মেহেরুন্নেসা: মুক্তির মন্দির সোপান তলে বলিদান
স্বাধীনতার রাজপথে কবির মৃত্যু! ইতিহাসের পাতা কলমের ছত্রকে মাথা পেঁতে ঠাঁই দেয় প্রচণ্ড মমতায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় অকাতরে প্রাণ বিলিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা যুদ্ধে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী দেখেই দেশের সূর্যসন্তানদের হত্যার হীন চক্রান্ত সফল করে। সেই হত্যার মিছিলে ছিলেন কবি মেহেরুন্নেসা। বলা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ কবি।
১৯৪২ সালের ২০ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের খিদিরপুরে এক মুসলিম পরিবারে এই কৃতি মানবীর জন্ম। দাঙ্গার শিকার হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয় পরিবার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও নিজ প্রচেষ্টায় শিক্ষিত হয়ে ওঠেন। নিজ ক্ষুরধার মস্তিষ্ক পরিচালনার সঠিক জায়গাটি পেয়ে গেলেন অচিরেই। শুরু করলেন লেখালেখি। ১৯৫২ সালেই ‘সংবাদ’ পত্রিকায় ‘চাষী’ নামে তার কবিতা প্রকাশিত হয়। একে সামান্য কৃতিত্ব ভাবলে হবে না। পাকিস্তানি খবর, দৈনিক পাকিস্তান, সংগ্রাম এবং ফিলিপস ম্যাগাজিন ইত্যাদিসহ নারীদের মুখপাত্র ‘বেগম পত্রিকাতেও’ তার লেখা প্রকাশিত হয়। ভাষা আন্দোলনের সময়েও কবিতার মাধ্যমে সরব ছিলেন মেহেরুন্নেসা। রাষ্ট্রীয় রোষানলে পড়েন।
কবিতাকে তিনি ব্যবহার করেছিলেন সৌন্দর্য, আন্দোলন, ব্যক্তিত্ব ও রুচির প্রধান প্রকাশ মাধ্যম হিসেবে। তার কবিতার প্রভাব এতটাই ব্যাপক ছিল যে ‘বেগম’ পত্রিকায় প্রতিনিয়ত কবিতা প্রকাশিত হতো। নারীমহলে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে অচিরেই রানু আপা নামটিও পেয়ে যান। এই নামেই ‘পাকিস্তানি খবর’-এর ‘মহিলা মহল’ পাতার সম্পাদনা করতেন। তার আত্মবিশ্বাস ও প্রতিভা দেখে সেসময়ের অন্যতম প্রধান নারী কবি সুফিয়া কামালও ভীষণ স্নেহ করতেন।
জীবনের বিশাল সময়জুড়ে শুধু কবিতা নয়, সাহসিকতার অনন্য সাক্ষর রেখেছেন বহু জায়গায়। মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে সবসময় সহাবস্থান করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতাকামীদের দমিয়ে দিতে হলো আশার প্রদীপগুলোকে একে একে নিভিয়ে দিতে হয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে হঠকারী শাসকরা এমনটিই করেছেন। পঁচিশে মার্চ কালরাতের ঠিক দুদিন আগেই আপন দুই ভাইকে নিয়ে ‘জয় বাংলা স্লোগানে’ মুখর করে তোলেন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকা কর্মসূচি। মিরপুরে যে বাড়িটি পৈতৃকসূত্রে পেয়েছিলেন, সেখানেই বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন। বিহারি অধ্যুষিত মিরপুরে এমন সাহসিকতা বিশেষত একজন নারীর পক্ষে করাটা সে সময় অকল্পনীয়।
এমন দেশপ্রেম পাকিস্তানি হানাদাররা ক্ষমা করে কিভাবে? ২৭ মার্চ আলবদর বাহিনী অতর্কিতে হামলা চালায় মেহেরুন্নেসার বাড়িতে। ছোট দুই ভাই ও মাকে হত্যা করে। মেহেরুন্নেসার চুলের মুঠি ধরে উঠোনে নিয়ে আসে। হাতের রামদা অন্ধকারে কোথাকার আলোতে চমকে ওঠে। এক কোপে কবির মাথা আলাদা হয়ে আসে। সেই কাটা মাথার বেণী করা চুল ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে ফ্যান ছেড়ে আনন্দোল্লাস করে পিশাচরা। মেহেরুন্নেসার দুই ভাইকে হত্যা করে সেই মাথা দিয়ে ফুটবল খেলে। এমন অমানবিক এবং পৈশাচিক বর্বরতার ঘটনা ইতিহাসে বিরল। তবু তা বাস্তব।
মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার ক্ষেত্রে কবি মেহেরুন্নেসার কথা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান শাসনামলে এতটা সাহসিকতার সঙ্গে অল্প কয়েকজন নারীই এগিয়ে এসেছেন। বিশেষত শাসকশ্রেণীও নারীদের তাদের হীনস্বার্থের প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিল। এমন এক নারীর জন্মদিনে জাতি ও বাঙালি নারী যতটা না গর্বিত হতে পারে, ততটাই হারানোর গাঢ় বেদনা যেন দগদগে ক্ষতের মতো বুকে অবস্থান করে। আগামী প্রজন্ম মেহেরুন্নেসাকে চিনুক। তার আজ সামনে আসুক। এই প্রত্যাশাই রইলো।