জীবিত ও মৃত: সমাজে নারীর অবস্থান
সাহিত্যে সমাজের প্রতিফলন ঘটে। আর কথাসাহিত্যে এই প্রতিফলন ঘটে একটু বেশিই। কারণ সাহিত্যের এই শাখাটির কেন্দ্রবিন্দুই সমাজ। লেখক সমাজকে যেভাবে দেখেন, তার সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির মিশ্রণ ঘটিয়ে তা পাঠকের সামনে তুলে ধরেন।
মানব জাতির সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া ও ঘনিষ্ঠ জীবনবোধ উঠে আসে সাহিত্যের কনিষ্ঠ শাখা ছোটগল্পে। কাহিনি রূপে। বাংলা ছোটগল্প যার হাতে গগনস্পর্শী হয়ে উঠেছে, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। তাকে আধুনিক ছোটগল্পের জনক মনে করেন সমালোচকরা। তার অধিকাংশ গল্পের মূল প্রেক্ষাপট সমাজিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ, জীবনযাপন, ধ্যান-ধারণা, মনস্তত্ত্বসহ মানবজীবনের সামগ্রিক রূপায়ণ। লেখকের ‘ঘাটের কথা’ গল্প থেকে ‘মুসলমানীর গল্প’ পর্যন্ত সব গল্পই সমাজ, প্রকৃতি, মানুষ প্রভৃতি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তেমনি ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পেও তিনি সমাজকে চিত্রায়ণ করেছেন নানারূপে। আমাদের আলোচ্য গল্প এই ‘জীবিত ও মৃত’।
ছোটগল্পের কাহিনি মূলত একটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। গল্পের সুবিধা বিবেচনায় ফুটিয়ে তোলা হয় আরও কিছু পার্শ্বচরিত্র। ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পের কাহিনি সৃষ্টি হয়েছে কাদম্বিনী নামের এক বিবধার জীবন-কাহিনিকে অবলম্বন করে। রাণীহাটের জমিদার শারদাশংকর বাবুর ছোট ভাইয়ের বউ কাদম্বিনী। বিধবা কাদম্বিনীর পিতৃকূল ও শ্বশুরকূলে নিজের বলতে কেউই ছিল না। ভাসুর শারদাশংকরের ছোট ছেলেটিই তার চোখের মণি। বিধবার সমস্ত রুদ্ধ প্রীতি, স্নেহের ধন সে। যার কোনো সামাজিক স্বীকৃতি নেই। সমাজের সামনে এই স্নেহ-মমতার কোনো মূল্য নেই। সমাজ যেন তাকে এভাবেই বেঁধে দিয়েছে। বিধবা হলে তার ভালোবাসা, স্নেহ-মমতাকেও বিসর্জন দিতে হয়। তার যে অবদমন, তাকে গলা টিপে হত্যা করতে হয়! রবীন্দ্রনাথ এই চিত্র দেখাতে গিয়ে সমাজের অসঙ্গতির মূলে কুঠারাঘাত করেছেন! সমাজ প্রতিভূ জমিদার শ্রেণি তাদের আভিজাত্য টিকিয়ে রাখতে অন্যের ওপর শাসন-শোষণ চালাতে দ্বিধা করতো না। শারদাশংকর জমিদার। তার মধ্যে যে এই অহমিকা ও দম্ভ প্রতিফলিত হয়েছে, তা স্পষ্ট। ফলে তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় জমিদারি শাসন সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়। কাদম্বিনী একদিকে অবহেলিত নারী তার ওপর বিধবা ফলে পরিবার তথা সমাজ তাকে সঠিকভাবে মর্যদা দেয়নি। আবার কাদম্বিনী বিধবা-নিঃসন্তান হওয়ার পরও নতুনভাবে জীবনকে সাজানোর কোনো লক্ষণ দেখানো হয়নি। তৎকালীন সমাজে নারীর অবস্থান কেমন ছিল ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পে তার চিত্র পাওয়া যায়।
জমিদার ও ভৃত্য বা প্রজার সঙ্গে আন্তরিকতার কোনো যোগাযোগ সমাজে কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যদি থাকতো তাহলে কাদম্বিনীর দাহকার্য সম্পন্ন সম্পর্কে ৪ ব্রাহ্মণ মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতো না। বরং যুক্তির আশ্রয়ে তাকে সাদরে বরণ করতো সমাজ।
মাতৃস্নেহ-মায়া কাটিয়ে হঠাৎ একদিন শ্রাবণের রাতে কাদম্বিনীর জীবনের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশের ঝামেলাকে এড়াতে জমিদারের ৪ জন ব্রাহ্মণ কর্মচারী অনতিবিলম্বে মৃতদেহ দাহ করতে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে অকস্মাৎ ঘটে এক অভাবনীয় ঘটনা! যাকে প্রথমপর্যায়ে ভুতুড়ে কাহিনি মনে হয়! নিতাই, গুরুচরণ, বনমালী, বিধু সবাই একে একে শবদাহ করার কাঠ সংগ্রহের নাম করে মৃতদেহের কাছ থেকে দূরে যায়। হঠাৎ কাদম্বিনীর হৃদক্রিয়া চালু হয় ও ঘরের মধ্যে জনমানবের উপস্থিতি টের না পেয়ে সে বাইরে বের হয়ে যায়। এই কাহিনির বর্ণনা করতে গিয়ে একদিকে রবীন্দ্রনাথ সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন, অন্যদিকে এই বিধবা বধূটিকে অবহেলায় দাহকার্য সম্পন্ন করার ঘটনার মধ্য দিয়ে তার জীবনের প্রতি সমাজের দায়হীন নির্দয় আচরণও দেখিয়েছেন! সমাজের মূলে পচন ধরে কুসংস্কার, অবিচার, শাসন ও শোষণের ফলে। ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ জমিদার প্রথার সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচয় করিয়ে ক্ষান্ত থাকেননি বরং বাড়ির আশ্রিত হলে তার প্রতি কেমন আচরণ হয় সেটাও দেখিয়েছেন। কুসংস্কার যে কত ভয়াবহ তারও দিক প্রতিফলিত হয়েছে এ গল্পে ঘুরেফিরে। ৪ জন ভৃত্য যদি কুসংস্কারে না মজে বাস্তব জ্ঞানের অধিকারী হতো, তবে কাদম্বিনী চরিত্রের পরিণতি হয়তো অন্য রকম হতো। এখানে কুসংস্কারের পাশাপাশি তা পরিত্রাণে শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলা যেতে পারে।
যোগমায়া, কাদম্বিনী কারও মধ্যেই শিক্ষার ফলে মগজের মুক্তি মেলেনি যদিও রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন, তারা উভয় সই একে অন্যকে চিঠি চালাচালি করেছে। গল্পে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘কোথাও কিছু শব্দ নাই, কেবল পুষ্করিণীতীর হইতে অবিশ্রাম ঝিল্লি এবং ভেকের ডাক শুনা যাইতেছে। এমন সময় মনে হইল, যেন খাটটা ঈষৎ নড়িল, যেন মৃতদেহ পাশ ফিরিয়া শুইল। বিধু এবং বনমালী রাম নাম জপিতে জপিতে কাঁপিতে লাগিল। হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা দীর্ঘনিশ্বাস শুনা গেল। বিধু এবং বনমালী এক মুহূর্তে ঘর হইতে লম্ফ দিয়া বাহির হইয়া গ্রামের অভিমুখে দৌড় দিল। (…) শারদাশংকর সহজ লোক নহেন, তাঁহাকে এই ভূতের গল্প বলিলে যে কোন শুভফল পাওয়া যাইবে এমন সম্ভাবনা নাই।’ জমিদার ও ভৃত্য বা প্রজার সঙ্গে আন্তরিকতার কোনো যোগাযোগ সমাজে কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যদি থাকতো তাহলে কাদম্বিনীর দাহকার্য সম্পন্ন সম্পর্কে ৪ ব্রাহ্মণ মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতো না। বরং যুক্তির আশ্রয়ে তাকে সাদরে বরণ করতো সমাজ।
সামাজিক বিধিবিধানের কাছে বারবার প্রতারিত কাদম্বিনী। কুলত্যাগিনীরূপে তাকে মনে মনে ধিক্কার দিয়েছে যোগমায়া। সইয়ের প্রতি শেষ পর্যন্ত সমাজ রক্ষার দায় চাপিয়ে তাকে বাড়ি ছাড়া করেছে। কাদম্বিনীর শত আকুতিও যোগমায়ার অবস্থান টলাতে পারেনি। কাদম্বিনী বলে, ‘আমি মরিয়াছি ছাড়া তোমাদের কাছে আর কী অপরাধ করিয়াছি। আমার যদি ইহলোকেও স্থান নাই, পরলোকেও স্থান নাই, ওগো, আমি তবে কোথায় যাইব।’ এমন বেদনাদীর্ণ আকুতি চিরন্তন সমাজব্যবস্থার ওপর কদাম্বিনীর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। জীবন-মৃত্যুর মাঝে জীবনের অমোঘ দর্শন প্রকাশিত হয়েছে। কাদম্বিনীর আত্মধিক্কার সমাজের নিয়ম-নীতির বিরুদ্ধে। বেঁচে থেকেও সমাজে মৃত হিসেবে গৃহীত এবং সমাজ তার অবস্থান তাকে ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
সমাজের ভেতর গড়ে ওঠা কুসংস্কার, রীতিনীতি, শাসন-শোষণ সবই নারীজাতিকে অবদমিত করার জন্য। যার মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জয়ডঙ্কা বেজে ওঠে সর্বদা। গল্পটি পাঠের ফলে সামাজিক কুসংস্কারকে তুচ্ছ জ্ঞান করে যুক্তি বুদ্ধি দ্বারা জীবন পরিচালনার প্রতি দৃষ্টিপাত করা হয়েছে।
তৎকালীন হিন্দু সমাজে কুসংস্কার যেন মজ্জাগত। রবীন্দ্রনাথ সমাজের সেই কুসংস্কারকে হয়তো সচেতনভাবেই এড়িয়ে যেতে চাননি। অথবা আধ্যাত্মিক পুরুষ হওয়ার কারণে মৃত ব্যক্তির আত্মার অতৃপ্তিকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। এটাও হতে পারে তৎকালীন সমাজকে পরিপূর্ণরূপে রূপায়িত করা তার উদ্দেশ্য ছিল। তাই কাদম্বিনীর মৃত্যু রহস্যকে ঘিরে সামাজিক নীতি, আচার-আচরণ তুলে ধরেছেন। শারদাশংকরের একটি উক্তির মধ্যে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার ও এর প্রতি বিশ্বাসকে রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘ছোট বউমা, এই কি তোমার উচিত হয়। সতীশ আমার বংশের একমাত্র ছেলে, উহার ব্যামো আর ছাড়ে না, দিনরাত কেবল, ‘কাকিমা’ ‘কাকিমা’ করে। যখন সংসার হইতে বিদায় লইয়াছ তখন এ মায়াবন্ধন ছিড়িয়া যাও, আমরা তোমার যথোচিত সৎকার করিব।’
কাদম্বিনী সমাজ-সংসার থেকে বিতাড়িত হয়ে শেষপর্যন্ত মৃত্যুর কোলেই মুক্তি খুঁজে নিয়েছে। প্রকৃতি ও মৃত্যু যেখানে তাকে আলিঙ্গন করে চিরন্তন মুক্তি দিয়েছে। যে সংসার-সন্তানকে ভালোবেসে আগলে রেখে সে তার আত্মিক শান্তির চেষ্টা করেছিল সেই সন্তানও পৃথিবীর রূঢ়তাকে ভুলে কাকিমার মৃত্যুকে অস্বীকার করতে পারিনি। বরং খোকা ভয়ে বাবাকে আলিঙ্গন করেছে। আর অবধারিতভাবেই যেন কাদম্বিনী সমাজের উপেক্ষার শিকার হয়েছে। শেষপর্যন্ত ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।’ কাদম্বিনীর এ মৃত্যু সমাজের প্রথা, বিশ্বাস ও রীতিনীতির মৃত্যু। নীরব প্রতিবাদ অনেক সময় সরব হয়ে ওঠে। সমাজ যার বেঁচে থাকাকে কুসংস্কার, প্রথা ও নীতির আলোকে বিবেচনা করলো সেই সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে কাদম্বিনী। যার ফলে সে নিয়তির কোলে সপে দিয়েছে নিজেকে।
‘জীবিত ও মৃত’ গল্প মূলত সমাজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। সমাজের ভেতর গড়ে ওঠা কুসংস্কার, রীতিনীতি, শাসন-শোষণ সবই নারীজাতিকে অবদমিত করার জন্য। যার মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জয়ডঙ্কা বেজে ওঠে সর্বদা। গল্পটি পাঠের ফলে সামাজিক কুসংস্কারকে তুচ্ছ জ্ঞান করে যুক্তি বুদ্ধি দ্বারা জীবন পরিচালনার প্রতি দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। এছাড়া একজন অবহেলিত নারীর প্রতি সহনশীল হওয়ার দীক্ষাও গৃহীত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানব সমাজের মুক্তিকে নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। মানুষ তার হৃদয়কে প্রাধান্য দেবে। সামাজিক প্রথা-কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে নতুনভাবে সমাজকে বিনির্মাণের পথের ইঙ্গিত দিয়েছেন লেখক।
অনন্যা/এআই