Skip to content

৭ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | মঙ্গলবার | ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘রোজ কেন নারী দিবস হয় না?’ 

৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস।  প্রতি বছর বহু আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয় দিনটি। কথা বলা হয় নারীর অধিকার নিয়ে, সম্মান প্রদান করা হয় সফল-লড়াকু নারীদের। এ-ছাড়া, অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন ধরনের আয়োজন তো থাকেই।  তবে অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো, এ-সব শুধু এই দিনটিকে ঘিরেই। 

রোজিনা বেগমের (ছদ্মনাম) গল্প বলি চলুন: রোজকার মতো নারী দিবসের দিনও সকাল সকাল ঘুম ভাঙে তাঁর।  তবে স্বামী আর ছেলে-মেয়েরা মিলে ঠিক করেছেন, আজ কোনো কাজে তাঁকে হাত দিতে দেবে না। রান্নাও করছে ঘরের পুরুষ সদস্যরা। মোবাইল ফোনে ধারণ করা হচ্ছে ছবি ও ভিডিও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা শেয়ার করে পাচ্ছেন বেশ প্রশংসাও। রাতে আবার এক সঙ্গে কেকও কাটলেন তারা। 

কিন্তু পরদিন সকালে সব আবার চলতে লাগল আগের নিয়মে। রোজিনাকে সাহায্য করা তো দূরের কথা গ্ল্যাসে জল গড়াতেও তাঁর সাহায্যের প্রয়োজন হয় তাদের। খাবারে লবণ-মরিচের পরিমাণ ঠিকঠাক না হলে রোজিনা বেগমকে কথা শোনাতে ভোলে না পরিবারের সবাই। এ-সব দেখে রোজিনা বেগম বেশ হতাশা নিয়ে মনে মনে বলেন, 'রোজ কেন নারী দিবস হয় না?' 

আজকাল আমাদের হাতের মুঠোয় পুরো বিশ্ব চলে এসেছে। আমরা আধুনিক থেকে আধুনিকতর হয়েছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের বিচরণ বেড়েছে। সবাইকে বিভিন্ন দিবস নিয়ে বেশ সোচ্চার থাকতে দেখা যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু সব কার্যক্রম ওই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। আমরা শুধু দিবসকে ঘিরে নানা আদিক্ষেতা করতে শিখেছি, যথাযথ মর্যাদা দিতে শিখিনি। 

নারী দিবস নিয়ে দীর্ঘ আকৃতির পোস্ট দেওয়া লোকটিও সুযোগ পেলে কোনো নারীকে হয়রানি করতে পিছপা হয় না। ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করা লোকটিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, 'নারীকে সম্মান দিতে শিখুন!' 

পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে মনে হচ্ছে, নারীর শুধু ওই একটি দিনই সম্মান প্রাপ্য। বাকি দিনগুলোতে নারী প্রসঙ্গ, সমতার প্রশ্ন এলেই পুরো পরিস্থিতি ব্যাখ্যায় সমাজ যেন অন্ধ হয়ে যাবে, নানা বাস্তবতা তুলে ধরার ইচ্ছে হবে। নারী দিবসে যে দেশে নারীদের এত এত সম্মান দেওয়া হয়, সে দেশেই বছরে ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার হন হাজার হাজার নারী। 

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপপরিষদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গেল বছর  জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১ হাজার ২৩৫ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর, মোট ৩ হাজার ৭০৩ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্র্যাকের প্রকাশিত 'নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক' শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক জরিপে দেখা যায়, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে গণপরিবহনে ৬৮টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৩টি ধর্ষণ, ১১টি দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ৩৪টি যৌন হয়রানির ঘটনা।

আমাদের দেশে পর্যটন কেন্দ্রে নারীদের ধর্ষণের সংখ্যাটা বেড়ে গেলে প্রশাসন নারীদের জন্য ১৫০ গজ জায়গা সীমাবদ্ধ করে দেয়, আর অপরাধী ঘুরে বেড়ায় দেশ জুড়ে। দেশের স্বনামধন্য এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনায়াসেই ছাত্রীদের নিয়ে মন্তব্য করে বলেন, 'এই মেয়েদের কেউ বউ হিসেবে নিতে চায় না। কারণ, সারা রাত এরা ঘোরাফেরা করে।' এই দেশেই আবার মন্ত্রণালয়ে নারী  সাংবাদিককে হেনস্তার মতো নিন্দনীয় ঘটনাও ঘটে! 

 

সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মহামারির মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রায় ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এ সময় দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মোট ঘটনা ঘটে ২১ হাজার ৭৮৯টি, যা এর আগের অর্থবছরে ছিল ১৮ হাজার ৫০২টি। সে হিসাবে এক বছরে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

এক দিকে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্য দিকে নারী দিবস নিয়ে  অনুষ্ঠান আয়োজনেও কমতি নেই। ফলে দিন শেষে প্রশ্ন থেকেই যায়, ধর্ষণ-নির্যাতন বেড়েই চলেছে, তো ঘটা করে নারী দিবস পালন করে কী লাভ!
 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ