আজও যৌতুকের বলি গৃহবধূ!
আমাদের সমাজে নারীরা এতটা অবাঞ্ছিত হয়ে ওঠার কারণ কী! প্রতিনিয়তই নারীকে অবহেলা, অবজ্ঞা, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকারে পরিণত করা হচ্ছে৷ এর সর্বোচ্চ পরিণতি হত্যা। নারীকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে যৌতুকের জন্য। এ সমাজে নারীর স্থান কি শুধুই স্বার্থসিদ্ধির সঙ্গে জড়িত? শিক্ষিত, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত; সব শ্রেণির বেশিরভাগ পুরুষই যৌতুকলোভী। বলা চলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় এই ব্যাধি এখনো ভয়াবহ।
আকারে ইঙ্গিতে শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তির ওপর লোভ, টাকার জন্য স্ত্রীকে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করা; সবই যেন স্বাভাবিক আজও। একসময় যৌতুকের প্রচণ্ড প্রতাপ সগৌরবে সমাজে বহাল থাকলেও আজকের যুগে মনে করা হয় তা বিদায় নিয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পরপরই যৌতুকের জন্য নারীর ওপর অত্যাচারের ঘটনা সামনে আসছে। তাহলে বলাই চলে সমাজ থেকে আজও যৌতুকের ব্যাধি শেষ হয়ে যায়নি। বরং এটা সমাজের একটি অংশে পরিণত হয়ে গেছে। অর্থাৎ পাত্রপক্ষের স্বাভাবিক মনোবাসনায় থাকে বিয়ে হলে শ্বশুর বাড়ির থেকে তার পরিবারের জন্য উপঢৌকন স্বরূপ অর্থ, প্রতিপত্তি, গাড়ি, বাড়ি প্রভৃতি প্রাপ্তি ঘটতে পারে। আগে দেখা গেছে, বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হতোই যৌতুকের কথা পাকাপোক্ত করে। মেয়েকে কতটুকু গয়না দেবে, খাট-পালঙ্ক বা ঘর সাজানোর জিনিস কতটা দেবে, এসব দরকষাকষি চলতো।
কিন্তু যুগের পরিবর্তনে আধুনিক মানুষের তকমাধারীদের দরকষাকষি কমে এসেছে কারণ পাত্র পক্ষ ধরেই নেন যে, বিয়ে হলে তার জন্য বিশেষ উপঢৌকন থাকবেই। ঘড়ি, চেইন, আংটি, ব্রান্ডের মোইবল, মোটরসাইকেল বা ঘর সাজানোর নানা সামগ্রী৷ ফলে পাত্রপক্ষ কষ্ট করে চাওয়া থেকে অনেকটাই বিরত থাকেন। কিন্তু এই চাহিদার সঙ্গে যারা তাল মেলাতে না পারেন, সেই নারীর কপালে বিশেষ দুর্ভোগ দেখা দেয়। পোহাতে হয় শ্বশুর বাড়ির লাঞ্ছনা-গঞ্জনা। এখন কথা হলো এই মানসিকতা এখনো সমাজের অধিকাংশের মধ্যে বিরাজমান আছে? তাহলে বলতে হ্যাঁ। আজও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিটি শিরা-উপশিরায় তীব্র গতিতে প্রবহমান শুধু তার নামটা ভিন্ন হয়েছে। অনেকটা বলে ওপেন সিক্রেট হিসেবেই যৌতুকের ব্যবহার হচ্ছে।
কন্যাপক্ষ মেয়ের মঙ্গলার্থে কেউবা খুশি হয়ে আর অধিকাংশই চাপে পড়ে বা বাধ্য হয়ে মেয়েকে কিছু না হলেও যতটুকু সাধ্য তার বেশিই দিচ্ছেন। এই যৌতুকলোভী পাত্রপক্ষের মধ্যে আবার গড় করলে দেখা যাবে শিক্ষিতের হারই বেশি। সেক্ষেত্রে কন্যা পক্ষের ভাগ্য জোটে আরও বিড়ম্বনা। কারণ ‘একে তো না নাচুনি বুড়ি তার ওপরে ঢোলের বাড়ি’র মতো! এমনিতেই পাত্রপক্ষের জিহ্বা লকলকিয়ে থাকে, তার ওপর যদি ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে গাঁটের টাকার কিয়দাংশ খরচ হয়, তবে তো কথাই নেই।
এই যৌতুক লোভীদের খপ্পরে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন এক অসহায় নারী। ৩ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জে যৌতুকের দাবি পূরণ না করায় তানহা মাহমুদা নামের এক গৃহবধূকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে।এ ঘটনায় স্বামী ফেরদৌস হাসান সোহানকে আটক করেছে পুলিশ। এই দম্পতির এক বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। তানহা মাহমুদারা এ সমাজে সত্যিকার অর্থেই অসহায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার রোষানলে টিকে থাকতে চাইলেও পারেনি। পরিবারের দাবি, দীর্ঘদিন যাবৎ যৌতুকের জন্য চাপ দিয়ে আসছিল তানহার স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজন। কিন্তু তাদের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় তার অকাল মৃত্যু হলো। ফেরদৌস হাসানেরা এ সমাজের মাঝে এমনভাবে তাদের স্থান দখল করে আছে যে, এ সমাজও তাদের পক্ষে সাফাই গাইতে প্রস্তুত। পুরুষ হয়ে জন্মেছে, তাই বাহাদুরির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে।
যৌতুকের জন্য নিজের স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। কতটা হিংস্র মনোভাব থাকলে এ ধরনের কাজ করা সম্ভব! কাছের জনের প্রতি যদি এতটা আক্রোশ থাকতে পারে, তাহলে এ ধরনের পুরুষের দ্বারা অন্য নারীকে ধর্ষণ, যৌন-হয়রানি করা হয়তো কোনো ব্যাপারই হয়ে উঠবে না। তাই অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ নিশ্চিত করে কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তি দেওয়া হোক। যেন নারীদের প্রতি এমন আচরণ করার আগে এই বিকৃত মানসিক রোগীদের বুকটা খানিক হলেও কেঁপে ওঠে। বর্তমান সময়ে নারীদের প্রতি এত হিংস্রতা বেড়েছে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হতে হয়! জাতির মঙ্গল কামনায় এই ধরনের অমানবিক, হিংস্র, বর্বরতার বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ হোক। আর যেন কোনো নারীকে অকালে প্রাণ হারাতে না হয়।