অযত্ন-অবহেলায় কঙ্কালসার মনিপুরী রাজপ্রাসাদ
প্রাসাদের সামনে নীল রঙের সাইনবোর্ডে লেখা 'মহারাজা গম্ভীর সিংহ (১৮১৯-১৮২৬) এর স্মৃতি বিজড়িত ধ্বংসাবশেষ স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে সংস্কারকরণ’। মনিপুরীদের ইতিহাসের বাহক রাজপ্রাসাদটি 'মণিপুরী রাজবাড়ী' নামে লোকমুখে পরিচিত হয়ে উঠেছিল মহারাজা গম্ভীর সিংহ শ্রীহট্টে বসবাসকালে। রাজবাড়ী নামটি একালে সর্বত্রে ছড়িয়ে পড়লেও মহারাজা গম্ভীর সিংহের কালের সাক্ষী প্রাসাদটি প্রায় বিলুপ্তের পথে। খানিকটা মৃত মানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে সিলেট শহরের মির্জাজাঙ্গালের রাজবাড়ীর মন্দিরের পশ্চাদভিমুখে।
সরেজমিনে দেখা যায়, মহারাজা গম্ভীর সিংহের নিজ হাতে তৈরি প্রাসাদটি শেওলা ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় পরে আছে। ধ্বংসাবশেষের প্রাচীন দেওয়ালে এখনও ভেসে আছে চোখ ধাঁধানো নিখুঁত কারুকাজ। প্রায় পাঁচ বছর আগ পর্যন্ত রাজবাড়ীর মন্দিরের পূজারীদের কাছে অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষিত ছিল মহারাজাদের ব্যবহৃত বস্ত্রের আবরণ। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বহুকালের পুরনো বস্ত্রের আবরণ নষ্ট হয়ে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। তবে এখনো পূজারীরা স্ব-যত্নে রেখেছে রাজাদের ব্যবহৃত মূল্যবান আনুষঙ্গিক তৈজসপত্র।
পুরনো নির্মাণগুলোর মধ্যে এখনো রয়েছে মণিপুরী রাজাদের পূজা অর্চনার আপোকপ ধর্মের মন্দির। বর্তমানে দাঁড়িয়ে থাকা দেবালয়গুলো হিন্দুদের ত্রি-মন্দির বা তিন মন্দির বলে পরিচিত। মূলত মহারাজা গম্ভীর সিংহের তিন ভাই নিজ হাতে মণিপুরী আপোকপ ধর্মের দেবতা ইপুথৌ পাখঙবা’র প্রতীকী মূর্তি খোদাই করে দেবালয়গুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
শ্রীহট্টের স্থানীয়রা জানান, কালের বিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মহারাজা গম্ভীর সিংহের রাজপ্রাসাদটি প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে। তবে তাদের ব্যবহৃত আনুষঙ্গিক তৈজসপত্র রয়েছে। এখনো অক্ষত আছে রাজবাড়ীর সংলগ্ন লামাবাজারের চৌরাস্তার সম্মুখে অবস্থিত মহারাজাদের পূজা অর্চণার দেবালয়। সেখানে নিজ হাতে খোদাই করা মনিপুরী দেবতার প্রতীকীও রয়েছে দেবালয়ের উপরিভাগে। রাজাদের দেবালয় বর্তমানে ত্রি-মন্দির বলে আখ্যায়িত করে স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের দেবদেবীর পূজা করে চলছে।
ঊন-বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মণিপুর রাজ্যের রাজা চৌরজিৎ সিংহের ভাইরা একসঙ্গে মির্জাজাঙ্গালে বসতঘর স্থাপন করেছিলেন। সেখান থেকে তারা ঘোড়া গাড়িযোগে মনিপুরী আপোকপ ধর্মের পূজা অর্চনা করতে যেতেন লামাবাজারের দেবালয়ে। এক সময় তার বড় ভাই চৌরজিৎ সিংহ ও মার্জিত সিং কমলগঞ্জের ভানুগাছে বসবাস শুরু করলে আরেক ভাই গম্ভীর সিং থেকে যান রাজবাড়িতেই।
স্থানীয়রা জানান, ১৮২২ সালে ভারতবর্ষে সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা কারণে দফায় দফায় যুদ্ধ লেগেই থাকতো। তৎকালীন বৃটিশ সরকারের সহযোগিতায় মণিপুর রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য বার্মার সাথে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে রাজ্যের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ প্রাণ হারায়। ভয়াবহ এ যুদ্ধে ভারতের মণিপুর রাজ্যের অধিবাসীরা নিজ ভূমি ত্যাগ করে উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় নেন। রাজ্যের ক্ষমতাসীন রাজা চৌর্জিৎ সিংহ পালিয়ে যান আসামের কাছাড়ে। পরবর্তীতে রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তার ভাই মার্জিত সিংহ। কিন্তু তিনি বার্মিজদের কাছে পরাজিত হয়ে যুদ্ধ শেষে পুনরায় তিন ভাই রাজবাড়িতে ফিরে আসেন।
মণিপুরী রাজা-প্রজারা আপোকপ ধর্মের-লাইনিঙথৌ সানামহি, ইমা লৈমারেন সিদবি, লাইরু হানযব (আপোকপ), ইপুথৌ পাখঙবা, মালেম ইমা (সিদবি) ও ইপুথৌ শালাইলেন (আতিয়া সিদবি) এই ছয় দেবদেবীর পূজা করতেন। মণিপুরীদের প্রধান উৎসব ‘ইরাৎ’। তত্কালীন মণিপুরী রাজা ছিলেন প্রায় ষাট জনের ঊর্ধ্বে। যদিও সিংহাসন নিয়ে যুদ্ধ-সংঘর্ষ লেগেই থাকতো, তবে ধর্ম নিয়ে তাদের মধ্যে যুদ্ধ হয়নি কখনো। রাজারা পঞ্চ-ইন্দ্রিয় দিয়ে মণিপুরী আপোকপ ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। আপোকপ ধর্মের দেবতাদের মধ্যে ইপুথৌ পাখঙবা ছিলেন একজন দেব দূত। তিনি বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করতেন।
সে সময় হিন্দু ধর্মের আরেক ধার্মিক শান্তিদাস শ্রীহট্ট থেকে সনাতন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারত উপমহাদেশে গিয়েছিলেন ইপুথৌ পাখঙবা’র সাক্ষাৎ পেতে। সাক্ষাৎকালে মাত্রই ইপুথৌ পাখঙবা শান্তিদাসকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এখন তোমার সময়। এই পৃথিবীতে এমন এক বালক জন্ম নেবে, যার দ্বারা আপোকপ ধর্ম একশ আটটি স্থানে ছড়িয়ে যাবে। তখন ইপুথৌ’র আকস্মিক বাণী শুনে অবাক হন শান্তিদাস। তবুও তার লক্ষ্য সফল করতে সর্বোচ্চ অর্জিত বিদ্যা দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন ইপুথৌকে বশ করতে। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। ছুটে যান আরেক মণিপুরী রাজা ভাগ্যচন্দ্রের দরবারে।
রাজা ভাগ্যচন্দ্রের পিতামহের সঙ্গেও শান্তিদাসের ছিলো নিবিড় সম্পর্ক। শান্তিদাস রাজা ভাগ্যচন্দ্রের শীতল বুদ্ধি ও পিতামহের সহযোগিতায় মণিপুরী রাজাদের মধ্যে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করেন। সে থেকেই রাজাদের মধ্যে আধিপত্য ও ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। লড়াই এতটাই তীব্র ছিলো যে, বাধ্য হয়ে রাজারা পৃথকভাবে আপোকপ ধর্মের এক একটি দেবদেবীর পূজা অর্চনা শুরু করেন। সুযোগ বুঝে দুষ্ট মণিপুরী রাজারা রাজ্যের প্রজাগণের উপরে পাশবিক নির্যাতন চালাতে শুরু করেন। এমনকি দুষ্ট রাজারা স্ব-ধর্মের গ্রন্থ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিলেন বলেও জানা যায়। উপায়ন্তর না পেয়ে আপোকপ ধর্মকে আড়ালে আরাধনা শুরু করেন, অন্যদিকে বৈষ্ণব রীতি মেনে সনাতন ধর্মের পূজার আয়োজন করে প্রজারা। সময় বুঝে রাজা ভাগ্যচন্দ্র তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে মণিপুরীদের উত্সবে সনাতন ধর্মের কিছু সাজগোজ, নিত্য ভঙ্গির কৌশল প্রয়োগ করেন। এ থেকেই মণিপুরীরা আপোকপ ধর্মের পাশাপাশি সনাতন ধর্মও অনুসরণ করে যাচ্ছে। তবে সনাতন ধর্ম মণিপুরীদের বাধ্যতা মূলক নয়।
মণিপুরী রাজবাড়ি মন্দিরের পূজারী অশোক শর্মা বলেন, মণিপুরী রাজাদের বহু স্মৃতি বিজড়িত আনুষঙ্গিক মূল্যবান পণ্য ছিলো আমাদের কাছে। তবে তা অনেক পুরাতন থাকায় এমনিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাজাদের স্মৃতি বিজড়িত আনুষঙ্গিক পণ্য এখনো নিজ ঘরে আগলে রেখেছি ।
পূজারীর কন্যা অনিমা শর্মা বলেন, দূরদূরান্ত থেকে অনেক পর্যটক রাজাদের স্থাপনাটি দেখতে আসেন। কিন্তু এখনো রাজপ্রাসাদটি সংরক্ষণের পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তাই এভাবেই মণিপুরী ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটি মৃত হয়ে পড়ে আছে।
সূর্য্য সিংহ (৬১) বলেন, পূর্ব পুরুষের তথ্যমতে, রাজা গম্ভীর সিংহের তিন ভাই এক সময় মির্জাজাঙ্গালের রাজবাড়ি থেকে ঘোড়ার গাড়িতে করে লামাবাজারে যেতেন। সেখানে নিজ হাতে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে আপোকপ ধর্মের দেবদেবীদের পূজা অর্চনা করতেন। এখনো সেই প্রতীকী আছে।
মুক্তিযোদ্ধা মনমোহন সিংহ বলেন, সনাতন ধর্মকে মণিপুরীরা কখনোই গ্রহণ করেনি। আজও মনিপুরীদের প্রতিটি ঘরে নিষ্ঠার সাথে আপোকপ ধর্মের আরাধনা করা হয়।
গুনেন সিংহ (৭২) বলেন, হিন্দু ধর্মের ধার্মিক শান্তি দাস ও রাজা ভাগ্যচন্দ্র কারণে মণিপুরী আপোকপ ধর্মের মধ্যে সনাতন ধর্মের বৈষ্ণব রীতির প্রবেশ ঘটেছে। তবে মণিপুরীরা মূলত আপোকপ ধর্মে বিশ্বাসী।
ত্রি মন্দিরের বাসিন্দা জুঠিকা ঘোষ (৫০) বলেন, আমি এই তিন মন্দিরের দেখাশুনা করে যাচ্ছি প্রায় ১৬ বছর ধরে। আগে এ মন্দিরটি কি ছিলো তা আমার জানা নেই। তবে মন্দিরের একটিতে শিব ও অন্যটিতে মনসা দেবীকে পূজা করা হচ্ছে। আর অপর আরেকটি মন্দির এমনিতে পরে আছে।