রহস্যময় চরিত্র মিসির আলি!
কাল্পনিক চরিত্র মিসির আলি। স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদ। চরিত্রের রহস্যময়তার দরুন যাকে এখনো খুঁজে ফিরে হাজারো ভক্ত। কল্পনার জগতে হারিয়ে গিয়ে বাস্তবে মিসির আলিকে সাক্ষাৎ এর ইচ্ছে জাগে পাঠক হৃদয়ে।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্টি করেছেন হিমু, শুভ্র, রূপা, মিসির আলির মতো বহু কাল্পনিক চরিত্রের। তার সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে ভিন্নধর্মী, রহস্যময় এক চরিত্র মিসির আলি। হুমায়ুন-ভক্তদের কাছে মিসির আলি অত্যন্ত জনপ্রিয় চরিত্র। রোমান্টিকতা, অ্যাকশন, থ্রিলার গতানুগতিক পাঠকের শীর্ষে থাকা এমন কোনো বৈশিষ্ট্যের দেখা মেলেনি মিসির আলির কাহিনী গুলোয়। তাহলে প্রশ্ন আসে, তবুও কেনো বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী চরিত্র মিসির আলি?
উত্তর হচ্ছে রহস্যমাত্রা এবং লজিক বা যুক্তি।
মিসির আলির রহস্যময় কাহিনীর দরুন পাঠকরা তাকে গোয়েন্দার তালিকায় ফেলতে খুব একটা দ্বিধা বোধ করবে বলে মনে হয় না। তুলনা করতে পিছপা হবে না ব্যোমকেশ বা ফেলুদা চরিত্রের সাথে।
কিন্তু না! তিনি কোনো গোয়েন্দা নন। তবে চলুন মিসির আলির পরিচয়টা যানা যাক।
মিসির আলি পেশায় একজন মনোবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। রহস্যের মীমাংসা করতে পছন্দ করেন। তবে কোনো পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নয়, নিতান্তই শখের বশে। শারীরিক দিক থেকে রোগা, বেটে, ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী। বারবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার রেকর্ডও আছে তার।
তার বয়স নিয়ে ভাবলে শুরুতে তাকে সবাই এক বৃদ্ধ অধ্যাপকই ভাবেন। নিশীথিনী উপন্যাসে সর্বপ্রথম মিসির আলির বয়স তুলে ধরেন লেখক। শুধু বয়সই নয়। রসকষহীন, চাকচিক্যহীন মিসির আলির মনের রোমান্টিকতাও কিছু উঠেছিল সেবার এই উপন্যাসে। যেখানে লেখক লিখেছেন,
“নীলু উঠে দাঁড়ালো। এতো সুন্দর মেয়েটি। চোখেমুখে তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। কিন্তু তবুও এমন মায়া জাগিয়ে তুলছে কেন? মিসির আলি লজ্জিত বোধ করলেন। তার বয়স একচল্লিশ। এ বয়সের লোকজনের মনে এ জাতীয় তরল ভাব থাকা উচিত নয়।" তবে একচল্লিশ!
আচরণের দিক থেকে অনেকটা বিনয়ী ও সদাচারী। তার নাটকীয় মেজাজ সম্পর্কে চোখ উপন্যাসে লেখক কিছুটা লিখেছিলেন,
“সকাল দশটা পর্যন্ত কেন জানি তার মেজাজ বেশি ভালো থাকে। দশটা থেকে খারাপ হতে থাকে। চূড়ান্ত রকমের খারাপ হতে থাকে দুটোর দিকে। তারপর আবার ভালো হতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে অসম্ভব ভালো থাকে। তারপর আবারো খারাপ হতে শুরু করে।”
এ উপন্যাসে লেখক তার চরিত্রের আরেকটি অদ্ভুত দিক তুলে ধরেন,
“তার চরিত্রের বড় রকমের দুর্বল দিক হচ্ছে পরিচিত কারো সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগেনা। অপরিচিত মানুষের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলতে পারে। কথা বলতে ভালোও লাগে।”
মিসির আলির প্রথম উপস্থিতি দেখা যায় ১৯৮৫ সালে, হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত দেবী উপন্যাসে। এই উপন্যাসে মিসির আলি রানু নামের এক তরুণীর রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করেন। যেখানে দেখা যায় রানু নামের ঐ তরুণী থাকে এক্সট্রা সেন্সরি পারসেপশন সমৃদ্ধ। যে কিনা বর্তমানে থেকেই দেখতে পায় ভবিষ্যৎ। অবশ্য রানুর অতীতও কম রহস্যময় ছিলোনা। এরপর পর্যায়ক্রমে নিশীথিনী, নিষাদ, বৃহন্নলা, চোখ, ভয়, সর্বমোট ২২ টি উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থে দেখা যায় মিসির আলি চরিত্রকে।
রহস্য ভেদ করার প্রচেষ্টা নিরন্তর। কিন্তু সবসময় যে রহস্যভেদ করতে সক্ষম হয়েছে তা কিন্তু একদমই নয়। অনেক ক্ষেত্রেই রহস্য ছিলো অমীমাংসিত। এ প্রসঙ্গে "মিসির আলির অমীমাংসিত রহস্যে" বলেছিলো,
“প্রকৃতি সব রহস্য মানুষকে জানাতে চায় না। কিছু নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতে চায়। থাকুক না সেইসব রহস্য লুকানো।সব জানতেই হবে এমন কোনো কথা আছে?”
অবশ্য সকল রহস্য ভেদকারী এই মিসির আলি চরিত্রকে ঘিরেই রয়েছে অনেক রহস্য পাঠক হৃদয়ে। হুমায়ূন ভক্তরা মনে করেন মিসির আলি চরিত্রের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ নিজেকেই প্রতিফলিত করার চেষ্টা করেছেন। তাই বারংবার পাঠক মেলাতে চেষ্টা করেছেন হুমায়ূন আহমেদ আর মিসির আলি চরিত্রকে।
কিন্তু অদ্ভুতভাবে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে একবার দেখা হওয়ার কথা উঠে আসে 'বৃহন্নলা' উপন্যাসে। সে যাত্রায় মিসির আলি হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে কিছু কথা লিখেন,
“বদমেজাজি, অহংকারী। অধ্যাপকদের যেটা বড় ত্রুটি। অন্যদের বুদ্ধিমত্তা খাটো করে দেখা। ভদ্রলোকের তা আছে।”
যেটা পাঠক হৃদয়ে সৃষ্টি করেছে আরো উৎকন্ঠা। কারণ 'অনীশ' -এ আবার বুড়ি মিসির আলি সম্পর্কে লিখেছেন, “মানুষটা বুদ্ধিমান, নিশ্চয় এটা তার চমৎকার গুন। কিন্তু তার দোষ হচ্ছে একইসঙ্গে তিনি অহংকারী।”
চরিত্রের এই সাদৃশ্যতাই বারংবার পাঠকের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে তবে কি লেখকের প্রতিরূপই এই মিসির আলি চরিত্র। তবে দর্শক খুলতে পারেনি এই রহস্যের জট।
মিসির আলি চরিত্রের শেষ উপস্থিতি দেখা যায় ২০১২ সালে 'যখন নামিবে আঁধার' উপন্যাসে। মিসির আলি চরিত্রের স্রষ্টা হুমায়ূন আহমেদও প্রয়াত হন ২০১২ সালের ১৯ জুলাই।
তাই আর মিসির আলির দেখা মেলেনি নতুন কোনো রহস্য অনুসন্ধানে।
হুমায়ূন আহমেদরা কখনো হারিয়ে যান না। তারা আজীবন বেঁচে থাকে ভক্তদের অন্তরে। তেমনি হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্রও বেঁচে আছে পাঠকের হৃদয়ে। বাস্তব জীবনে কোনো রহস্যের গন্ধ পেলে আজো দর্শক মনে করে সেই কাল্পনিক রহস্য উন্মোচনকারী মিসির আলি চরিত্রের কথা, যে চরিত্রের রহস্যই কিনা কখনো উন্মোচিত হয়নি।