Skip to content

৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | রবিবার | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হঠাৎ দেখা

প্রথম মাসের বেতনটা হাতে পেয়েই আবিরের চোখটা ভিজে গেলো। অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করছে তার মনে। একসাথে অনেকগুলো টাকা। তাও আবার নিজের পরিশ্রমের টাকা, ঘামের টাকা। জিহ্বায় আঙুল ভিজিয়ে টাকাগুলো বারবার গুনছে সে। প্রতিবার গুনে টাকার যোগফলটা সমানই হচ্ছে। তবুও টাকাগুলো গুনতে বেশ ভালো লাগছে তার। আকাশের দিকে তাকিয়ে আবির একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আজ তার বাবা বেঁচে থাকলে অনেক খুশি হতেন। অফিস থেকে একটু আগেই বের হয়ে গেছে সে। মাকে দেখতে বাড়ি যাবে। টাকাগুলো প্যান্টের বাম পকেটে রেখে বা'হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখেছে। যেনো কোনো ছিনতাইকারীও ছিনিয়ে নিতে না পারে।

 

আবির বাস থেকে পাঁচদোনা নেমে মায়ের জন্য কিছু ফল কিনলো। সাথে মোহন বাবুর সেই বিখ্যাত মিষ্টি।আবিরের মনটা আজ খুব ফুরফুরা। আবির চোখ বন্ধ করে মায়ের মুখটা কল্পনা করতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। কখনো সে তার দুঃখিনী মায়ের মুখে হাসি দেখতে পায়নি। সবসময় দুশ্চিন্তার একটা প্রচ্ছন্ন আভা মায়ের মুখে দেখে সে বড় হয়েছে। এবার মায়ের দুঃখ কিছুটা ঘুচবে। সামনের ঈদ বোনাসের টাকা দিয়ে আবির মায়ের জন্য একজোড়া কানের দুল গড়ে দিবে। বড় ভাই-ভাবী, ছোট ভাইবোনদের জন্য টুকটাক কেনাকাটা করবে। এসবই আবিরের ভবিষ্যত পরিকল্পনা।

 

আবির সিএনজিতে বসে আছে। সিএনজির পেছনে বাম পাশে বসে হাওয়া খেতে খেতে সে ঘোড়াশাল যাবে। পাঁচজন যাত্রী না হলে সিএনজি ছাড়বে না।আরো একজন লাগবে। মিনিট পাঁচেক পর একজন বোরকা পরিহিত মহিলা এসেই পেছন থেকে একজনকে সামনের সিটে বসার জন্য ধমকের স্বরে আদেশ করলো। ছাত্র গোছের এক বেচারা উঠে গিয়ে সামনের সিটে বসলো। মহিলা আয়েশ করে ডানপাশের সিটে বসলো। দেখে মনে হচ্ছে বেশ পর্দানশীল মহিলা। আগাগোড়া তিনি কালো বোরকায় ঢাকা। চোখের সামনেও জালের মতো কাপড় ঝুলে আছে। আড়চোখে দু'তিনবার তাকালো আবির।সিএনজি চলছে দ্রুতগতিতে। ঝংকার সিনেমা হলের সামনে আসতেই ঐ মহিলা ড্রাইভারকে বললো, 'এই ড্রাইভার ভাই, একটু থামেন।' সিএনজি থামার সাথে সাথে মহিলা খুব দ্রুত নেমে বা'পাশে এসে আবিরকে বলছে, 'এই বেটা তুই আরো চাপ। আমি বাম পাশে বসমু।' বলার ঢঙ দেখে রীতিমতো ভয়ে আরো চেপে বসলো আবির। এবার সে দু'জনের মাইনকা চিপায় গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। বাম হাত দিয়ে বা পকেটে রাখা টাকাগুলো বেশ শক্ত করে ধরে রেখেছে আবির। মহিলার আচরণ ও বেশভূষা দেখে তার সন্দেহ হচ্ছে। মহিলা কি ছিনতাই চক্রের কেউ? আবিরের এবার ডানপাশে বসা পুরুষটার চোখমুখ দেখে বুঝার চেষ্টা করছে সেও কি মহিলার সাথের সদস্য কিনা? লোকটার মিটিমিটি হাসি দেখে আবির টাকাগুলো আরো শক্ত করে চেপে ধরে দোয়া ইউনুস পড়ছে। আল্লাহ আল্লাহ জিকির করছে।

 

আবিরের দিকে বারবার মহিলা তাকাচ্ছে। সিএনজির এতো আওয়াজের ভেতরও আবির মহিলার হাসির ছলাৎ শব্দ শুনতে পায়। আবিরের কাছে মহিলার হাসিটা অত্যন্ত বিদঘুটে লাগছে। মনে হচ্ছে আলিফ লায়লার খারাপ আত্মা সুফান ইজবার মতো ডাইনি মার্কা হাসি! এক পর্যায়ে মহিলা আবিরের বাম উরুতে ঠাস করে থাপ্পড় দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'তুই কেমন আছিস?' আবির আঁতকে উঠলো। হতবিহ্বলতায় সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'আপনি আমাকে কিছু বলছেন?' মহিলা আবারে পিঠে ঠাসঠুস করে ঘুষি  দিয়ে বললো, 'হ্যাঁ, তোকেই বলছি। জানিস- তোর জন্য বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছি? অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছি রে, পাগলা। হা হা হা। বুঝলি কিছু? আজ তোকে ভাগে পেয়েছি। আর যাবি কই?' এইবার আবির নিশ্চিত হলো- সে নিশ্চিত মহাবিপদে পড়েছে।বড় একটা চক্রের কবলে পড়েছে। আজকাল পত্রিকা খুললেই এরকম অহরহ ঘটনা দেখা যায়। আবিরের বুকটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে থরথর করে কাঁপছে। সে জানে এমন সিচুয়েশনে জোরাজুরি করে লাভ হয় না। বরং বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। তারচেয়ে ভালো সুন্দর করে কেঁদেটেদে বুঝিয়ে বললে হয়তো কাজ হতেও পারে। তাই আবীর এবার মহিলার দিকে হাতজোড় করে বললো, 'আপু গো, এটা আমার প্রথম মাসের বেতন। আমার অনেকদিনের ইচ্ছা এই টাকাগুলো মায়ের হাতে তুলে দিবো। জানেন- আমার মা খেয়ে না খেয়ে অনেক পরিশ্রম করে আমাকে বড় করেছে। প্লিজ আমাকে দয়া করুন। টাকাগুলো নিয়েন না।' বলেই ডানহাতে মুখটা চেপে নিচু হয়ে আবির কাঁদতে শুরু করলো। মহিলাটা এবার আরো উচ্চস্বরে হাসছে। আবিরের কাছে সেই হাসি বিষের মতো লাগছে। মহিলাটা দ্বিগুণ মাত্রায় হাসতে হাসতে বোরকার নেকাবটা খুলে ফেললো। আবিরের হাতটা ধরে মহিলা বললো, 'এই ভীতুর ডিম, তাকা আমার দিকে। নইলে কিন্তু তোর চোখ তুইল্লা নিমু।' মুখ তুলে আবির মহিলার দিকে তাকিয়ে অপলক চোখে চেয়ে আছে। যেনো বিনা মেঘে বজ্রপাত! পাথরমূর্তির মতো হয়ে গেছে সে। শুধু অস্পষ্টস্বরে বললো, 'মিথিলা, তুই! মিথিলা হাসছে। সেই কলেজ জীবনে যেমন মাতাল হাসি হাসতো, ঠিক তেমনই। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতোই সে হাসি দ্যোতি ছড়ায় পুরো সিএনজি জুড়ে। 'জানিস, বাবার ব্যবসা গুছিয়ে গত সোমবার আমরা সবাই সৌদিআরবকে আল্লাহ হাফেজ বলে চলে এসেছি। সাথে এনেছি খুব সুন্দর একটা কম্বল। কারণ আগামী শীতে আমাদের দু'জনের মধ্যে যেনো শীত বাঁধা হতে না পারে। সেই কলেজ জীবনের মতোই দু'জন আবার একসাথে হাসছে। আবিরের মনে হচ্ছে সিএনজিটা আগের চেয়ে আরো দ্রুতগতিতে ঘোড়াশালের দিকে ছুটছে। ঠিক যেনো পাগলা ঘোড়া। টগবগ টগবগ করে ছুটছে। কেন জীবন এতো দ্রুত চলে যায়?
 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ