Skip to content

২০শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ | বৃহস্পতিবার | ৬ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শুধু অনন্ত জলিল না, আপনাকেও বলছি

আমাদের চলচ্চিত্র জগত একটা সার্কাসের জায়গা। নায়িকারা হজ্ব করে বোরকা ধরে। কোনো নায়ক মারা গেলে তার অভিনয়ের মূল্যায়নের চেয়ে সে যে শুটিং থামিয়ে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত সেটা ফলাও করো ছাপা হয় মিডিয়ায়। বাংলা সিনেমায় ধর্ষকের চরিত্রে অভিনয় করে ‘সুখ্যাত’ ভিলেনও কথায় কথায় যেভাবে আলহামদুলিল্লাহ, সুবহানআল্লাহ বলে, হুজুরও ফেল মেরে যাবে। এফডিসির নির্বাচনী প্রচারণায় প্রার্থী নায়ক এফডিসিতে মসজিদ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চান।

 

এদেশের মুসলমানরাও তেমন, সিনেমা করা লোকজনকেও ইসলাম প্রচারকের ভূমিকায় দেখতে চায়! এফডিসি আর ইসলামি ফাউন্ডেশন গুলিয়ে ফেলে! কাজেই অনন্ত জলিল সেই হিসেবে ঠিক পথেই আছেন। সিনেমার নায়ক হয়েও তিনি যে মনে করেন, বাংলাদেশের সাধারণ নারীরা পোশাকের কারণে ধর্ষণের শিকার হয়, তাতে আমি মোটেও আশ্চর্য হইনি।

 

তিনি যে বললেন, ‘শালীন পোশাক পরা নারী কখনোই ধর্ষণের শিকার হয় না’, তাতে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমানের যোগ্য নায়ক তিনি। এদেশেই ময়ুরী, মুনমুন, শানু, পলি, মেহেদী, শাহীন আলমদের অশ্লীল সিনেমা সুপারহিট হয়, আবার হাজি শাবানা, নামাজি মান্নার কথা বলে অধিকাংশ মুসলমান তৃপ্তির ঢেকুর তোলে।

 

এদেশই মসজিদ এবং নামাজি মুসলমানের দেশ, আবার এদেশই দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন দেশ। এদের অধিকাংশ সারাজীবন হারাম চিন্তা করে, হারাম আয় করে আর হালাল সাবান-পারফিউমের বিজ্ঞাপন দেখে আলহামদুলিল্লাহ বলে। পারফিউমও যে হালাল হতে পারে, একমাত্র এই হারাম মগজেরই আবিষ্কার। ফলে আমাদের অধিকাংশ সিনেমার কর্মী (সাংস্কৃতিক কর্মী বলতে চাই না) আচরণে মৌলানা, জীবিকা সিনেমা। এই ভণ্ডদের পেছনে আবার ছুটে বেড়ায় এদেশের মিডিয়া। একজন খ্যাতিমান/নিবেদিত লেখকের মৃত্যুখবরের চেয়ে গুরুত্বপায় কথিত অভিনেত্রীর সকালে নাস্তার মেন্যু, বিকালের সাজগোছ।

 

শেষ কথা হলো, যেমন মিডিয়া, তেমন তার সুপারস্টার, তেমন মিডিয়া। এদেশের সিংহভাগ মানুষকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না, ধর্ষণের সঙ্গে মেয়েদের পোশাকের কোনোই সম্পর্ক নেই। সামান্য সম্পর্কটুকুও নেই। মাদরাসার হাজার ছেলেশিশু যে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, দশ বছরের নিচে হাজার হাজার মেয়েশিশু যে ধর্ষণের শিকার হয়, বৃদ্ধ মা ধর্ষণের শিকার হয়, এমনকী ছাগল-গরুও বাদ যায় না, এগুলোর কথা তারা একবারও বলবে না।

 

ধর্ষণের শিকার যেন একমাত্র বাংলা সিনেমার ভুড়িমোটা টপসপরা নায়িকারা হয়! ধর্ষণের মতো অপরাধের দোষটাও ইনিয়ে বিনিয়ে মেয়েদের উপর চাপাতেই হবে। বাংলাদেশের মেয়েদের পোশাক অশ্লীল নয়, অশ্লীল আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, অশ্লীল আমাদের জীবনাচরণ, অশ্লীল কথাবার্তা, অশ্লীল আমাদের চরিত্র, স্বভাব, বাকি যা থাকে সবকিছু।

 

‘ধর্মপ্রাণ’ মুসলমান ভাইবোনদের খুব রাগ হচ্ছে আমার উপর? দেশে মাদরাসার মতো পবিত্র জায়গায় যখন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, তাও ছেলেশিশু বলাৎকার, তখন রাগ হয় না? মেয়েদের সাধারণ পোশাক দেখেও মুসলমান দেশ বলে ছিঃ ছিঃ করেন, মুসলিম দেশ ঘুষে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হলে তখন ছিঃ ছিঃ করতে ইচ্ছে করে না? নটরডেমে পড়ে পড়ে বলে একঘরে করেন, কটা ধর্ষকের পরিবারকে একঘরে করেছেন? শূকরের মাংসের চেয়ে কি ধর্ষণ কম হারাম?

 

কথাগুলো বহুবার বলেছি, আবারও বলতে বাধ্য হচ্ছি। গ্রামীণ যুবসমাজ ধর্ষণ-হত্যা করলে বলি, সমস্যা মাদকে কিংবা পারিবারিক শিক্ষায়। শহরের যুবসমাজ ধর্ষণ-হত্যা করলে বলি, সাংস্কৃতিক অবক্ষয় কিংবা নৈতিক শিক্ষার অভাব বা পর্নো আসক্তি। দিনমজুর/শ্রমিক ধর্ষণ-হত্যা করলে বলি, সমাজে সুস্থ বিনোদনের অভাব, পতিতাপল্লির সংকট। মাদ্রাসার শিক্ষক ধর্ষণ-হত্যা করলে বলি, সমস্যা পশ্চাতমুখী ধর্মীয় শিক্ষায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ধর্ষণ-হত্যা করলে বলি, সমস্যা পাশ্চাত্যমুখী অ-ইসলামিক শিক্ষায়। আর একটা কমন সমস্যার কথা বলি- নারীর পোশাকে সমস্যা, চলনে সমস্যা।

 

শুধু অনন্ত জলিল না, আপনাকেও বলছি

কখনো সরাসরি আমরা বলি না, সমস্যা পুরুষের। পুরুষের চরিত্রের ঐতিহাসিক সমস্যা এটা। নারী ঘরে বাইরে শিক্ষালয়ে প্রার্থনালয়ে কর্মস্থলে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছে, হচ্ছে। কারণ আমরা সমস্যা খুঁজেছি নৈতিক শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, প্রতিষ্ঠানে, মাদকে, নারীর শরীরে, নারীর পোশাকে, নারীর চলবে। সমাজের সকল শ্রেণি ও পর্যায়ভুক্ত কোনো না কোনো পুরুষ যখন ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন মাদ্রাসা শিক্ষা, আল্ট্রা-আধুনিকতা, মাদকদ্রব্য, পর্নোগ্রাফি, নৈতিক শিক্ষার অভাব, সাংস্কৃতিক অবক্ষয় নারীর খাটো পোশাক এসব অজুহাত দাড় করিয়ে লাভ হবে না।

 

সমস্যা পুরুষের চরিত্রে, পুরুষের মননে। হাজার হাজার বছর ধরে পুরুষ ধারণাটি কতগুলো ভুল ধারণার উপর দাঁড়িয়ে আছে। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তার বাড়াবাড়ি রকমের অহংবোধ। কিন্তু একবারেও ভাবে না, কোনো না কোনো মাতৃগর্ভ থেকেই তাকে জন্ম নিতে হয়। প্রকৃতির মতোই শক্তিমান একজন মা। পুরুষ শক্তি খোঁজে তার পেশীতে, বাহুতে। কে বেশি শক্তিশালী, একজন মানুষ, না একটি বৃক্ষ?

 

কে সৃষ্টির সেরা জীব- মানুষ একপাক্ষিকভাবে নির্ণয় করেছে নিজেকে। মানুষ মানে পুরুষ। পুরুষ নারীকে এখনো সৃষ্টির সেরা জীব মনে করে না। কারণ তাদের পুরুষ চিরকালীন পবিত্রগ্রন্থে নির্ণয় করে দিয়েছে, নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে পুরুষ সৃষ্টির অনেক পরে তাকে সঙ্গ দিতে। এখানেই শেষ না, বলা হয়েছে, নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে পুরুষের শরীরের বাকা হাড় দিয়ে। সৃষ্টিকর্তা চাইলে ইভকে আদমের মতোই স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু সৃষ্টিলগ্নেই পুরুষ নারীর ভবিষ্যৎ সৃষ্টিকর্তার নাম দিয়ে নির্ধারণ করে ফেলেছে। এখন নারীরাও চাইলে এটা খণ্ডন করতে পারেন না। এতে নারীর ধর্ম থাকে না। নারী থাকবে পুরুষের অধীনে। এই সৃষ্টিকর্তাকে আবার আবিষ্কার করেছে পুরুষই। ফলে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে পুরুষের প্রতিনিধি হিসেবে পুরুষ সৃষ্টিকর্তাকে পেয়েছে নারীরা। নারীরা কেন সৃষ্টিকর্তাকে আবিষ্কার করেনি? এ প্রশ্নের এক ধরনের উত্তর আমি দিতে পারি।

 

প্রকৃতির মতো ঐতিহাসিকভাবেই নারীর ভেতর ভণ্ডামি কম। নারী অসৎ মিথ্যাবাদী হতে পারে। কিন্তু নারী কোনো ধর্মপ্রবক্তা হয় না, নারী কোনো হিটলার হয় না। পুরুষের পৃথিবীতে তাকে টিকে থাকার প্রশ্নে কিছুটা হিংস্র, অন্যায়প্রবণ হতে হয় বটে, ছলনা করতে হয়, কিন্তু চূড়ান্ত ভণ্ড তাকে হতে দেখি না। ফলে তার মেধা ও শক্তি নিয়ে পুরুষের মনে প্রশ্ন জাগে। কারণ পুরুষ কখনই বৃক্ষত্বকে শক্তিশালী জ্ঞান করতে শেখেনি। এই যে হাজার হাজার বছর ধরে পুরুষ ধারণাটি কতগুলো ভুল ধারণার উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেটাকে এখন ভাঙতে হবে। কিন্তু কাজটা কিভাবে হবে? এই প্রশ্ন আমাকে কেউ করলে সরল উত্তর দিতে পারব না।

 

কেউ কেউ হয়ত সামাজিক আন্দোলনের কথা বলবেন। দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বন্ধ করতে বৃহৎ সামাজিক আন্দোলন নিশ্চয় দরকার আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেই আন্দোলন হবে কিভাবে? এটা তো সম্ভব নয়, মানুষ আর সব অপরাধ (ঘুষ, দুর্নীতি, প্রশ্নফাস, ঋণখেলাপি, ধর্মীয় ভণ্ডামি, মাদক চোরাচালান ইত্যাদি) ঠিকই করবে কেবল ধর্ষণ করবে না? সমাজের অন্য অপরাধ কি আরেকটি অপরাধকে উসকে দেয় না? (সমাজের অধিকাংশ মানুষ যখন কোনো না কোনো ভাবে অসৎ, সুবিধাবাদী, দুর্নীতিগ্রস্থ সেখানে বৃহৎ সামাজিক আন্দোলনে অংশ নেবে কারা?) আমরা চাই ধর্ষকের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। কিন্তু যেখানে প্রভাবশালী মহল থাকে যারা নির্ধারণ করে তাদের লোকজনের শাস্তি হবে কিনা, সেখানে ধর্ষকও যে কোনো না কোনো মহলের বাঁধা লোক না, সেটা আমরা নিশ্চিত হবো কেমন করে?

 

এমন অনেক জটিল হিসাব আমাদের সামনে চলে আসে। আমরা খাতা-কলম নিয়ে বের হওয়ার পথ খুঁজি একটা অচল সমাজ ব্যবস্থা থেকে। কিন্তু এর মধ্যে যে পিতামাতার শিশুসন্তান চলে যায় ধর্ষকের ক্ষণিক মুহূর্তের পাশবিক উন্মাদনার শিকার হয়ে, তার বাবা-মাকে বলতে শুনি, আপনারা কন্যাশিশুদের সাবধানে রাখুন। পারলে মেয়েশিশুকে ভ্রুণ থাকতে হত্যা করুন, যাতে তাকে এভাবে মরতে দেখতে না হয়। তখন তাদের আহ্বান শুনে আমাদের সদ্য অন্তসত্তা স্ত্রীকে বলতে হয়, আমাদের দ্বিতীয় সন্তানও ছেলে হোক। মেয়েশিশুর স্বপ্ন আমাদের পূরণ না-হোক। অন্তত এদেশের এই বাস্তবতায় আর মেয়েশিশু প্রত্যাশা করতে পারি না আমরা। দেশ যখন উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। পদ্মাসেতুর পিলার দেখি টেলিভিশন খুললে, রাজধানীর জ্যামে আটকে থেকে দেখি মেট্ট্রো রেলের কাজ চলছে, উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, তখন আমরা ঘরে বসে ভাবি কন্যাশিশুর জন্য দেশ এখন তৈরি না।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ