আনোয়ারা: গৃহবন্দি নারীর জীবন
মোহাম্মদ নজিবর রহমান (১৮৬০-১৯২৩) বাংলা সাহিত্যাকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কালের পরিক্রমায় যে কয়জন মুসলমান সাহিত্যিক তাদের প্রাচুর্যপূর্ণ অবদান সাহিত্যক্ষেত্রে রেখে গেছেন, তিনি তাদের মধ্যে অনন্য। আনোয়ারা (১৯১৪) তার একটি বিখ্যাত উপন্যাস। এই উপন্যাসের মাধ্যমেই তিনি প্রাণজয় করে নিয়েছেন লক্ষ পাঠকের। অনবদ্য এই উপন্যাসে তিনি সমাজের কথা বলেছেন। তুলে ধরেছেন নারীর ঘুণে ধরা জীবনকে।
গ্রামীণ জীবনের পটভূমিকায় রচিত এ উপন্যাসে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের পারিবারিক, সামজিক নানা চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। তবে পরিবার ও সমাজের সামগ্রিক জীবনকে ছাপিয়ে নারীর জীবনকে অনকেটা অন্তঃপুরে বেঁধে দিয়েছেন। ‘সতীর সর্বস্ব পতি’; এছাড়া নারীর জীবন ভাঙা তরীর মতোই অর্থহীন করে তুলেছেন।
‘আনোয়ারা’ উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে আনোয়ারা নাম্নী এক তরুণীকে ঘিরে। তার জীবনকে যেন লেখক বাঙালি নারীর আদর্শ জীবনরূপে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। যে কিনা সৎ মা গোলাপজানের শত গঞ্জনা সয়েও মুখে টু শব্দটি করে না। মায়ের বাধ্য সন্তান যেমন হয় আনোয়ারাও ঠিক তাই। আনোয়ারার একমাত্র সঙ্গী তার সই হামিদা। অন্যদিকে সৎ মায়ের গঞ্জনাতে শীতল ছায়া দিয়ে চলেছে আনোয়ারার দাদীমা। এই দুটি মানুষের কাছে জীবনের পরম আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে আনোয়ারা। কিন্তু আনোয়ারার জীবন দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও আদর্শপূর্ণ করে রেখেছেন লেখক। নামাজের জন্য ওযু করতে গিয়ে চোখ পড়ে নুরল এসলামের ওপর। যে সৎ, পবিত্র, নিষ্ঠাবান একজন কর্মী। নৌকাতে অবস্থানকালে তার মধুর কণ্ঠের কোরআন পাঠ আনোয়ারাকে মুগ্ধ করে। মনের অজান্তেই ভিনদেশি এই যুবকের মতো কেউ তার স্বামীর আসন দখল করুক এই তার বাসনা।
অনেক পথ পাড়ি দিয়ে বিয়ে হয় আনোয়ারা এবং নুরল এসলামের। কিন্তু এখানেও আনোয়ারার জীবনে আসে কালবৈশাখী ঝড়। এক তিমির থেকে বেঁচে সে এসে উপস্থিত হয় আরও এক গভীর অন্ধকারে। যেখানে তার পক্ষে কেউ নেই।
নুরল এসলামের পরিবারে রয়েছে সৎ মা, সৎ বোন সালেহা, এবং তার স্বামী খাদেম। নুরল এসলামের বিয়ের পর আনোয়ারার সঙ্গে সখ্যতার বদলে বৈরী আচরণ শুরু করে সালেহার মা। ফলে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে আনোয়ারার জীবন। কাজের সূত্রে নুরল এসলামের বাইরে থাকলেও বাড়িতে স্ত্রীর প্রতি অন্যায় সে মেনে নেয়নি। একসময় সংসারে ফাঁটল ধরে। কিন্তু আনোয়ারার ওপর সৎ শাশুড়ির অত্যাচার স্তিমিত হয় না। এসময় নুরল এসলামও ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হয়। আবারও শুরু হয় নতুনভাবে আনোয়ারার পরীক্ষা। সতীকে আজীবনই দিতে হয়েছে অগ্নি পরীক্ষা। দুর্গা নামের এক বোষ্টমীর সঙ্গে ফাঁদ পাতে আব্বাস, খাদেমরা। সেসময় দুশ্চরিত্র, কলঙ্কিত করে তোলার ষড়যন্ত্রে পা দেয় আনোয়ারা।
আনোয়ারার পতিপরায়ণ স্বভাবই সংসারের সুখ- শান্তি বয়ে আনে সে লক্ষেই এগিয়েছেন লেখক। নারীর গুনেই শুধু অন্তঃপুরের শোভা বৃদ্ধি পায়।
কোর্টে মামলা উঠলেও আনোয়ারা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। বিরোধী পক্ষের আইনজীবী বলেন, মানুষকে কারাগারে রাখা যায় কিন্তু যৌবনকে বাধা যায় না। তাই যখন নুরল এসলাম অসুস্থ তখন আব্বাসের মতো যুবকের কাছে আনোয়ারা সুখী হতে চেয়েছে। তার অপবাদের জের নুরল এসলামকেও দ্বিধায় তোলপাড় করে তোলে। একপর্যায়ে সব ঝড় থেমে আনোয়ারা, নুরল এসলামের সুখী জীবনের তরী ভিড়িয়ে দেন লেখক। তবে উপন্যাসের কাহিনি অনুযায়ী আনোয়ারা চরিত্রের নির্বিকার থাকা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? শিক্ষিত, রুচিশীল আনোয়ারা নিপীড়ন সহ্য করেছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেনি কোথাও। সব নীরবে সয়ে গেছে।
ঔপন্যাসিক মূলত বাঙালি মুসলিম নারীর জীবনকে রূপায়িত করেছেন। খুবই বাস্তবসম্মত হয়ে উঠেছে চরিত্রগুলো। একদিকে গোলাপজান, অন্যদিকে সালেহার মা (আনোয়ারার শাশুড়ি)। দুই নারী চরিত্রের মাঝে পড়ে অন্য এক নারী নিগৃহীত হয়েছে। পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করেছে এই দুই নারী। তাই নিজেরা নারী হয়ে অপর নারীর প্রতি সামান্যতম ভালোবাসা বা করুণা মনে জন্ম নেয়নি। বরং প্রতিনিয়ত কিভাবে আনোয়ারাকে মানসিক অত্যাচার করা যায় সে ব্যাপারে তৎপর থেকেছে।
উপন্যাসে শেষপর্যন্ত গোলাপজান তার লোভ, আক্রোশের জালে বন্দি হয়েছে। অতি লোভে তার ঘড়া পূর্ণ হয়। যদিও গোলাপজান আগের পক্ষের ছেলে বদসার খুনের দায় দিয়েছে স্বামীর ওপর। গোলাপজান চরিত্রের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজে বহুবিবাহের কুফল। অন্যদিকে সংসারে সৎ মায়ের উপস্থিতি সন্তানের জীবনে অভিশাপ হয়ে দেখা দেয় তার চিরন্তন রূপ। জাফর বিশ্বাসের মেয়ে গোলাপজান। বাবা ছিল ডাকতের সর্দার। শেষ জীবনে পুলিশের চেষ্টায় ধরা পড়ে ৮ বছর জেল খাটে। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। বাপের মতো ডাকসাইটে স্বভাব গোলাপজানেরও। যদিও ভাই আজিমুল্লা বাপের পথে পা বাড়ায়নি। কিন্তু গোলাপজান দেখতে সুন্দরী। বিয়ে হওয়ার পর স্বামীর ঘর থেকে পালিয়ে আসে। কিন্তু অজিমুল্লা এবং মায়ের শাসনে খোরশেদের সংসারে টিকে যায়। কিন্তু আনোয়ারার বাপ খোরশেদ স্ত্রীর কাছে সর্বদাই অবহেলিত। মেয়ের প্রতি অত্যাচারেও সে নির্বিকার। নুরল এসলামের হত্যার ষড়যন্ত্র করলেও গোলাপজানের পাপেই সে নিজ সন্তানকে হত্যা করে বসে।
অন্যদিকে আনোয়ারার সৎ শাশুড়ির অত্যাচার অভিশাপ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে কিন্তু আনোয়ারা এখানেও নির্বিকার। দুই মায়ের অত্যাচার নীরবে সয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে ঔপন্যাসিক নারী জীবনে দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার দিকেই ঝুঁকেছেন। তবে উপন্যাসে তিনি সর্বোপরি দেখাতে চেয়েছেন স্বামী-স্ত্রী পরস্পর বোঝাপড়া, ঘরের সুখ বজায় থাকে নারীর ওপর, নারীর কোমল স্বভাবই সর্বত্র জয়ী, সতীত্বের গৌরব, ধর্ম জীবনের মাহাত্ম্য। আনোয়ারার দুঃখী জীবনের মাঝে স্বস্তি যেন এটুকুই নুরল এসলামের মতো পতি তার ভাগ্যে জুটেছে। নারীর অন্তঃপুরে অবস্থান এবং স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা, বিশ্বাস, আস্থা ও আনুগত্য উপন্যাসটিতে বিশেষভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
আনোয়ারার পতিপরায়ণ স্বভাবই সংসারের সুখ- শান্তি বয়ে আনে সে লক্ষেই এগিয়েছেন লেখক। নারীর গুনেই শুধু অন্তঃপুরের শোভা বৃদ্ধি পায়। আর সে নারী যদি হয় গোলাপজান বা সালেহার মায়ের মতো তবে সংসার চির অশান্তিতে ডুবে যায়। লেখক সর্বোপরি নারীর জীবনের সঠিক দিশা দেখাতে চেয়েছেন আনোয়ারার জীবন রূপায়নের মধ্যে দিয়ে।