এ এক নতুন দিন
গত চার বছরের মধ্যে শেষ দুই সপ্তাহে সদ্য বিদায়ি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার প্রশাসন যে ভয়ংকর খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, সত্যি কথা বলতে, আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে বাইডেন-হ্যারিসের এই অভিষেকের দিনটিতে সবকিছু স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন হবে।
ট্রাম্পের বিপুলসংখ্যক উগ্র সমর্থক যেভাবে আমেরিকার ক্যাপিটল হিলে আক্রমণের পর জানালা ভেঙে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্সকে খুঁজে বের করার এবং হত্যার চেষ্টা করেছিল—এমন ঘটনা পুলিশকে হতবাক করে দিয়েছিল। গত চার বছর ধরে ট্রাম্পের সমস্ত বর্ণবাদী কর্মকাণ্ডের মতো আমার মনে হয়েছিল, তার সব ঘৃণার নীতি, শ্বেতাঙ্গ উগ্রতা—সবকিছু মিলিয়ে এই মুহূর্তে মার্কিন সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা করেছিল এবং একটি বৈধ নির্বাচনের মধ্যে কারচুপির কালিমা লেপটে দিতে চেয়েছিল।
আমি ভীষণভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম ৬ ডিসেম্বরের ঐ ভয়ংকর ঘটনা দেখে। এটা সত্যিই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল যে আমেরিকার এক প্রেসিডেন্টের প্রবল বর্ণবাদী উগ্রতা দ্বারা উজ্জীবিত ও উত্সাহিত হয়ে কিছু হিংস্র উগ্র শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সমর্থক এমন ভয়ংকর সহিংস কাণ্ড ঘটাতে পারে! আমি যতকাল যাবৎ এদেশে বসবাস করেছি, সবচেয়ে খারাপ কল্পনাতেও আমি কখনো চিন্তা করতে পারিনি যে মার্কিন সরকারেও এরকম আক্রমণ আসতে পারে, মার্কিন সরকারেও এমন দৃশ্য দেখতে হতে পারে! ক্যাপিটল হিল এবং ক্যাপিটল পুলিশ হলো সর্বাধিক সুরক্ষিত বলয়। এখানে আমেরিকার অন্যতম দামি পুলিশ বিভাগ রয়েছে।
আমি ভেবে দেখেছি, সেদিনের পেনসিলভেনিয়া অ্যাভিনিউয়ের উগ্র জনতা যদি মুসলমান হতো কিংবা যদি কৃষ্ণাঙ্গ হতো, তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে এমন আক্রমণ প্রতিহতের প্রতিক্রিয়া কতটা আলাদা হতো? মার্কিন সরকারে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য রয়েছে, পুলিশের মধ্যেও সাদাদের প্রতি বিশেষ সহানুভূতি রয়েছে। আমি সত্যিই সেদিন ভীষণভাবে মানসিক আঘাত পেয়েছি শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকদের আক্রমণ দেখে।
পরবর্তী দিনগুলোর পরিস্থিতি ৬ জানুয়ারির চেয়ে ভালো কিছু হয়নি। ইউএস ন্যাশনাল গার্ড এবং সামরিক ট্যাংকগুলো ওয়াশিংটনের রাস্তা দখল করে নিয়েছিল। আফগানিস্তান কিংবা ইরাকের চেয়ে আরো বেশিসংখ্যক আমেরিকান সেনা ছেয়ে গিয়েছিল রাজধানী জুড়ে। এসবের মধ্যে ট্রাম্প একধরনের মৌন অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। ওয়াশিংটন যেন অচিনপুর হয়ে উঠেছিল। বাড়িতে বসে আমার পরিবার এবং আমি বাইরে যেতে ভয়ে জমে গিয়েছিলাম। শহরতলির এলাকাটি এড়িয়ে চলছিলাম। শহরটি কেমন যেন অচেনা এবং অনিরাপদ ও উত্তেজনায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
২০ জানুয়ারি ছিল সম্পূর্ণ নতুন একটি দিন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের শপথ নেওয়ার দৃশ্যটি আমি ও আমার দুই কন্যা উপভোগ করছিলাম। শপথ অনুষ্ঠানের ভিড়ে বিভিন্ন বর্ণের অসংখ্য নারী সমর্থকের শক্তিশালী অবস্থান লক্ষ করছিলাম আমি। সেখানে ছিলেন মিশেল ওবামা থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সোনিয়া সোতামায়োর এবং অবশ্যই ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা দেবী হ্যারিস—যিনি কিনা একজন দক্ষিণ এশীয় কৃষ্ণাঙ্গ নারী! আমার হৃদয় গর্বে-আনন্দে টইটম্বুর হয়ে উঠেছিল। এক পর্যায়ে উচ্ছ্বসিত আনন্দে কেঁদে ফেলি আমি। বিশ্ব জুড়ে নানা বর্ণের ছোট ছোট মেয়ের কাছে এই শপথ অনুষ্ঠান একটি শক্তিশালী বার্তা নিয়ে এসেছে। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বর্ণের এমন শক্তিশালী নারীদের অবস্থান বিশ্বকে এই বার্তা দিচ্ছিল যে, বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের ছোট মেয়েরাও চাইলে ভবিষ্যতে আমেরিকা এবং বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নারী হতে পারবে।
এই অভিষেক অনুষ্ঠানটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কারণ, এই অভিষেক অনুষ্ঠানটি আমেরিকা ও সমগ্র বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমেরিকান গণতন্ত্র এমন একটি বিশ্বাস—যা রক্ষা করা দরকার। এটি অবিনশ্বর নয়। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির জমানা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, গণতন্ত্রও দুর্নীতিগ্রস্ত হতে পারে, গণতন্ত্রকে জিম্মি করে রাখা যেতে পারে এবং ঠিক রাজাকারদের মতোই আমাদের মধ্যেও সব সময় কিছু বিশ্বাসঘাতক থাকে। যেসব মার্কিন রাজনীতিবিদ দাঙ্গাবাজদের সমর্থন করেছিলেন এবং তাদের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ছিলেন—তাদের কি ক্ষমা করা হবে?
আমি একধরনের বিশেষ স্বস্তি অনুভব করেছি এটা বোধ করে যে—আমরা অবশেষে ট্রাম্প থেকে বেঁচেছি। ট্রাম্প এখন পরাজিত। তিনি যা কিছুর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন সেসব আজ পরাস্ত হয়েছে, অন্তত আপাতত এটা বলাই যায়। নানা দিক থেকে আমরা স্পষ্টতই প্রত্যক্ষ করেছি যে, স্বৈরশাসনের বলয় থেকে আমেরিকাকে বাঁচানো গেল।
হোয়াইট হাউজ আর ট্রাম্পের দখলে থাকবে না—এই সত্যের মধ্যে আমি যে সুখ অনুভব করছি তা কেবল আমার মা হওয়ার আনন্দের সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে। মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী কবি হিসেবে প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করলেন ২২ বছরের কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী আমান্ড গোরম্যান। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় যুব কবির সম্মান পাওয়া গোরম্যান তার ‘দ্য হিল উই ক্লাইম্ব’ কবিতায় বলেছেন— ‘আলোকদ্যুতি সর্বদাই থাকে। এটা কেবল তখনই দেখতে পারি—যদি সেটা দেখার জন্য আমরা যথেষ্ট সাহসী হই। কেবল তখনই দেখা যায়—যদি এটার জন্য আমরা যথেষ্ট সাহসী হই।’
ইংরেজি থেকে ভাবানুবাদ: তাপস কুমার দত্ত
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি সাংবাদিক, নারী অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ