Skip to content

৬ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বুধবার | ২১শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একটি অবাস্তব গল্প

ঢাকা শহরের রাস্তায় জ্যাম লাগার কোনো পিক বা অফপিক আওয়ার থাকে। না। যেকোনো সময় যেকোনো রাস্তায় বিনা নোটিশে গিট্টু লেগে যায়। এই গিট্টু ছাড়ানোর র জন্য বাংলাদেশ ট্রাফিক পুলিশকে প্রশিক্ষিত করে সিগন্যাল এর দায়িত্ব দেওয়া হয় কিনা তা নিশ্চিত না। তবে গিট্টুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত মুখে কলা পাউরুটি খাওয়ায় যে তারা বিশেষ ভাবে পারদর্শী সেটা গত কয়েকবছর যাবত বাংলা মোটর সিগন্যালে এসে মনির সাহেব বুঝে ফেলেছেন। এ বছর তিনি তার দলবলকে বলেছিলেন অন্য কোনো সিগন্যালে যেতে। কিন্তু কেউ রাজি হয়নি। সবার কাছে স্বাধীনতা দিবস পর্যবেক্ষণের জন্য সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই জায়গাটাই সবচেয়ে উপযুক্ত মনে হয়েছে।

মনির সাহেব প্রতিবারের মতো এবারেও একদল অশরীরী আত্মা নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে জ্যামে বসে থাকা মানুষগুলোকে লক্ষ করছেন। সারা বছর তিনি অপেক্ষায় থাকেন এই দুটো দিনের জন্য। স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবস। এই বিশেষ দিনগুলোতে তিনি খুব আগ্রহের সাথে সব আত্মাদের জড়ো করে নিয়ে আসেন
জীবিত মানুষগুলো

কিভাবে উদযাপন করে তা দেখার জন্য। এবার কিছুতেই তাদের দলের সবচেয়ে ছোটো সদস্য অন্তকে আনা গেলো না সে গত দুই বছর করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় তার সমবয়সী কাউকে স্বাধীনতা দিবস পালন করতে দেখেনি। তার আগের বছরগুলোতে ছোট ছোট বাচ্চারা স্কুলে যেতো ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির জন্য। করোনায় জয়ে সব স্কুল বন্ধ থাকায় সিগন্যালে বাচ্চাদের দেখা না পেয়ে সে গিয়েছিল তার পরিচিত দুয়েকজন বাচ্চার খোঁজে। তাদের দেখে হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে। তাকে দেখে মনির সাহেব জিজ্ঞেস করেছিলেন,

‘কী ব্যাপার অস্ত্র? বাচ্চাদের কারো দেখা পাওনি?” সে বিরস মুখে উত্তর দিয়েছে, ‘কী আর বলবো মনির দাদু। ওরা তো ঘুম থেকেই ওঠেনি। কারো বাড়িতে পতাকা লাগায়নি। আজকের দিনটা ওদের জন্য শুধুমাত্র সরকারি ছুটির দিন। ওদের বাবা মায়েরা বলেনইনি আজ যে আমাদের জন্য কতো গর্বের একটা দিন।” ঘুম থেকে উঠলে বলবে নিশ্চয়ই।”
‘বলবে কী দাদু। তাদের কারো কী সেই সময় আছে? বাচ্চারা ঘুমে থাকতেই এক আন্টি বেরিয়ে গেলো বান্ধবীদের সাথে কিটি পার্টি করতে। যাওয়ার আগে একটা হিন্দি আর দুটো এনিমেশন মুক্তি ডাউনলোড করে দিয়ে গেলো ল্যাপটপে। আজকের দিনে টিভিতে কতো স্বাধীনতার অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে। সেগুলো দেখতে পারে। ওসব মুভি না দেখে দিপু নাম্বার টু দেখলেও তো বুঝতে পারতো আমার মতো ছোটো ছোটো ছেলেরাও যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পায়নি।”

মনির সাহেব অন্তর কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। তিনি এবার আর জোর করেনি তাকে। সে বলেছে যে ওপর থেকে গুনবে কটা বাড়ির ছাদে পতাকা লাগিয়েছে। প্রতি বছরের একটা হিসাব রাখবে সে। মনির সাহেব রমনা পার্কের সামনে দিয়ে আসার সময় দেখলেন সবার মধ্যে কেমন একটা গা-ছাড়া ভাব। আগের মতো বিভিন্ন সংগঠনের স্বাধীনতা দিবস পালনের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ নেই। প্রতিবার বাঁশের মাথায় বিভিন্ন আকারের পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যে কুদ্দুস মিয়া তাকেও দেখা গেলো না। গতবার অবশ্য তাকে বলতে শুনেছিলেন, ‘সবাই ফ্যালাট বাড়িতে থাকে। হ্যাগো বলে ছাদে পতাকা টাঙ্গাইতে দেয় না। এক স্যার নাইড়া চাইড়া দেখনের সময় কইছিলাম নিয়া যান স্যার, বারান্দায় লাগাইবেন। সে কয় পতাকা লাগাইলে বলে বারান্দার সোন্দথ্য নই। হায়রে বাতালি, যেই পতাকার লেইগা বাপ দাদায় জীবন দিলো হেই পতাকা হ্যাগো অসোন্দর লাগে।”

মনির সাহেব তার সঙ্গী আত্মাদের খোঁজে এদিক সেদিন তাকান। জ্যামে বসে থাকা প্রত্যেকের মুখে চরম বিরক্তির ছাপ। ছুটির দিনে রাস্তায় জ্যামে পড়ে থাকতে কারো ভাল লাগছে না। একটা গাড়ির সামনের সিটে লাল সবুজ শাড়ি পরা এক তরুণীকে দেখে তার ভীষণ ভালো লাগে। দেখে মনে হয় যেন স্বাধীনতার আনন্দে সে তার পুরো শরীরে পতাকা জড়িয়ে আছে। মনির সাহেব আগ্রহ নিয়ে সেই গাড়ির দিকে এগোতেই শুনতে পান গাড়ির ভেতর থেকে হিন্দি গানের শব্দ ভেসে আসছে। তিনি সরে আসেন সেখান থেকে। ছাঁটতে হটিতে আনমনেই খুঁজতে থাকেন কারো গাড়িতে দেশের গান বাজছে কিনা। রাস্তার দুই পাশের দোকানগুলোতে লাল সবুজ বেলুন সাজানো চোখে পড়ে। সেখানে লাল সবুজে সজ্জিত কপোত কপোতিদেরও দেখা যায়। কিন্তু স্বাধীনতা যেন এই সাজসজ্জাতেই সীমাবদ্ধ। কারো চেতনায় এর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না।

হাঁটতে হাঁটতে তিনি লক্ষ করেন রুমু দাঁড়িয়ে আছে একটা রিকশার সামনে। এক মনে রিকশায় বসা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সে কী যেন ভাবছে। ভাগ্যিস তারা আত্মা, নইলে এভাবে কারো দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলে আশেপাশের সবাই চমক উঠতো। মনির সাহেব রুমুর পাশে এসে দাঁড়ান। ‘কি রে মা। এতক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস?” রুমু একটু লজ্জা পেয়ে যায়। হেলে মাথা নিচু করে ফেলে। তারপর বলে, “সুখী সুখী চেহারার মানুষগুলোকে দেখতে ভালো লাগে চাচা। আমাকে যখন গুলি করে মেরে ফেলা হয় তখন আমি এই মেয়েটার বয়সীই ছিলাম। মৃত্যুর অমোঘ ক্ষমতার কারণে এত বছর পরেও আমি ওই একই বয়সে আছি।

মনির সাহেব একটু মুচকি হাসেন। আসলেই তো, মৃত মানুষের বয়স বাড়ে না। রুনু একটু লাজুক হাসি দিয়ে আঙুলে ওড়না প্যায়াতে পাঁচাতে বলে,

“চাচা, বিশ্বয় বসা মেয়েটা যে কলাপাতা রঙের শাড়িটা পরে আছে ঠিক সেরকম একটা শাড়ি পরে আমার বিয়ে হয়েছিল। যুদ্ধ লাগার কয়েকদিন আগে দেশের পরিস্থিতি খারাপ দেখে আমাদের দুজনের পরিবার তড়িঘড়ি করে আমাদের বিয়ে দেয়। কেনাকাটা করার সময় পাইনি কোনো। হাসানের বাবা মা গ্রাম থেকে আসতেও পারেনি। কয়েকজন বন্ধু আর বড় বোন দুলাভাইকে নিয়ে সে বিয়ে করতে আসে। এই কলাপাতা রঙের শাড়ি দেখে তার বোনের সে কী রাগ।

বারবার বলছিল, গর্দভটা আমাকে মার্কেটে যেতে দিলো না। নিজে শাড়ি কিনলো। বিয়ের কনের জন্য কেউ কলাপাতা রঙের শাড়ি কেনে? বিয়ের শাড়ি কিনবি লাল, তা না। একটা বিদঘুটে রঙের শাড়ি কিনে নিয়ে আসছিস। কিন্তু আমার যে কী পছন্দ হয়েছিল শাড়িটা। আমি তো বিয়ের পর আর শাড়ি পরার সুযোগ পাইনি। পরের দিন সকালেই হাসান জরুরি কাজ আছে বলে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তিন দিন পর যুদ্ধ লাগলে আমরা বুঝতে পারি তাকে আর পাওয়া যাবে না। তবে তার একটা চিঠি পেয়েছিলাম মাস খানেক পর। সেই চিঠিতে লিখেছিল, রুম্মু আমি যেদিন দেশ স্বাধীন করে বাড়ি ফিরবো সেদিন তুমি বিয়ের কলাপাতা রঙের শাড়িটা পরবে। আমি শাড়িটা যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম। শাড়ির ভাঁলে তার হাতব্যাগে পাওয়া পতাকাটাও ছিল। মিলিটারিয়া বাড়িতে হামলা চালানোয় সময় ওই শাড়িটাই বুকে চেপে ধরে রেখেছিলাম। তারা সেটা সহ গায়ের শাড়িটাও খুলে নিয়ে যখন তাণ্ডব চালাচ্ছিল তখন ওই শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে রাখা পতাকাটা দিয়েই তো লজ্জা নিবারণের শেষ চেষ্টা করেছি। সেটা ছিনিয়ে নিতে দেইনি। কাছে আসার পর খামচি

দিয়ে পিশাচটার চোখ তুলে ফেলেছিলাম বলেই তো গুলিটা

করলো।

রুমু চোখ মোছে। মনির সাহেব চশমার কাঁচ মোছেন। চোখের সামনে নিজের অন্তঃস্বত্তা পুত্রবধূর ওপর চালানো পৈশাচিক নির্যাতনের দৃশ্য ভেসে ওঠে।

রুমু বলে, ‘চাচা আমি আরেকটু এখানে দাঁড়াই। এই মেয়েটার স্বামীও জীবনযুদ্ধে দেশ ছেড়েছে। একটু আগেই ফোনে কথা বলছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার হাসান ফিরেছিল কিনা তা তো জানি না, এই মেয়েটার স্বামী যেন ফিরে আসে।”

মনির সাহেব মাথা নেড়ে হাঁটতে শুর করেন। তার খুব ইচ্ছে কয়ে জ্যামটা আর কিছুক্ষণ থাকুক, রুমু প্রাণ ভয়ে দেখুক তার পছন্দের বঙের শাড়ি পরা স্বামীর অপেক্ষায় থাকা সমব্যাসী মেয়েটাকে। তার মধ্যে হয়তো সে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে। ফুটপাতের পাশে একটা মোটর সাইকেল এ দুটো ছেলে নিজেদের জীবনের সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত। মদির সাহেব সেখানে রাহুলকে দেখতে পান। ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে ছেলে দুটোর কথা শুনছে মনোযোগ দিয়ে। ছেলে দুটো তার বয়সীই। কিন্তু ১৯৭১ সালের উনিশ বছরের সাথে ২০২৩ এয় উনিশে কুড়িতে যেন বিস্তর ফারাক। তাদের চোখে মুখে ছিল তারুণ্যের দীপ্তি, আর এদের চোখমুখ ভর্তি শুধু ডিপ্রেশন। একজন আক্ষেপ করে বলছিল, “এই দেশে পড়ে থেকে কোনো লাভ নাই। এতো লেখাপড়া করেছি কি এই দেশে বসে মাছি মারার জন্য? দেশ দেশ করে মরলে কোনোদিন নিজের উন্নতি হবে না।” সামনের বস্তুটি হেসে বলল, “তোরা সবাই যদি লেখাপড়া করে অন্য দেশ উন্নত করতে উঠেপড়ে লাগিস তাহলে নিজের দেশ উন্নত হবে কি করে? আর দেশের উন্নয়ন। না হলে ব্যক্তি উন্নয়ন অসম্ভব।”

ছেলেটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। “উন্নয়ন করবে সরকার। আমার কী?’

জনগণ নিতেই সরকার। নিজেরা কোনো দায়িত্ব নিবি না, খালি ভোট দেওয়ার বেলায় গণতন্ত্র খুঁজবি সেটা তো ঠিক না। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করলেই আর ভালো মন্দ সবকিছুর দায় সরকারের উপর ছেড়ে দেওয়া লাগে না।

“এই করাপ্টেড সিস্টেম এ থেকে দেশের জন্য কিছু করা সম্ভব না”। ‘সিস্টেম সরকার বানায়। করান্টেড আমরাই করি। নিজেদের সুবিধার জন্য সব জায়গায় দুর্নীতির আশ্রয় দিয়ে সরকারের ওপর দোষারোপ করা মনে হয় সমীচীন না।”

“এতো দেশপ্রেম আমার নাই। বেকুবের মতো এদেশে পড়ে থেকে আমি ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চাই না। লেখাপড়া করেছিই বিদেশে যাওয়ার জন্য।”

রাতুল অনেকক্ষণ ধরে ওদের কথা শুনছিল। নিজের সময়টার কথা মনে পড়ে তার। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে ছিল সে। পড়াশুনায় কখনই তেমন ভালো ছিল না। বাবা তার জন্য প্রচুর বকাবকি করলেও মা তেমন কিছু বলতেন না। উলটো বাবাকেই বলতেন, “এত বকাবকি কইরো না তো। সময় হইলে ঠিক হইয়া যাইব।” ঠিক সময় আসার আগেই দেশে যুদ্ধ শুরু হল। তাদের অজপাড়াগাঁয়ে তখনও যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠেনি। একদিন ঢাকা থেকে আসা এক বড়ো ভাই তাকে জিজ্ঞেস করল, “রাতুল, যুদ্ধে যাবি?”

প্রথমে সে বোকার মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। যুদ্ধে যাওয়ায় প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারেনি উনিশ বছরের ছেলেটা। তবে মনে হয়েছিল যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে আসলে তার বাবা কখনই আর তাকে অকর্মণ্য বলতে পারবে না। সবার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে সে। কাউকে কিছু না বলে একটা চিরকুট রেখে রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে গিয়েছিল সে। তার সীমিত গড়ির ভেতরের জগতে অনেক কিছুই অজানা ছিল। যুদ্ধ শিবিরে বড় ভাইদের কাছ থেকে জানতে পারে পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন শোষণের কথা। নিজেদের অধিকার বঞ্চিত হওয়ার বিভিন্ন চিত্র ফুটে উঠে তার চোখের সামনে। তখন বাবার চোখে নিজেকে বড় করার জন্য নয়, বরং দেশকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন করার জন্য রাইফেল তুলে নেয় হাতে।

সেদিন সারাদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। হানাদার বাহিনীর লোকজন ক্যাম্পে ছিল। বৃষ্টির পরপরই তাদের অপারেশানে নামার কথা। হানাদার বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছিল মুক্তিবাহিনীর দলটা। আড়াল থেকে শিবিরের সামনে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে তারা। অতর্কিত হামলায় দিশেহারা হয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে থাকে। পাল্টা জবাব দিতে থাকে মুক্তিযোদ্ধারাও। হঠাৎ একটা গুলি এসে লাগে রাতুলের পায়ে। একজন বড় ভাই বুকে ভর দিয়ে সামনে এগিয়ে আসে তাকে রক্ষা করার জন্য। সামনে থেকে একটা বুলেট এসে সরাসরি তার মাথায় লাগে। সাথে সাথে লে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পিছু হটতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটা। চাপা গলায় তাদের দলনেতা। রহিম বলতে থাকে ‘রাতুল তুই বেঁচে আছিস? কোথায় গুলি লেগেছে? রাতুল রাতুল।

রাতুল চাইলেই আওয়াজ করে সাহায্য চাইতে পাড়তো। কিন্তু সে মরার কান ধরে পড়ে থাকে। তাকে উদ্ধনা করতে আসলে মৃত্যু নিশ্চিত। সে মরে গেলেও দলের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু রহিম ভাইয়ের কিছু হলে সামনের অপারেশনগুলো ডালিয়ে নেওয়া আর লম্ভব হবে না। খাঁটি গেড়ে বসা হানাদার বাহিনী পুরো গ্রামকে তছনছ করে ফেলবে। সাড়া না পেয়ে রহিম ভাই পিছিয়ে যায়। গুলির শব্দ আস্তে আস্তে কমতে থাকলে পাক হানাদার বাহিনী এগিয়ে আসে। তাকে উলটে পালটে পায়ের গুলি দেখে বুঝে ফেলে সে বেঁচে আছে। তারপর টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় তাদের ক্যাম্পে। সেখানে দুইদিন হাত পা বেঁধে ফেলে রেখে তাকে আরো অনেক বন্দীর সাথে তুলে দেওয়া হয় একটা, ট্রাকে।

মনির সাহেব হাঁটতে হাঁটতে একেবারে সিগন্যালের কাছাকাছি এসে দেখেন স্বপন একটা দামী গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে গাড়িতে বসা একটা ছোটো বাচ্চার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার হাতে একটা খেলনা গাড়ি। সেটা থেকে সে চোখ সরাতে পারছে না। স্বপনকে সে কতবার বুঝিয়েছে এই খেলনা গাড়ির

জন্য তার ছেলে এখন পর্যন্ত বসে নেই। যুদ্ধের সময় তার দশ বছর বয়স হলে এখন সে বায়ান্ন বছরের। তবু কোনো বাচ্চার হাতে খেলনা দেখলে সে থমকে যায়। ছেলেকে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারেনি তাই কষ্ট পায়। স্বপনের ছেলে তার বাবার কাছে একটা খেলনা গাড়ি চেয়েছিল। সেসময় প্রতিদিন দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে দেয়া হতো। স্বপন ওইটুকু সময়ের মধ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে ঘরের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনতো আর ফেরার সময় কার মুক্তিবাহিনী বন্ধুদের গোপন আস্তানায় একটা টু মারতো যদি কোনো কাজে লাগে। মাঝে মাঝে অস্ত্র এদিক সেদিক নেওয়ার কাজে লে তার ছোট্ট গাড়িটা কাজে লাগাতো। একটা প্রাইভেট কোম্পানির ম্যানেজারের ঢাকরি করতো সে। মার্চের প্রথম থেকেই অফিসে লোকজনের সংখ্যা কমতে শুরু করে। পঁচিশে মার্চের পর কয়েকবার অফিসে যেতে চাইলেও তার স্ত্রী তাকে যেতে দেয়নি। বন্ধুদের অনেকের যুদ্ধে যাওয়ার খবয় পেয়েও লে ঘর ছেড়ে বেরোতে পারেনি। স্ত্রী সন্তানের প্রতি দায়িত্ববোধ তাকে পেছন থেকে টেনে ধরেছে, যদিও তার রক্ত টগবগ করে ফুটতো চারপাশের অবস্থা দেখে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানগুলো গুনে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেতো। সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে না পারলেও সে তার বন্ধুদের পাশে থেকে সর্বাত্মক ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তার বাবা যেদিন বাড়ি থেকে তাদেরকে নিজে আসলো সেদিন তার বুক থেকে যেন পাথর নেমে গেলো। সে ভেবেছিল পরদিন স্ত্রী আর ছেলেকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে সে যুদ্ধে যাবে। ভেবেছিল প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনে বাড়ি ফিরে এসে স্ত্রী আর বাবাকে ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলবে। বাবা অমত করবেন না সে জানতো। কারণ তার বাবা এই কয়েকদিন আগেও শুধু শেখ সাহেবের ভাষণ শোনার জন্য গ্রাম থেকে রেসকোর্স ময়দানে এসে হাজির হয়েছিলেন। এক রাত স্বপনের বাসায় থেকে ফিরে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, এবার আর বাঙালিরে দমায় রাখতে পারবো না। যারা বোঝার তারা ঠিকই বুইঝা ফেলছে। শেখ সাব স্বাধীনতার ডাক দিয়ে দিছে। প্রপ্রস্তুত হও খোকা। গোলামী করার দিন শেষ। সেদিন বাইরে যাওয়ার সময় ছেলে বায়না ধরেছিল খেলনা খাড়ি নিয়ে আসার জন্য। স্বপন গাড়ি নেওয়ার কথা ভুলে গেলেও তা নিয়ে কেন যেন যে কোনো অভিযোগ করেনি। বলেছিল, ‘থাক বানা, এখন গাড়ি লাগবে না। বাইরে তো কারফিউ। গাড়ি চালানো কোথায়? স্বপন বলেছিল, তুমি তো ঘরের ভেতর চালাবে। ওইটুকুন ছেলে কী বুঝেছিল কে জানে। দাদার কোল ঘেষে বসতে বসতে বলেছিল, ‘ঘরে বন্দী থেকে গাড়ি চালাবো না বাবা। দেশ স্বাধীন হোক। স্বাধীন বাংলার রাস্তায় নেমেই গাড়ি চালাবো।”

স্বপন বাবার দিকে তাকাতেই তার হাসি দেখে বুঝে ফেলেছিল স্বাধীনতার স্রোত তিনি নাতির শরীরেও বইয়ে দিয়েছেন। যেই রাতেই খাবার টেবিল থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় মিলিটারিরা। বাকিরা তাদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল কিনা সে জানে না। তাকে তুলে নিয়ে যে ট্রাকে তোলা হয় সেখানে খুবলে খাওয়া দুজন নারীর ক্ষতবিক্ষত দেহ দেখে আত্মা হয়ে ফিরে এসে সেই বাড়িতে উকি দেওয়ার সাহস আর হয়নি তার।

মনিয় সাহেব, অস্ত্র, রুমু, স্বপন সবাই সেই ট্রাকের ভেতরে

ছিল। একেকজনকে একেক জায়গা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে শহর থেকে দূরে কোথাও নিয়ে পাকবাহিনী তাদের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। একেককটা বুলেট যখন শরীরের ভিতর প্রবেশ করছিল, মনে হচ্ছিল সারা শরীরটা জ্বলে উঠেছিল, চারপাশে চোখ বুলিয়ে শেষবারের মতো সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছিল আপন মানুষদের, তখন যারা পাশে ছিল তারাই এখন পর্যন্ত এক সাথে আত্মা

হয়ে ঘুয়ে বেড়াচ্ছে।

মনির সাহেবের খুব ক্লান্ত লাগছে। তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে আসলেও অন্যদের কখনই ভাল লাগে না এই দিনগুলোতে জীবিত মানুষগুলোর পাশে আসতে। এবার তারও আর ভালো লাগছে না। গাড়ি ঘোড়া, অপরিকল্পিত রাস্তা ঘাট, মানুষের আধিকা এই শহরটাকে বিপর্যস্ত করে তুলছে দিনের পর দিন । অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের কারণে অল্প বয়সেই অসুখে পড়ে অকালে ঝরে পড়ছে অনেক নবীন প্রান। একজন ডাক্তার হিসেবে এসব দেখতে তার ভাল লাগে না। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অনেকদিন পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি যুদ্ধ শিবিরে গিয়ে অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করবেন কিনা। অসুস্থ স্ত্রীকে একা রেখে যেতে সাহস পাননি তিনি। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তার। সাধ্যমত তাদের সাহায্য করতেন, ওষুধপত্র সরবরাহ করেছেন, রাদের গচ্ছিত জিনিস যত্ন সহকারে লুকিয়ে রেখেছেন নিজের বাড়িতে। মুক্তিযোদ্ধারা যখন উল্কার মত উড়ে উড়ে একের পর এক বিভিন্ন সরকারি অফিসে হামলা চালাচ্ছিল, রাতের বেলা মোমের আলোতে তাদের গোপন আল্পনায় গিয়ে আহতদের চিকিৎসা করতেন। বুঝতে পারছিলেন বিজয়ের আর বেশি দেরি নেই। নিজের বাসার ছাদেও জাতীয় পতাকা ওড়ানোয় প্রস্তুতি নিচ্ছিলন। অপেক্ষায় ছিলেন সন্তানদের ফিরে আসার।

কিন্তু দেশের স্বাধীনতা বা নিজের মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোনোটাই দেখে যেতে পারেননি। হঠাৎ এক রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী এসে তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। চোখ বেঁধে একটা ট্রাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয় কোনো এক বধ্যভূমিতে।

বেলা শেষে মবিন সাহেব, অন্তু, রুমু, রাতুল, স্বপনসহ আরও অনেকে সেই বধ্যভূমিতে তৈরি স্মৃতিসৌধের সামনে এসে দাঁড়ায়। সকাল থেকেই জায়গাটায় অনেক ভিড়। অনেকে ফুল দিয়েছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো দলবেধে এসে তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করেছে, কেউ কেউ পাশেই সভার আয়োজন করেছে তাদের স্মরণে। তবে সবকিছুর পেছনেই ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করাটাই মুখ্য মনে হলো তাদের কাছে। প্রথম প্রথম এসব ভাল লাগত তাদের, এখন আর ভাল লাগে না। জীবিত মানুষগুলোর ভিতরের রূপ এখন অনেক স্পষ্ট তাদের চোখে। বেশিরভাগই আসে নিয়মমাফিক অনুষ্ঠান পালনের উদ্দেশ্য, অনেকের থাকে নিজেদের বিভিন্ন স্বার্থ পুরণের উদ্দেশ্য। স্বার্থ মেশানো, শ্রদ্ধা বা ভালবাসা তারা চায়নি। দেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় অর্ধশত বছর হল। পরিচিত অনেক মানুষই জীবনের মায়া কাটিয়ে তাদের সাথে এসে মিশেছে। এখন আর খুব বেশি কিছু চাওয়া নেই তাদের, শুধু চেয়েছিল বেঁচে থাকা মানুষগুলো বছরের দুইটি দিন অন্তত তাদের কথা মনে রাখুক, তাদের কথা বলুক, তাদের কথা ভেবে একটু কাঁদুক। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এই দিবসগুলো আজ একটা সাধারন ছুটি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। সত্যিকারের পরিহাসে পরিণত হতে যাচ্ছে এই দিনের আবেদন, তাদের প্রাণ বিসর্জনের মাহাত্ম্যটুকু। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যুদ্ধের কথা শোনাতে যেন এক অপাগরতা কাজ করে সবার মাকে। ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে তাদের প্রান বিসর্জনের ইতিহাস। প্রচন্ড কষ্ট হয় এই আত্মা গুলোর, তবু তারা চায় ভাল থাকুক পৃথিবীর মানুষগুলো, বেঁচে থাকুক তদের স্বপ্ন। সুন্দর আগামীর আশায় পরবর্তী স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসে আবার এই মানুষগুলোর কাছে আসার দিনক্ষণ গুনতে থাকে তারা।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ