নারীরা বাঁচেন বেশি, ভোগেনও বেশি
দেশের নারীদের গড় আয়ু পুরুষদের তুলনায় বেশি। নারীদের গড় আয়ু যেখানে ৭৫, পুরুষদের সেখানে ৭১। এক্ষেত্রে নারীরা যেমন বেশিদিন বাঁচেন, তেমন জীবনকালে ভোগেনও বেশি। আমাদের দেশের নারীদের স্বাস্থ্য নিয়ে সুখকর কোনো তথ্য আপাতত নেই। অতীতেও ছিল না। বরাবরই নারীরা ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের অধিকারী। কন্যাশিশু থেকে শুরু বিবাহিত নারী বেশিরভাগই অপুষ্টিতে ভুগছেন।
একজন নারী বা একজন পুরুষ, তার দৈনন্দিন জীবনের খাওয়া-দাওয়ার রুটিন এবং বেসিক লাইফ স্কিল নিয়ে হবে সচেতন। তবে নারী ও পুরুষের শারীরিক স্বাস্থ্যগত ভিন্নতা থাকে। এজন্য তাদের পুষ্টির চাহিদাও থাকে ভিন্ন। যেমন, আয়রন সংকট। রক্তের আয়রনের ঘাটতি থাকলে তখন সেটা কে রক্তশূন্যতা বলা যায়। নারীদের রক্তশূন্যতার যে হার সেটা পুরুষের তুলনায় বেশি। কারণ নারী-পুরুষের শরীরে আয়রনের চাহিদা সমান থাকেনা। বরং নারীদের আয়রনের চাহিদা অপেক্ষাকৃত বেশি হয়৷ বাংলাদেশে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ রক্ত শূন্যতায় ভোগে। এর মধ্যে বেশিরভাগই নারী।
দেশের প্রায় ৪২ ভাগ নারী রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। রক্তস্বল্পতা মূলত অনেক কারণেই হয়ে থাকে। তার মধ্যে কিছু বিশেষ কারণ হচ্ছে, সন্তান জন্মদানের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, পিরিয়ডের সময় পুষ্টিকর খাবার না খাওয়া, লোহিত রক্ত কণিকা (রেড ব্লাড সেল) নষ্ট হলে বা উৎপাদন কম হওয়া। এর মধ্যে বেশিরভাগ ভুক্তভোগীই হলেন গ্রামাঞ্চলের নারীরা। কারণ রক্তশূন্যতা নিয়ে বিশেষ কোনো জ্ঞান তাদের কাছে সহসা পৌঁছায় না। গ্রামাঞ্চলে নারীরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। যার কারণে, তারা নিজের যত্ন নেওয়া সম্পর্কে এখনো অপরাগ৷
কোন খাবার খেলে শরীরে আয়রনের চাহিদা পূরণ হবে, কোন খাবারের পুষ্টিমান কী, সে সম্পর্কে তাদের জানার পরিসর হয় সীমিত। অনেকে জানেনই না আয়রনের ঘাটতি পূরণ করতে হলে খাদ্যাভাসে পুষ্টিকর খাবার তালিকাভুক্ত করার বিকল্প নেই। অনেকে আবার অর্থ সংকটে পড়ে নিজের প্রতি যত্নশীল থাকেন না। তবে এ ধারণাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। আয়রনের উৎস কেবল মাছ, মাংস, দুধ, কলা থেকেই বেশি পাওয়া যায় তেমন নয়, সবুজ শাকসবজি, কচুশাক, পেয়ারার মতো সবজি-ফলেও পাওয়া যায়।
রক্তস্বল্পতা হওয়ার আগেই যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেক্ষেত্রে অনেক নারীই সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত করা যায়। যেমন, রক্তস্বল্পতা নিয়ে দৈনন্দিন জীবনে স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেহেতু, রক্ত শরীরে অক্সিজেন সরবরাহের কাজ করে সেহেতু, রক্তশূন্যতা হলে অনেক বেশি ক্লান্ত লাগা, ক্ষত চিহ্ন না শুকানো, সারাক্ষণ দুর্বল লাগার মতো জটিলতা দেখা দেয়। যা দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন কাজে নারীর অংশগ্রহণ অনেকটাই স্তিমিত করে দেয়।
আবার কখনো কখনো রক্তশূন্যতা অনেক তীব্র রূপও ধারণ করতে পারে। যেমন, ক্যান্সার, লিভার ফেইলিউর, কিডনি ফেইলিউরের মতো অনেক মারাত্মক ব্যাধি। নারী সন্তান জন্মদানের ৪০ দিনের মাথায় যদি মৃত্যুবরণ করে, তাহলে তাকে প্রসবকালীন মৃত্যুই বলে। গর্ভবতী থাকাকালীন নারীর শরীরে যেহেতু হিমোগ্লোবিনের মাত্রা আরও কমে যায়, সেহেতু অনেক নারী সন্তান জন্মদানের পর নানা জটিলতায় মারা যান।
সরকারের ২০১০ সালের জরিপ অনুযায়ী প্রসবকালে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ৩১ শতাংশ, খিঁচুনিতে ২০ শতাংশ, প্রসব জটিলতা বা দীর্ঘ সময় ধরে প্রসবের কারণে ৭ শতাংশ, গর্ভপাতের কারণে ১ শতাংশ, পরোক্ষ কারণ (হৃদ্রোগ, জন্ডিস ইত্যাদি) ৩৫ শতাংশ, সরাসরি অন্যান্য কারণ ৫ শতাংশ এবং অজানা কারণে ১ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালের জরিপেও দেখা যাচ্ছে, রক্তক্ষরণে ৩১ শতাংশ এবং খিঁচুনির কারণে ২৪ শতাংশ মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের গবেষণা অনুযায়ী, ৪২ ভাগ নারীর মধ্যে ৬৫ ভাগ নারীই গ্রামীণ জনসংখ্যা। বয়সন্ধিকালীন মেয়েদের মধ্যে রক্তশূন্যতাতার প্রাদুর্ভাব শতকরা ৪৩ ভাগ। অ-গর্ভবতী নারী মধ্যে সেটার হার ৪৫ ভাগ এবং গর্ভবতী শতকরা ৪৯ ভাগ।
অনেকেই মনে করে পিরিয়ডের কারণে নারীদের হিমোগ্লোবিন কম থাকাই স্বাভাবিক । কিন্তু মেয়েদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ১২ থেকে নিচে নামা মানেই সেটা কে রক্তশূন্যতা বল ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, স্বাস্থ্য নিয়ে সাধারণ জ্ঞানের ব্যপারে সামাজিক সচেতনতা এখনো নিবিড়ে অবস্থান করছে।
দেশে বিবাহিত নারীদের এতো বেশি অপুষ্টিতে ভোগার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাঙালি সাধারণ পরিবারগুলোতে একজন বিবাহিত নারী খাবার খায় স্বামী সন্তানকে খাওয়ানোর পরে। এক্ষেত্রে খাবারের অবশিষ্টাংশই তারা গ্রহণ করে। এটি তাদের অপুষ্টিতে ভোগার একটি বড় কারণ। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের নারী বা পুরুষ কেউ সুষম খাবার বলতে কি বোঝায় তা জানেন না। তারা ভাত খাওয়ার জন্য তরকারি খায়। শাকসবজি ও ফলমূল যে খাবারের একটি অংশ সে হিসেবে তারা এটি খান না। অর্থাৎ পুষ্টিসম্পর্কিত পূর্নাঙ্গ ধ
পুষ্টিসম্পর্কিত পূর্নাঙ্গ ধারনা থাকার অভাবে কোন খাবার খেতে হবে সে ব্যাপারে তাদের জানাশোনা কম। আবার অনেকেই ভালো খাবার বলতে মাছ মাংসই বোঝেন। মাছ-মাংস বাদে শাকসবজি বা ডালের মাধ্যমেও যে প্রোটিন পাওয়া যায় তাও তারা জানেনা৷ তৃতীয়ত নিজের শরীর নিজেকেই দেখতে হবে এই বোধের অভাব।
দেশে সরকারি, বেসরকারি এতো উদ্যোগ এতো সচেতনতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা তবুও কেন উন্নতি নেই বরং অবনতি চোখে পরার মত। পুষ্টি সম্পর্কিত যে আচরণ তা বদলাতে হলে শুধু বাইরের কোনো উদ্যোগেই কাজ হবে না। এটি পরিবারের সদস্যদের মর্মমূলে পৌঁছাতে হবে, বিশেষ করে পুরুষ সদস্যদের। কারণ, পুরুষ সদস্যরা যদি তাদের পরিবারের নারী সদস্যদের একই অবস্থানে টেনে না আনে তবে নারীরা অগ্রসর হতে পারবেনা। বিবাহ, সন্তান লালনপালন, রান্নাবান্না যদি একজন মানুষের জীবনে আবশ্যিক কর্ম হয়, তাহলে স্বাস্থ্যরক্ষা কেন নয়? নারীর বেঁচে থাকাই শুধু নয় সুস্থভাবে বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে হবে।