Skip to content

৩রা মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২০শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এক মহীরুহের ছায়ার অনুসন্ধান: কাদম্বরী দেবী

সাহিত্য যদি বাস্তবের প্রতিবিম্ব হয় তাহলে সেই প্রতিবিম্বের সামনের বাস্তবকে আবিষ্কার করা কঠিন হয়ে ওঠে। কোন এক কবির কবিতা, কল্পনা, সৃষ্টির পেছনে অবস্থান করে কোন এক মানসী। বাংলার সাংস্কৃতিক আকাশে যদি মহীরুহের মতো কারো অবস্থান থেকে থাকে তবে সে রবীন্দ্রনাথ। আর কবিগুরুর মহীরুহের যে বিশাল ছায়া উপত্যকা অথবা সমতলকে ছেয়ে বেড়ায় সেখানে আমরা অবধারিতভাবেই খুঁজে পাই কাদম্বরী দেবীকে৷ 

 

কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে বাংলা সাহিত্য অথবা বাঙালীর ইতিহাসে কৌতূহলের অন্ত নেই। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের "কাদম্বরীর সুইসাইড নোট" বইটি থেকে কাদম্বরী সম্পর্কে যা জানা যায় তার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে৷ তবু কবিগুরু এবং কাদম্বরীর সম্পর্ক আজো রহস্য-ই হয়ে আছে। আমরা কিন্তু রহস্যময়ী কাদম্বরীর সম্পর্কে জানিনা। শুধুমাত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করেছি কবিগুরু এবং কাদম্বরীর মধ্যকার সম্পর্কের জটিলতা। সেই মুখরোচক গল্পকে বাদ দিয়ে আজ আমরা আবিষ্কার করি এক আধুনিক নারীকে; যার নাম কাদম্বরী দেবী। 

 

কাদম্বরী দেবী ঠাকুর পরিবারের পুত্রবধূ হয়ে আসার আগে মাতঙ্গিনী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যতটুকু জানা যায় তাঁর আদি পিতৃনিবাস যশোরে। কাদম্বরীর বয়স তখন ৯ অথবা ১০৷ ঠাকুর পরিবারের ষষ্ঠ সন্তান জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বধূ হয়ে ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে তাঁর আগমন। প্রথম যখন ঠাকুর পরিবারে কাদম্বরীর আগমন ঘটে, তখন তাঁর সামান্য অক্ষরজ্ঞান ছিল। ঠাকুর পরিবারের সকলেই তখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজের প্রতিভা বিকশিত করছিলেন। তারমধ্যে আগ্রহী জ্যোতিরিন্দ্রের কাছে যেন নিজের স্ত্রীই একজন পুতুলের মতো ছিলেন। অবশ্য সেটা সুনীলের প্রথম আলো উপন্যাসের জন্যে আমরা ভেবে থাকি। তবে স্বামী এবং ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের উৎসাহে কাদম্বরী লেখাপড়া শিখে ফেলেন। অবশ্য ঠাকুরবাড়ির রীতিই ছিল একটি শিক্ষামূলক পরিবেশ গড়ে তোলা। 

 

অবশ্য এই আধুনিক পরিবারে বিয়ে হওয়ার পরেও কাদম্বরীকে কিছুটা একঘরে অবস্থান করতে হচ্ছিলো। সেজন্যে অনেকাংশেই তার স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে কি দায়ী করা যায়? জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তখন উপমহাদেশের জ্যোতিষ্কের ন্যায় জ্বলজ্বলে। ক্রীড়া, সাহিত্য, নাট্যমঞ্চ, ব্যবসা-জগত সবকিছুতেই তাঁর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু কাদম্বরীর সাথে ঠিক যেন খাঁপ খাওয়াতে পারছিলেন না। কাদম্বরীর পরিবার মর্যাদার জন্যে ঠাকুর পরিবারে বিভিন্ন সময়ে তাকে অবহেলিত হতে হচ্ছিলো। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদাদেবী তো প্রায়ই বলতেন, ‘নতুনের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। কি যে একটা বিয়ে হল ওর। কোথায় নতুন আর কোথায় ওর বউ! এ বিয়েতে মনের মিল হওয়া সম্ভব নয়। স্ত্রী যদি শিক্ষাদীক্ষায় এতটাই নিচু হয়, সেই স্ত্রী নিয়ে ঘর করা যায় হয়তো, সুখী হওয়া যায় না। নতুন তো সারাক্ষণ আমার কাছেই পড়ে থাকে। গান বাজনা থিয়েটার নিয়ে আছে, তাই সংসারের দুঃখটা ভুলে আছে।’

 

কাদম্বরী ছিলেন অনেকটাই নিভৃতচারী। উপনিবেশিক প্রভাবে তখন অবশ্য ধনীক গোষ্ঠীর মতো আড্ডা, পার্টিতে যোগদানের মতো বিষয়গুলোতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারছিলেন না। অবশ্য তিনি সারাদিন বইপত্র নিয়েই থাকতে পছন্দ করতেন। এই নিভৃতচারী স্বভাবও তাকে ঝকমারি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। কাদম্বরীকে সকলেই অনেকটা অহংকারী বলেই ভাবতেন। নিভৃতচারী স্বভাবের ফলে অনেকেই ধারণা করেন তিনি জেদি। এই ভাবনাটুকু অবশ্য বিভিন্ন উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং লোক মুখের ঘটনা দ্বারাই প্রভাবিত কিনা তাও বিবেচ্য বিষয়। এই সময়ে রবি আর উর্মিলাই ছিল তাঁর সঙ্গী। উর্মিলা ছিল রবিঠাকুরের বড়দিদির মেয়ে। কাদম্বরীকে উর্মিলা খুব পছন্দ করত। উর্মিলার মৃত্যুর পর কানাঘুষো শুরু হল কাদম্বরীর অলক্ষুণে ভাগ্য নিয়ে৷ এমনকি নিঃসন্তান কাদম্বরীকে সবসময় এক ধরণের অবহেলার পরিবেশেই বাস করতে হচ্ছিলো। স্বামীর সাথে তার সম্পর্ক একদমই দূরত্বে ঘেরা ছিল। সেই দূরত্ব ঘোচানোর জন্যে জ্যোতিরিন্দ্রের কোন চেষ্টা আমরা অন্তত লক্ষ্য করিনা। 

 

রবীন্দ্রনাথের নিভৃত সাহিত্যচর্চার সময়ে কাদম্বরীই ছিল তাঁর একমাত্র সঙ্গী। রবীন্দ্রনাথের বিচক্ষণ পাঠিকা, খেলাঘরের সাথী, কিংবা হৃদয়ের রাণী হিসেবে কাদম্বরীর অধিষ্ঠান নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে মিথ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর "বউঠাকুরানীর হাট" উপন্যাসটির পরিকল্পনাও করেছিলেন কাদম্বরীর সাথে। ক্রমশ রবীন্দ্রনাথ নিভৃতচরণ থেকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। আমরা আবিষ্কার করতে শুরু করি বাংলার আকাশের এক মহীরুহ রবীন্দ্রনাথকে। এদিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর প্রাণোচ্ছলতা হারিয়ে ফেলে কারণ নক্ষত্রের পতনও অনিবার্য। 

 

কাদম্বরীর মৃত্যুর ঘটনা প্রায় অনেকেরই জানা। কলকাতা মহলে এই স্ক্যান্ডালটুকু নিয়ে কানাঘুষো এবং মুখরোচক আলোচনার অভাব নেই৷ এ নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'প্রথম আলো' উপন্যাসে আছে নিখুঁত বর্ণনা। তবে উপন্যাস বা ফিকশন তো বাস্তব বলে ধরা যায়না৷ কিন্তু ফিকশন প্রভাবিত করতে পারে। 

 

বিশাল সময়ে আমরা আবিষ্কার করার চেষ্টা করিনা নিভৃতচারী এক আধুনিক মহিলাকে। ঠিক অনেকটাই যেমন জীবনানন্দের স্ত্রীকে নিয়ে আমাদের আছে অজানা ভ্রান্তি। রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে সমগ্র বাংলা সাহিত্যকে আমরা ধারণ করতে পারিনা। কিন্তু সেই মহীরুহের ছায়াটুকুকে আমরা ভুলে যাই মানবী হিসেবে। মানসী আবিষ্কারের প্রচেষ্টা থেকেই আমরা সাময়িক সংস্কৃতির ভুল এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তি অবস্থানকে ভুলে যেতে শুরু করি। সেই মহীরুহের ছায়াকে নিয়ে অকপট সত্য আবিষ্কারের প্রচেষ্টা কতটুকু হয়েছে? বরং আমরা দেখতে পাই মিথগুলোকে রঙ চড়িয়ে আবেগী ঢঙ দিতে৷ সেটুকু এড়ানোর চেষ্টা এখন থেকে আবার শুরু করা উচিত।

 

 

 

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ