ করার মধ্যে দিয়ে তার জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনা হচ্ছে। আজও আমাদের সমাজে একশ্রেণীর মানুষ বিদ্যমান মেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষা, স্বাধীন জীবনযাপনকে গণ্য করে না। তাদের মতে, মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করলেই অন্যের ঘর-সংসারের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। আর অন্যের ঘরের বোঝা যেহেতু টানতেই হবে তাই এত বিদ্যে-বুদ্ধির কী দরকার!
ফলে এসব বিবেকহীন মানুষেরা ছোট্ট কন্যা শিশুকে মৃত্যুর ফাঁদে আঁটকে ফেলছে। যা থেকে কোনভাবেই মেয়েটির পরিত্রাণ ঘটে না। নরকসম জীবনযাপন করতে হয় বেশিরভাগ সময়।
যুগের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু চিন্তাধারার যে আমূল পরিবর্তন হয়নি তা এই ঘটনার মাধ্যমেই দৃশ্যমান হয়। আজও ছোট্ট মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার নামে প্রহসন চলছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কন্যা সন্তানকে বিয়ে দিয়ে বাড়তি বোঝা বহন করতে বাধ্য করা হচ্ছে! যে সময়টা একজন মেয়ের পূর্ণ বিকাশের সেই সময়টাতে সংসারের ঘানি টানতে অভ্যস্ত করে তোলা হচ্ছে। আমরা জানি, এমনিতেই নারীদের জীবন এ সংসারে মেনে নেওয়া এবং মানিয়ে নেওয়ার মধ্যে দিয়েই অতিবাহিত হয়। তারওপর যদি কৈশোর-যৌবনের গণ্ডি পেরুতে না পেরুতেই স্বামী-সংসার নিয়ে ঘর করতে হয় তবে তার জীবনে দুঃসহ যন্ত্রণার শেষ নেই!
এই মেয়েরা সামাজিকভাবে যেমন জড়বস্তু হয়ে উঠবে তেমনই ব্যক্তিজীবনে রোগ, শোক, জ্বরা তো আছেই। এছাড়া শিক্ষার অভাব থাকায় পরিবার-পরিজনের কাছে প্রতিনিয়তই অসম্মানিত হতে দেখা যায়। নিজের স্বাধীন জীবন বলে কিছুই থাকে না। আজীবন স্বামীর গলগ্রহ হয়েই জীবন নির্বাপণ করতে হবে। কিন্তু যেই স্বামী-সন্তানের মুখ চেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার নারী সব বিসর্জন দেয় তারাই সুযোগ পেলে তাকে আঘাত করে। ক্ষত-বিক্ষত করে নারীর মান-মর্যাদাকে। আর শিক্ষা এবং জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ না ঘটায় তিনি অধিকাংশ সময় হতাশা-বিষাদে ভোগেন।
খুব বেশি দিনের কথা নয়, অনুষ্ঠিতব্য এস.এস.সি. পরীক্ষার দুটি ঘটনা বিশেষভাবে আমাদের দেশে বাল্যবিবাহের হার কত তা বুঝতে সাহায্য করেছে। এখন যেহেতু প্রযুক্তির যুগ তাই রীতিমতো ভাইরাল হয় ঘটনা দুটি। প্রথমটি হলো: এক এস.এস.সি. পরীক্ষার্থী (ছাত্রী) তার স্বামীকে দাফন করে এসে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। আর একজন কয়েকদিনের সন্তান কোলে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। প্রত্যেকবারই এমন কিছু না কিছু ঘটনা মিডিয়ায় উঠে আসে। অনেকেই প্রথম নারীর মনোবল নিয়ে কথা বলছেন, কেউবা তার বিবেকেরও প্রশ্ন তুলেছেন। দ্বিতীয় নারীর ঘটনা এ সমাজে খুবই স্বাভাবিক তাই এ নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা দেখা যায়নি। তবে যারা অতি সচেতন এবং বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন তারা নারীর মানসিক ও শারীরিক বিষয় নিয়ে চিন্তা প্রকাশ করেছেন। তবে ঘটনাগুলো মর্মান্তিক হলেও তা আমাদের বিবেকবোধ কতটা তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এ সমাজে নারীর সঙ্গে এমন অন্যায় প্রতিনিয়তই ঘটছে। পরিবারের বাধ্য সন্তান হওয়ার কারণেই মেয়েরা সব মুখ বুজে সহ্য করছে। শ্বশুরবাড়ি এসে তাদের অত্যাচার-গঞ্জনা সহ্য করতে হচ্ছে। স্বামীর ফাই-ফরমাশ খাটতে হয়। কারণ আজ অবধি অধিকাংশেরই ধারণা এদেশে স্ত্রী হলো পার্মানেন্ট দাসী! এবং এটা শুধু ধারণা নয় বরং এর উপর্যুপরি ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় সমাজে। আর অভিভাবকবৃন্দ কন্যা সন্তানের দাসত্বকেই স্বীকার করে তাকে অন্যের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত থাকে।
সাংসারিক-শারীরিক নানা জটিলতা দেখা দিলেও সব সমস্যা ওই নারীকেই সহ্য করতে হয়। এখন পর্যন্ত দেখা যায়, বাল্যবিবাহের ফলে যে নারীরা ভাগ্যবিড়ম্বিত তার সব সমস্যার সমাধানও তাকে ঘিরেই গড়ে ওঠে। মৃত্যুবধি মেনে নিয়ে এবং মানিয়ে নিয়ে সংসার যাপন করতে হয়। দিনের শুরু থেকে শেষ অবধি প্রতিটি মুহূর্ত পরিবারের ভালো-মন্দ ভেবে দিন কাটতে হয়। নারীর নিজস্ব শখ-আহ্লাদ- স্বপ্ন সেখানে নস্যি। কারণ অভিভাবকেরা মেয়েকে শিক্ষা দিয়েই গড়ে তোলেন। তার সুখ-স্বপ্ন থাকতে নেই। বিধায় নারীর সবকিছু পরিবারকে কেন্দ্র করে। এই প্রহসন আর কত!
দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়া থেকে শুরু করে সাংসারিক দ্বন্দ্ব, শিক্ষাহীনতা, অজ্ঞাতা, মানসিক স্ট্রেচ সবই ঘিরে থাকে। যা বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের জীবনের স্বাভাবিক গতি রোহিত করে। তাই মেয়েদের সুস্থ এবং সুন্দর জীবনের তাগিদে বাল্যবিবাহ রোহিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। বাল্যবিবাহের করাল গ্রাসে সমাজে যেসব অবক্ষয় দেখা দিয়েছে তা যেন প্রতিহত করা যায় সেলক্ষে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। কিশোরী-তরুণীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পথ নাটক, সেমিনার, সভা, চিত্র প্রদর্শনী করতে হবে। যাতে এর অপকার সম্পর্কে সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়। বন্ধ হোক বাল্যবিবাহ। মেয়েরা সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে সক্ষম হোক। সর্বোপরি এগিয়ে যাক নারী তার আপন লক্ষে।