শামীম শিকদার: স্বাধীনচেতা নারীর প্রতিকৃতি
এক অদম্য সাহসী নারীর নাম শামীম শিকদার। যিনি সবসময় স্রোতের বিপরীতে জীবনতরী ভাসিয়েছেন। সমাজের পচা-গলা সংস্কারে নিজেকে আবদ্ধ না করে নিজ পথ রচনা করেছেন। মানুষের মনোবল,আত্মচেষ্টা থাকলে পাহাড় ডিঙিয়ে মসৃণ পথ গড়ে তোলা যায় তার প্রমাণ এই মহীয়সী নারী। এ সমাজ তাঁকে জায়গা ছেড়ে দেয়নি বা তাঁর জন্য বিশেষ কোনো সুবিধা দিতেও প্রস্তুত ছিল না তবু শামীম শিকদারের অবদান-জীবনযাপন পদ্ধতি প্রত্যেক নারীর কাছে শিক্ষার অন্যতম অধ্যায়।
মানুষ শিক্ষা, জ্ঞান লাভ করে পড়া-দেখা-জানার মাধ্যমে। শামীম শিকদারের পুরো জীবনটাই নারীদের জন্য শিক্ষার। আজকের নারীদের অনেকেই চলতে গেলে ঠুনকো আঘাতেই নেতিয়ে পড়তে চায়! কিন্তু লড়াইয়ের নামই যে জীবন তা শিখতে আমাদের যেতে হয় এই নারীর কাছে৷ যিনি শৈশব থেকেই ছিলেন সাহসী, দৃঢ়চেতা, সংগ্রামী এবং একইসঙ্গে মেধাবী মানুষ। যে সময়টাতে সমাজ ছিল পরিপূর্ণরূপে অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই অন্ধকার ঘরে তিনি একা আলো জ্বালতে সচেষ্ট হয়েছেন। যে আলো নানা ঝড়-ঝাপটায় নিভু নিভু করলেও শেষপর্যন্ত তার জ্যোতি কখনোই কমে যায়নি৷ যার দরুণ নারী জাতি পেয়েছেন এক নতুনতম স্বাধীন জীবনের সংজ্ঞা, জীবনের অর্থ! শামীম শিকদার তাই দেশের নারীদের কাছে একটি প্রাপ্তি-অহংকার-চেতনার নাম।
মজার বিষয় হলো তিনি যে, সমাজের বৈষম্যকে কখনোই আমলে নেননি তার প্রমাণ জীবনভর দিয়ে গেছেন। প্রথা নামক অপ্রথার বুকে পদাঘাত করেছেন। বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন নামে, কর্মে, জীবনাচরণে। সাইকেল চালাতে তিনি পছন্দ করতেন কিন্তু যখন এই সাইকেলে পরিভ্রমণকালে কিছু বখাটের দ্বারা তার ওড়না অপহৃত হয় তখন তিনি তাদের মুখে চুনকালি মাখাতে প্রতিবাদের প্রথম ভাষা দাঁড় করান। যারা তাঁকে অপদস্ত করে বিকৃত লালসাকে পরিতৃপ্ত করতে চেয়েছিল তিনি তাঁদেরই রূপে আবির্ভূত হলেন। জীবনভর তিনি একইভাবে চলেছেন কর্মের ক্ষেত্রে। জীবনে আপোষের কোনো ছাঁয়া নেই। অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি সবসময় অগ্রগামী।
শামীম শিকদার ১৯৫২ সালের ২২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশি ভাস্কর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত-স্বীকৃত। ২০০০ সালে তিনি একুশে পদক পেয়েছেন। তবে এই নারীর পিছনের গল্প লড়াইয়ের একইসঙ্গে অনুপ্রেরণার। প্রখ্যাত কমিউনিস্ট সিরাজ শিকদার তাঁর আপন বড় ভাই। শামীম শিকদার বুলবুল ললিতকলা একাডেমী থেকে ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ভাস্কর্যের ওপর ৩ বছরের একটি কোর্স সম্পন্ন করেন।
এরপর তিনি ইট-পাথর-কাঠের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু ভেবে দেখা প্রয়োজন আজকের যুগে এসেও নারীরা কী করবেন, কতটা করবেন, কেমনভাবে পথ চলবেন সবটাই সমাজের প্রচলিত স্রোতের মতো করে ভাবেন। গুটিকতক ব্যতীত অধিকাংশ নারী আজও সমাজকে গলধঃকরণ করেই বেঁচে আছেন। সমগ্র নারী জাতির সামনে শামীম শিকদারই পাঞ্জেরির সেই নাবিক। তাঁর ডাক প্রতিটি নারীর প্রতি। অবহেলা- অন্যায়-নিপীড়নের দেওয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসার সঞ্জীবনী শক্তি তিনি।
ষাটের দশকে যখন বাঙালি জাতির মধ্যে শিক্ষার আলো ততটা প্রকটিত নয় তখন তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন ভাস্কর্য’র মতো বিষয়ে। যেখানে পৌঁছাতে বা ভাবনায় আনতে বর্তমান যুগে এসেও নারীদের শতবার ভাবতে হয়! আসলে তিনি নিজেই একটি অভিধানের মতো। প্রতিটি পাতায় নতুন নতুন উৎস। নাহলে নিজের নামেও এমন গোলকধাঁধা! কয়জন বাঙালি জানতেন যে, সত্যি তিনি একজন নারী! নারীত্বের সব আবরণকে ছুঁড়ে ফেলে তিনি নারীকে অপমান করেননি বরং এ সমাজের পুরুষতন্ত্রের বুকে পদাঘাত করেছেন৷ যারা নারী শক্তিকে হেয় করে বিকৃত শান্তি পেতে চায় তাদের বোঝাতে চেয়েছেন নারী সবক্ষেত্রে একই। শুধু দৈহিক গড়নে তাকে আঁটকে রাখা যায় না। নারীর শক্তি অজেয়কেও জয় করার। চাইলেই নারী পারে তাঁকে আকাশছোঁয়াতে।
গত ২১ মার্চ ২০২৩ এই অপ্রতিরোধ্য নারী মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁকে পরিমাপ করার মতো দুঃসাহস নেই। তবে তিনি যে, মৃত্যুর পরও রেখে গেলেন জীবনের সেই অপ্রতিরোধ্য শক্তি তা হয়তো যুগে যুগে লড়াকু মানুষদের পথ দেখাবে। যেখানেই থাকুন মৃত্যুর পরও জীবনের মতোই চির সজীব থাকুন হে মহীয়সী-প্রাণময়ী নারী।