লালন: মানবতাবাদী দর্শনের রূপকার
মহাত্মা লালন সাঁই (১৭ অক্টোবর ১৭৭৪-১৭ অক্টোবর ১৮৯০) বাঙালিদের মধ্যে অন্যতম মানব দরদি, সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক। ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাতভেদে যিনি মানুষকে একই ছায়াতলে স্থান দিয়ছেন। তার এরূপ অসাম্প্রদায়িক মনোভাব পরিণতি পেয়েছে গানে, দার্শনিক চিন্তা-চেতনায়। এজন্যই তার গান ও দর্শনিক চিন্তায় ডুব দিয়েছেন বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকেরা। খুঁজে পেয়েছেন মহত্তম সুর। যেখানে বাস করেছেন লালন একা। তার জগতের তিনিই অধীশ্বর হলেও সেখানে সর্বস্তরের মানুষের প্রাণকে তিনি ছুঁতে পেরেছেন। খুঁজতে শিখিয়েছেন আপন জগৎকে। যুগ যুগ ধরে তার বাণীর সঙ্গে মানুষের সম্প্রীতি গড়ে উঠলেও বাস্তব জীবনে প্রয়োগ ঘটেছে কতটা?
লালনের গানে প্রাণের আলাপন। জেগে ওঠে প্রাণ। চেতনারা হাতড়ে খোঁজে তার মুক্ত সত্তাকে। এক একটি গানের অনবদ্য সুর এবং বাণীর বুননে হারিয়ে যায় মন। মানুষ নিজেকে না চিনে, জেনে, বুঝেই অন্যের দরবারে হাজির হয়। লালন বলেন, নিজের আত্মাকে জানার মধ্যেই রয়েছে পরম সুখ। কারণ পর অর্থে পরম ঈশ্বর আত্মারূপেই বিহার করে। তাই নিজের আত্মার পরিশুদ্ধি করতে হবে। লালন তার গানে বলেন, ‘রাজ সাঁই বলেরে, লালন /গুরুপদে ডুবে আপন/আত্মার ভেদ জানলে না /আত্মা আর পরম আত্মা ভিন্ন ভেদ জান না।’
আত্মায় ডুব দিলেই পরমাত্মাকে জয় করা যায়। আর পরমাত্মার মিলনেই প্রকৃত শান্তি। লালন মানবতার ধারক। তাই তিনি মানুষকে গণ্য করেছেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। মানুষ জন্মগ্রহণ করা জাত-পাত ছাড়া। কিন্তু তার জন্মসূত্রে সে বেড়ে ওঠে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের আবরণে। মৃত্যুকালেও সেই একই আবরণে তাকে আবেষ্টিত করে মানুষ। জীবনের সঞ্চার ঘটতেও পৃথিবীর অগ্রজরা তাকে নতুন বলয়ে নিয়ে আসে আবার মৃত্যু ঘটলেও তাকে তারাই বেঁধে দেয় সে কোন গোত্রের। তার কবর রচিত হবে, না কি দাহ হবে? ‘গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়/ তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়?’
লালন ধর্ম-গোত্রের ওপরে স্থান দিয়েছেন মানুষ এবং মানবতাকে। জাত গেলো বলে যারা প্রতিনিয়ত সমাজের মাঝে হাঙ্গামা সৃষ্টি করছে তাদের মধ্যে মানুষের মূল্য কতটা? মানুষ কি শুধুই ধর্মের রূপকার? যারা মিথ্যুক, ভণ্ড ধার্মিক তাদের সত্য কাজে পাওয়া যায় না। কিন্তু সর্বদাই জাত গেলো তা নিয়েই হট্টগোল। মানুষকে মানুষ হিসেবে নয় তারা মানুষকে ভাবেন হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানরূপে! লালন তাদের জন্যই গানে বলেছেন,
আসবার কালে কী জাত ছিলে
এসে তুমি কী জাত নিলে
কী জাত হবা যাবার কালে
সেই কথা ভেবে বলো না
ব্রাহ্মণ চণ্ডাল চামার মুচি
এক জলে সব হয় গো শুচি
দেখে শুনে হয় না রুচি
যমে তো কাউকে ছাড়বে না।
লালনের গানে শান্তি-সাম্য ও মানবতার কথা বলা হয়েছে। তিনি মানুষকে তার রিপুকে ছেড়ে আপন মনের গুনেই জয়ী হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। কারণ আত্মগুণে সমৃদ্ধি হলে তবেই মানবের মুক্তি ঘটে। জাত-পাত নয় বরং আপন মনের গুণেই সবাই নিজের হয়। দিল দরিয়ায় ডুব দিলে তবেই বিশ্ব জয় করা যায়। তাইতো লালন তার গানে বলেন,
আপন মনের গুণে সকলই হয়
পিড়ে নেয় পেড়োর খবর, কেউ দূরে যায়
জাতিতে জোলা ফকির
উড়িষ্যায় তাহার জাহির
বার দেশ জুড়ে তাহার
তুড়ানি যায়।
লালন কোনো জাতিভেদ মানতেন না। তাইতো নিজেকেও কোনো ধর্মের মধ্যে আবদ্ধ করেননি। তাইতো তার ভক্তকুল তিনি কোনো ধর্মের সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন। তার গানে যেমন ইসলামের উপস্থিতি ঠিক তেমনই হিন্দু ধর্মেরও উপস্থিতি লক্ষণীয়। তাই তো তিনি বলেছেন,
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন কয় জাতির কী রূপ দেখলাম না এ নজরে।
লালন ছিলেন সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি মুক্ত এক সর্বজনীন মানব। তাই তো তিনি সাম্প্রদায়িকতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে আজও মানুষের হৃদয়ে বাস করছেন।