Skip to content

৩রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আজও যদি ফিরে পেতাম তোমায় জাতির পিতা

 

যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই

যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই।

যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই।

তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা, আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।

 

আজও যদি এই গানের কথা গুলো সত্যি হতো কতই না ভালো হতো। আজও এটাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে জাতির পিতা আমাদের মাঝে রয়েছেন। নিজের নেতৃত্বে পুরো বিশ্বের মহান নেতার খেতাব নিতেন তিনি।

 

তিনি আজ জীবিত অবস্থায় আমাদের মাঝে না থাকলেও আমাদের হৃদয়ের অন্তস্তলে আজও বেঁচে রয়েছেন। আজও দিয়ে যাচ্ছেন সকল পরিস্থিতিতে নিজেদের স্বাবলম্বী হয়ে উঠার অনুপ্রেরণা। পুরো বিশ্ব তাঁকে চিনে বাঙালি জাতির পিতা।

 

বাঙালি জাতির মধ্যে স্বাবলম্বিতা ও স্বাধীনচেতা মনোভাব জাগিয়ে তুলেছিলেন তিনি হলেন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহান এই নেতার জন্ম ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়।  বঙ্গবন্ধুর পিতা লুৎফর রহমান এবং মাতা সায়েরা খাতুন। ছয় ভাই বোনের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয়। ছোট বেলায় তার ডাকনাম ছিল 'খোকা'। ছোট থেকেই তিনি ছিলেন সহমর্মি স্বভাবের। দুর্ভিক্ষের সময় ধান বিতরণ করেন নিজের গোলা থেকেই। এছাড়াও গরিব ছাত্রদের জন্য সংগঠন করে চাল তুলে বিলিয়ে দিতেন তিনি।

 

১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ১৪ বছর বয়সী শেখ মুজিব কে দাদা আব্দুল হামিদের আদেশে তার ৩ বছর বয়সের সদ্য পিতৃ-মাতৃহীন চাচাতো বোন শেখ ফজিলাতুন্নেছার সাথে বিয়ে দেন বাবা লুৎফর রহমান। বিয়ের ৯ বছর পর ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স যখন ২২ বছর এবং শেখ ফজিলাতুন্নেছার বয়স ১২ বছর  তখন তাদের দাম্পত্য জীবনের সূচনা ঘটে।

 

ছোট থেকেই বঙ্গবন্ধু ভুগেছিলেন অসুখে। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়ে হৃদপিণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে চোখে গ্লুকোমা ধরা পড়ে এবং অস্ত্রোপচার করার পরে আরোগ্য লাভ করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে আই.এ. পাস করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ভারত বিভাজনের পরে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা স্কুলে পড়ার সময়ই হয়েছিল। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে আসেন তদানীন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং খাদ্য-মন্ত্রী ও পরবর্তী সময়ে বাংলা প্রদেশ ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবিতে একটি দল যায় তাদের কাছে যে দলের নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই ছোট থেকেই তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা এবং রুখে দাঁড়িয়েছেন সব পরিস্থিতিতে।

 

লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পর মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মাঠে নেমে পড়েছিলেন এই মহান নেতা। মুসলিম লীগের তরুণ ছাত্রনেতা হিসেবে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। ভারত ও পাকিস্তান কর্তৃত্বের বাইরে অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা গঠনের জন্য "যুক্তবঙ্গ আন্দোলন" সংগঠিত হলে বঙ্গবন্ধু তাতেও যুক্ত হন। এভাবেই একটু একটু করে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ ই সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে ঐ অঞ্চলের প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন।

 

শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক তৎপরতার সূচনা ঘটে বাংলা কে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ-র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পরে আন্দোলন জোরদার হয়। শেখ মুজিব একটি প্রস্তাব করেছিলেন যা থেকে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং সেই পরিষদের আহ্বানে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ ই মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট পালনকালে শেখ মুজিব সহ আরও কিছু রাজনৈতিক কর্মীকে সচিবালয়ের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয়। তীব্র প্রতিবাদের মুখে শেখ মুজিব সহ বাকি নেতাদের ১৫ ই মার্চ মুক্তি দেয়া হয়। এই মুক্তি উপলক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শোভাযাত্রা হয়।

 

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের পূর্ব পাকিস্তান আগমনকে উপলক্ষ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ ঢাকায় দুর্ভিক্ষ-বিরোধী মিছিল বের করে। এই মিছিলের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করে নিয়ে যায় এবং দুই বছর জেলে আটকে রাখা হয়। ১৯৫২ সালের ২৬ শে জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের জেল-মুক্তির আদেশ পাঠ করার কথা থাকলেও "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা" ঘোষণা করেন খাজা নাজিমুদ্দিন। এই সময় শেখ মুজিব জেলে থাকা অবস্থাতেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে পরোক্ষভাবে নানা দিক-নির্দেশনা দিয়ে যান। ১৪ ই ফেব্রুয়ারি থেকে জেলে বসেই অনশন পালনের সিদ্ধান্ত নেন শেখ মুজিব। তাঁর এই অনশন ১৩ দিন স্থায়ী ছিল এবং ২৬ শে ফেব্রুয়ারি তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেয়।

 

এভাবেই এগোতে থাকে শেখ মুজিব এর রাজনৈতিক জীবন। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ ই জুন তিনি প্রথম বারের মতো গণপরিষদের সদস্য হন এবং ১৭ জুন আওয়ামী লীগ পল্টন ময়দানে আয়োজিত এক সম্মেলনে ২১ দফা দাবি পেশ করেন, যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরপর আওয়ামী মুসলিম লীগের 'মুসলিম' শব্দটি উঠিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। এভাবেই শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিবাদ করে গেছেন একের পর এক অন্যায়ের। প্রতিবাদ করার জন্য তাঁকে বার বার জেলে আটকেও থাকতে হয়েছিল কিন্তু তিনি কখনও পিছপা হন নি নিজের অবস্থান থেকে।

 

১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের সাথে যোগসাজশ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে আগরতলা মামলা দায়ের করা হয়, যদিও উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের কারণে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ১৯৭০ এর নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করা সত্ত্বেও তাঁকে সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়া হয় নি।

 

১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চের ভাষণে পুরো দেশের মানুষকে নিজ দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে প্রস্তুত থাকতে বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে শেখ মুজিবের পাকিস্তানের নতুন সরকার গঠনের বিষয়ে আলোচনা বিফলে গেলে ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় গণহত্যা চালায়। এরই প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন স্বাধীনতার এবং একই রাতে তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। ব্রিগেডিয়ার রহিমুদ্দিন খানের সামরিক আদালতে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও তা কার্যকর হয় নি।

 

নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। আর এরই মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে "বাংলাদেশ" পরিচিতি লাভ করে এবং স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। বিজয় অর্জনের পর ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি সংসদীয় শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করে স্বাধীন বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

 

সকলের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন, যা সম্মিলিত ভাবে মুজিববাদ নামে পরিচিত। এগুলোর উপর ভিত্তি করেই৷ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন ও সেই অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করা সত্ত্বেও তিনি তীব্র দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সর্বত্র অরাজকতাসহ ব্যাপক দুর্নীতি মোকাবেলায় কঠিন সময় পার করেছেন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অস্থিরতা দমনের লক্ষ্যে একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে বাধ্য হন তিনি। আর এরই সাত মাস পরে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই আগস্ট সপরিবারে একদল সামরিক কর্মকর্তার হাতে নিহত হন সকলের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

 

তাঁর হাত ধরেই সৃষ্টি হয়েছে বাঙালি জাতির স্বাধীন পথচলা। তিনি পরিচিত হয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরই প্রেক্ষিতে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে বিবিসি কর্তৃক পরিচালিত জনমত জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

 

তিনি বাঙালি জাতির মনে চিরকাল বিরাজ করে থাকবেন। তাঁকে চোখে না দেখলেও তিনি আমাদের সকলের পরিচিত এবং সবচেয়ে কাছের একজন মানুষ। তাঁকে ফিরে পাওয়ার আশা আমাদের থাকলেও তিনি আর কখনোই আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। জাতির পিতার ৪৬ তম শাহাদাত বার্ষিকীতে রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।

 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ